বনফুলের একগুচ্ছ খুদে গল্প
প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০১৯
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের ১৯ জুন অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মনিহারীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে একগুচ্ছ খুদে গল্প পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
সমাধান
আকাশ নীল, বাতাস স্নিগ্ধ, ফুল সুন্দর এবং আমার নাম নীহাররঞ্জন হওয়া সত্ত্বেও আমার বিবাহ হইল পাকুড়াগ্রাম-বাসিনী ক্ষান্তমণি নাম্নী এক পল্লীবালার সহিত এবং বৎসরান্তে তিনি একটি কন্যারত্ন প্রসব করিয়া তাহার নাম রাখিয়া দিলেন—বুঁচি ! নামকরণটীতে একটু আপত্তি করিয়াছিলাম। তাহাতে বাড়ীর এবং পাড়ার সকলে সত্য কথাই বলিল—এই কালে কুচ্ছিৎ মেয়ে— তার নাম পুষ্পমঞ্জুরি দিবি নাকি? তোর যত সব অনাছিষ্টি—
মেয়েটা কুৎসিতই ছিল। রঙ ত কালোই—একটা চোখ ছোট আর একটা বড়তাছাড়া কি রকম যেন বোকাহাবা ধরনের—মুখে সর্বদাই লাল ঝরে। পুষ্পমঞ্জুরি নাম দেওয়া চলে না তা ঠিক।
বছর দুই পরে।
ক্ষান্তমণি বুঁচিকে লইয়া বাপের বাড়ী গিয়াছেন। সেদিন রবিবার কাহারো কাজকর্ম নাই—চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া নানা আলোচনা চলিতেছে। হঠাৎ আমার কথাই উঠিয়া পড়িল।
নৃপেন বলিল—এই দেখ না নীহারের অদেষ্ট। হল বা যদি একটা মেয়ে-তাও আবার এমন কদাকার—
শ্যাম বোস বলিলেন—তা আবার বলতে। বিয়ে দেবার সময় নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে আর কি! টাকা চাই প্রচুর।
হারু খুড়ো তামাকটাতে দুটান দিয়া কহিলেন—আরে ভাই, আজকাল আবার শুধু টাকা হলেই হয় না। লোকে টাকাও চায়-রূপও চায় যে। চোখ দুটা ছোট বড় হয়েই আরও মুস্কিল কিনা— কি যে হবে—
সকলেরই ঘোরতর দুশ্চিন্তা। এমন সময় পিওন আসিয়া আমাকে একখানা চিঠি দিয়া গেল।
নৃপেন বলিল—কার চিঠি হে?
আমি চিঠিটা পড়া শেষ করিয়া বলিলাম—বউ লিখেছে। বুঁচি মারা গেছে কাল।
তাজমহল
প্রথম যখন আগ্রা গিয়েছিলাম, তাজমহল দেখতেই গিয়েছিলাম। প্রথম দর্শনের সে বিস্ময়টা এখনও মনে আছে। ট্রেন তখনও আগ্রা স্টেশনে পৌছায়নি। একজন সহযাত্রী ব’লে উঠলেন, ওই যে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালাম।
ওই যে-
দূর থেকে দিনের আলোয় তাজমহল দেখে দমে গেলাম। চুনকাম করা সাধারণ একটা মসজিদের মত—ওই তাজমহল। তবু নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম। হাজার হোক তাজমহল। শা-জাহানের তাজমহল; অবসন্ন অপরাহ্নে বন্দী শা-জাহান আগ্রা দুর্গের অলিন্দে ব’সে এই তাজমহলের দিকেই চেয়ে থাকতেন। মমতাজের বড় সাধের তাজমহল। আলমগীর নির্মম ছিলেন না। পিতার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখননি তিনি- মহাসমারোহে মিছিল চলেছে, সম্রাট শা-জাহান চলেছেন প্রিয়া সন্নিধানে? আর বিচ্ছেদ সইল না…শবাধার ধীরে ধীরে নামছে ভূগর্ভে…ওই তাজমহলেই মমতাজের ঠিক পাশে শেষ-শয্যা প্রস্তুত হয়েছে তাঁর। আর এটা কবরও ছিল…হয়তো এখনও আছে…ওই তাজমহলেরই পাশে। দারা সেকোর…
চুনকাম-করা সাধারণ মসজিদের মত তাজমহল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। পূর্ণিমার পরদিন। তখনও চাঁদ ওঠেনি; জ্যোৎস্নার পূর্বাভাস দেখা দিয়েছে পূর্বদিগন্তে। সেদিন সন্ধ্যার পর দ্বিতীয়বার দর্শন করতে গেলাম তাজমহলকে। অনুভূতিটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই অস্ফুট মর্মর-ধ্বনি কানে এল। ঝাউবীথি থেকে নয়- মনে হ’ল যেন সুদূর অতীত থেকে; মর্মর-ধ্বনি নয়-যেন চাপা কান্না। ঈষৎ আলোকিত অন্ধকারে পুঞ্জীভূত তম্রিসার মত স্তূপীকৃত ওইটেই কি তাজমহল? ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলাম। মিনার, মিনারেট, গম্বুজ স্পষ্টতর হতে লাগল ক্রমশ। শুভ্র আভাসও ফুটে বেরুতে লাগল অন্ধকার ভেদ ক’রে। তারপর অকস্মাৎ আবির্ভূত হল- সমস্তটা মূর্ত হয়ে উঠল যেন সহসা বিস্মিত চেতনা-পটে। চাঁদ উঠল। জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ ওড়নায় অঙ্গ ঢেকে রাজরাজেশ্বরী শাজাহানমহিষী মমতাজের স্বপ্নই অভ্যর্থনা করলে যেন আমাকে এসে স্বয়ং। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
তারপর অনেকদিন কেটেছে।
কোন্ কন্ট্রাক্টর তাজমহল থেকে কত টাকা উপার্জন করে, কোন্ হোটেলওয়ালা তাজমহলের দৌলতে রাজা ব’নে গেল, ফেরিওয়ালাগুলো বাজে পাথরের ছোট ছোট তাজমহল আর গড়াগড়ার মত সিগারেট-পাইপ বিক্রি ক’রে কত পয়সা পেতে রোজ, নিরীহ আগন্তুকদের ঠকিয়ে টাঙাগুলো কি ভীষণ ভাড়া নেয়—এসব খবরও পুরনো হয়ে গেছে। অন্ধকারে, জ্যোঃস্নালোকে, সন্ধ্যায় উষায়, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরতে বহুবার বহুদেশে বহুরূপে দেখেছি তারপর তাজমহলকে। এতবার যে, আর চোখে লাগে না, চোখে পড়েই না…পাশ দিয়ে গেলেও নয়। তাজমহলের পাশ দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয় আজকাল। আগ্রার কাছেই এক দাতব্য চিকিভসালয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছি আমি। তাজমহল সম্বন্ধে আর মোহ নেই। একদিন কিন্তু- গোড়া থেকেই শুনুন তা হ’লে।
সেদিন ‘আউটডোর’ সেরে বারান্দা থেকে নামছি এক বৃদ্ধ মুসলমান গেট দিয়ে ঢুকল। পিঠে প্রকাণ্ড একটা ঝুড়ি বাঁধা। ঝুড়ির ভারে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে বেচারীর। ভাবলাম, কোনও মেওয়াওলা বুঝি। ঝুড়িটা নামাতেই কিন্তু দেখতে পেলাম, ঝুড়ির ভেতর- মেওয়া নয়, বোরখাপরা মহিলা ব’সে আছে একটি। বৃদ্ধের চেহারা অনেকটা বাউলের মত, আলখাল্লা পরা ধবধবে সাদা দাড়ি। এগিয়ে এসে আমাকে সেলাম ক’রে চোস্ত উর্দু ভাষায় বললে- নিজের বেগমকে পিঠে ব’য়ে এনেছে সে আমাকে দেখাবে ব’লে। নিতান্ত গরিব সে। আমাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ‘ফী’ দিয়ে দেখাবার সামর্থ্য তার নেই। আমি যদি মেহেরবানি ক’রে-
কাছে যেতেই দুর্গন্ধ পেলাম একটা। হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে বোরখা খুলতেই (আপত্তি করেছিল সে ঢের) ব্যাপারটা বোঝা গেল ক্যাংক্রাম্ অরিস! মুখের আধখানা প’চে গেছে। ডান দিকের গালটা নেই। দাঁতগুলো বীভৎসভাবে বেরিয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। দূর থেকে পিঠে ক’রে ব’ইয়ে এনে এ রোগীর চিকিৎসা চলে না। আমার ‘ইন্ডোরে’ও জায়গা নেই তখন। অগত্যা হাসপাতালের বারান্দাতেই থাকতে বললাম। বারান্দাতেও কিন্তু রাখা গেল না শেষ পর্যন্ত। ভীষণ দুর্গন্ধ! অন্যান্য রোগীরা আপত্তি করতে লাগল। কম্পাউন্ডার, ড্রেসার এমনকি মেথর পর্যন্ত কাছে যেতে রাজি হ’ল না। বৃদ্ধ কিন্তু নির্বিকার। দিবারাত্র সেবা ক’রে চলেছে। সকলের আপত্তি দেখে সরাতে হল বারান্দা থেকে। হাসপাতালের কাছে একটা বড় গাছ ছিল। তারই তলায় থাকতে বললাম। তাই থাকতে লাগল। হাসপাতাল থেকে রোজ ওষুধ নিতে যেত। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ইন্জেকশন দিয়ে আসতাম। এভাবেই চলছিল।
একদিন মুষলধারে বৃষ্টি নামল। আমি কল থেকে ফিরছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, বুড়ো দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটা চাদরের দুটো খুঁট গাছের ডালে বেঁধেছে আর দুটা খুঁট নিজে দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ভিজছে লোকটা! মোটর ঘোরালাম। সামান্য চাদরের আচ্ছাদনে মুষলধারা আটকায় না। বেগম সাহেব দেখলাম আপাদমস্তক ভিজে গেছে। কাঁপছে ঠকঠক ক’রে। আধখানা মুখে বীভৎস হাসি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
বললাম, হাসপাতালের বারান্দাতেই নিয়ে চল আপাতত। বৃদ্ধ হঠাৎ প্রশ্ন করলে, এ বাঁচবার কি কোনও আশা আছে, হুজুর?
সত্যি কথাই বলতে হ’ল, না।
বুড়ো চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল। আমি চলে এলাম।
পরদিন দেখি, গাছতলা খালি। কেউ নেই।
আরও কয়েকদিন পরে। সেদিনও কল থেকে ফিরছি- একটা মাঠের ভিতর দিয়ে আসতে আসতে বুড়োকে দেখতে পেলাম। কি যেন করছে ব’সে ব’সে, ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুরের রোদ। কি করছে বুড়ো ওখানে? মাঠের মাঝখানে মুমূর্ষু বেগমকে নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছে নাকি? এগিয়ে গেলাম। কতগুলো ভাঙা ইট আর কাদা নিয়ে বুড়ো কি যেন গাঁথছে!
কি হচ্ছে এখানে মিঞা সাহেব?
বৃদ্ধ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সেলাম করলে আমাকে।
বেগমের কবর গাঁথছি হুজুর!
কবর?
হাঁ হুজুর।
চুপ ক’রে রইলাম। খানিকক্ষণ নীরবতার পর জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি থাক কোথায়?
আগ্রার আশেপাশে ভিক্ষে ক’রে বেড়াই গরিব-পরবয়।
দেখিনি তো কখনও তোমাকে। কি নাম তোমার?
ফকির শা-জাহান!
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অজান্তে
সেদিন আপিসে মাইনে পেয়েছি।
বাড়ী ফেরবার পথে ভাবলাম ‘ওর’ জন্যে একটা ‘বডিস্’ কিনে নিয়ে যাই। বেচারী অনেক দিন থেকেই বলছে।
এ-দোকান সে-দোকান খুঁ’জে জামা কিনতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। জামাটি কিনে বেরিয়েছি–বৃষ্টিও আরম্ভ হল। কি করি–দাঁড়াতে হল। বৃষ্টিটা একটু ধরতে–জামাটি বগলে ক’রে–ছাতাটি মাথায় দিয়ে যাচ্ছি। বড় রাস্তাটুকু বেশ এলাম–তার পরই গলি, তা-ও অন্ধকার।
গলিতে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি–অনেকদিন পরে জা নতুন জামা পেয়ে তার মনে কি আনন্দই না হবে! আজ আমি–
এমন সময় হঠাৎ একটা লোক ঘাড়ে এসে পড়ল। সেও পড়ে গেল, আমিও পড়ে গেলাম–জামাটি কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল।
আমি উঠে দেখি–লোকটা তখনও ওঠেনি–ওঠ্বার উপক্রম করছে। রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল–মারলাম এক লাথি!
“রাস্তা দেখে চলতে পারো না শুয়ার!”
মারের চোটে সে আবার পড়ে গেল–কিন্তু কোন জবাব করলে না! তাতে আমার আরও রাগ হল–আরও মারতে লাগলাম।
গোলমাল শুনে পাশের বাড়ীর এক দুয়ার খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন–“ব্যাপার কি মশাই?”
“দেখুন দিকি মশাই–রাস্কেলটা আমার এত টাকার জামাটা মাটি করে দিলে। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে একেবারে। পথ চলতে জানে না–ঘাড়ে এসে পড়ল–”
“কে–ও? ওঃ–থাক্ মশাই মাফ করুন, ওকে আর মারবেন না! ও বেচারা অন্ধ বোবা ভিখারী–এই গলিতেই থাকে–”
তার দিকে চেয়ে দেখি–মারের চোটে সে বেচারা কাঁপছে–গা’ময় কাদা। আর আমার দিকে কাতরমুখে অন্ধদৃষ্টি তুলে হাত দুটি জোড় করে আছে।
অমলা
অমলাকে আজ দেখতে আসবে। পাত্রের নাম অরুণ। নাম শুনেই অমলার বুকটিতে যেন অরুণ আভা ছড়িয়ে গেল। কল্পনায় সে কত ছবিই না আঁকলে। সুন্দর, সুশ্রী, যুবা–বলিষ্ঠা, মাথায় টেরি, গায়ে পাঞ্জাবি–সুন্দর সুপুরুষ।
অরুণের ভাই বরুণ তাকে দেখতে এল। সে তাকে আড়াল থেকে দেখে ভাব্লে–‘আমার ঠাকুরপো!’
মেয়ে দেখা হয়ে গেল। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। একথা শুনে অমলার আর আনন্দের সীমা নেই। সে রাত্রে স্বপ্নই দেখলে!
বিয়ে কিন্তু হল না–দরে বন্ল না।
দুই.
আবার কিছুদিন পরে অমলাকে দেখতে এল। এবার পাত্র স্বয়ং। নাম হেমচন্দ্র। এবারও অমলা লুকিয়ে আড়াল থেকে দেখলে, বেশ শান্ত সুন্দর চেহারা–ধপ্ধপে রঙ–কোঁকড়া চুল–সোনার চশমা–দিব্যি দেখতে।
আবার অমলার মন ধীরে ধীরে এই নবীন আগন্তকের দিকে এগিয়ে গেল।
ভাবলে–কত কি ভাবলে!
এবার দরে বন্ল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ হল না।
তিন.
অবশেষে মেয়েও পছন্দ হল–দরেও বন্ল–বিয়েও হল। পাত্র বিশ্বেশ্বর বাবু। মোটা কালো গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক–বি. এ. পাশ সদাগরি আপিসে চাক্রি করেন।
অমলার সঙ্গে যখন তাঁর শুভদৃষ্টি হল–তখন কি জানি কেমন একটা মায়ায অমলার সারা বুক ভরে গেল। এই শান্ত শিষ্ট নিরীহ স্বমী পেয়ে অমলা মুগ্ধ হ’ল।
অমলা সুখেই আছে।
দুধের দাম
ট্রেন আসিয়াছিল। কয়েকটি সুবেশা, সুতন্বী, সুরূপা যুবতী স্টেশনে আসিয়াছিলেন। তাঁহাদেরই আশেপাশে জনকয়েক বাঙালী ছোকরাও, কেহ অন্যমনস্কভাবে, কেহ বা জ্ঞাতসারে ঘোরাফেরা করিতেছিল। ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধা যে একজনের হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া পড়িয়া গেলেন, তাহা কেহ লক্ষ্য করিল না। করিবার কথাও নয়, বিদেশাগত শিভ্যালরি জিনিসটা যুবতীদের কেন্দ্র করিয়াই বিকশিত হয়। সকলে অবশ্য যুবতীদিগকে লইয়া প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ব্যস্ত ছিল না। যাঁহার হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া বুড়ী পড়িয়া গেলেন, তিনি শিক্ষিত ভদ্রলোক, কাছেই ছিলেন তিনি বুড়ীকে স-ধমক উপদেশ দিলেন একটা।
‘পথ দেখে চলতে পার না? আর-একটু হলে আমার স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে যেত যে!’
বুড়ীর ডান পা-টা বেশ মচকাইয়া গিয়াছিল। তবু তিনি খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া প্লাটফর্মময় ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে একটা স্থান সংগ্রহ করিতেই হইবো অসম্ভব। ট্রেন বেশীক্ষণ থামিবেও না। হুড়মুড় করিয়া শেষে তিনি একটা সেকেলে ইন্টার ক্লাসে উঠিয়া পড়িলেন। যথারীতি সকলেই হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল। বর্তমানে অবশ্য ইন্টার ক্লাসের নাম বদলাইয়া সেকেন্ড ক্লাস হইয়াছে।
একজন বাঙালী ভদ্রলোক ইচ্ছা করিলে একটু সরিয়া বসিয়া জায়গা করিয়া দিতে পারিতেন, তিনি জিনিসপত্র সমেত বেশ একটু ছড়াইয়া বসিয়া ছিলেন কিন্তু তিনি সরিয়া বসিলেন না, উপদেশ দিলেন—
‘উঠলে ত, এখন বসবে কোথায় বাছা!’
‘আমি নিচে তোমাদের পায়ের কাছে বসব বাবা। দুটো স্টেশন মাত্র, তারপরই নেমে যাব। বেশীক্ষণ অসুবিধা করব না তোমাদের।’
বুড়ী তাঁহার পায়ের কাছেই তাঁহার জুতাজোড়া সরাইয়া দিয়া বসিয়া পড়িলেনা অসুবিধা তেমন কিছু হইল না, কারণ বৃদ্ধা ছোটখাটো আয়তনের মানুষ, গুটিসুটি হইয়া বসিয়া ছিলেন। একটু পরেই কিন্তু তিনি অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। যে পায়ে স্ট্র্যাপটা আটকাইয়া গিয়াছিল সেই পা-টা বেশ ব্যথা করিতে লাগিলা চাহিয়া দেখিলেন, পা ফুলিয়া উঠিয়াছে। তাঁহার ভাবনা হইল নামিবেন কী করিয়া। আর দুই স্টেশন পরেই শুধু নামিতে হইবে না, আর-একটা ট্রেনে উঠিতেও হইবে। অথচ পা নাড়িতে পারিতেছেন না, দাঁড়ানই যাইবে না যে। ট্রেনের কামরায় অনেক বাঙালী রহিয়াছেন, অনেকে তাঁহার পুত্রের বয়সী, অনেকে পৌত্রের। কিন্তু ইহারা যে তাঁহাকে সাহায্য করিবেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা হইতে তাহা তিনি আশা করিতে পারিলেন না। তবু। হয়তো হঁহাদেরই সাহায্য ভিক্ষা করিতে হইবে। উপায় কি!
বৃদ্ধা যে-স্টেশনে নামিবেন, সে-স্টেশন একটু পরেই আসিয়া পড়িল। প্যাসেঞ্জাররা হুড়মুড় করিয়া সবাই নামিতে লাগিলেন, বুড়ীর দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহিলেন না।
‘আমাকে একটু নাবিয়ে দাও না বাবা, উঠে দাঁড়াতে পাচ্ছি না আমি।’
বুড়ীর এই করুণ অনুরোধ সকলেরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। কিন্তু অধিকাংশই ভান করিলেন যেন কিছু শুনিতে পান নাই।
একজন বলিলেন, ‘ভিখারী মাগীর আস্পর্ধা দেখেছেন? যাচ্ছে ত উইদাউট টিকিটে, তার উপর আবার—
তিনি বৃদ্ধাকে ভিখারিণীই মনে করিয়াছিলেন। বৃদ্ধা কিন্তু ভিখারিণী নন, তাঁহার টিকিটও ছিল। সেকেন্ড ক্লাসেরই টিকিট ছিল।
আর একজন বিজ্ঞ মন্তব্য করিলেন, ‘এই সব হেল্পলেস বুড়ীকে রাস্তায় একা ছেড়ে দিয়েছে, এর স্বামী ছেলে নেই না কি, আশ্চর্য কাণ্ড!
সিগারেটে টান দিতে দিতে তিনিও নামিয়া গেলেন। গাড়িতে যাঁহারা রহিলেন, তাঁহাদের মধ্যে জন-দুই টিফিন-কেরিয়ার খুলিয়া আহারে মন দিয়াছিলেন, বুড়ীর কথা তাঁহাদেরও কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করা তাঁহারা সমীচীন মনে করিলেন না।
বৃদ্ধা তখন দুই হাতে ভর দিয়া ঘাঁসটাইয়া দ্বারের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু নামিতে সাহস পাইতেছিলেন না।
‘এই বুড়ী, হটো দরোয়াজাসে—’
এক মারোয়াড়ী যাত্রী বৃদ্ধার গায়ে প্রায় পদাঘাত করিয়াই ভিতরে প্রবেশ করিলেন তাঁহার পিছনে এক বলিষ্ঠকায় কুলী। তাহার মাথায় স্যুটকেশ হোলড-অল। কুলীর পিছনে চপ্পল-পায়ে নীল-চশমা-পরা লক্কা গোছের এক ছোকরা। সে ভঙ্গীভরে বলিল, ‘দয়াময়ি, পথ ছাড়ুন। দরজার কাছে বসে কেন!’
‘পায়ে লেগেছে বড্ড বাবা, নামতে পাচ্ছি না।’
‘ও, দেখি যদি একটা স্ট্রেচার আনতে পারি!’
ছোকরা ভিড়ে অন্তর্ধান করিল আর ফিরিল না।
যে বলিষ্ঠ কুলীটা মাল মাথায় করিয়া ঢুকিয়াছিল সে বাহিরে যাইবার জন্য দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
‘মাইজি, কিরপা করকে থোড়া হাটকে বৈঠিয়ে। আনে-নেকা রাস্তা পর কাহ বৈঠ গ্যয়ে?’ বৃদ্ধা হঠাৎ ফুপাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। ‘আমি নামতে পাচ্ছি না, বাবা, পায়ে চোট লেগেছে—
‘আপ কাঁহা জায়েগা—?’
‘গয়া—‘
‘চলিয়ে, হাম আপকো লে যাতে হেঁ।’
বলিষ্ঠ বয়স্ক ব্যক্তি যেমন করিয়া ছোট শিশুকে দুই হাতে করিয়া বুকের উপর তুলিয়া লয়, কুলীটি সেইভাবে বুকে বৃদ্ধাকে তুলিয়া লইল। সোজা লইয়া গেল ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে।
‘আপ হিয়া পর বৈঠিয়ে মাইজি, গয়া প্যাসেঞ্জারকা থোড়া দেরি হ্যায়। হাম ঠিক টাইম পর আকে আপকো ট্রেনমে চড়া দেঙ্গে।’।
বৃদ্ধা ওয়েটিং রুমের মেঝেতেই উপবেশন করিলেন।
যে দুইটি ইজিচেয়ার ছিল, সে-দুইটিতেই সাহেবী পোশাক-পরা দুইজন বঙ্গসন্তান হাতলের উপর পা তুলিয়া দিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া ছিলেন একজন পড়িতেছিলেন খবরের কাগজ, আর একজন একখানি ইংরেজী বই। বইটির মলাটের উপর অর্ধনগ্না হাস্যমুখী যে নারীমূর্তিটি ছিল, বৃদ্ধার মনে হইল, সেটি যেন তাঁহার দিকে চাহিয়া ব্যঙ্গের হাসি হাসিতেছে।
সম্ভবত আলোচনাটা পূর্বেই হইতেছিল। পুনরায় আরম্ভ হইল।
‘শিভ্যলরি আমাদের দেশেরও ছিল নাৰ্যযত্র পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা, একথা আমাদের মনুতেই লেখা আছে মশাই।’
যিনি নারী-মূর্তি-সম্বলিত ইংরেজী মাসিক পড়িতেছিলেন, তিনি সম্ভবত এ খবর জানিতেন না। উঠিয়া বসিলেনা
‘বলেন কি! এ-কথা জানলে ব্যাটাকে ছাড়তুম নাকি! মনুর যুগেও যে আমাদের দেশে শিভ্যলরি ছিল, আমরা যে বর্বর ছিলুম না, এ-কথা ভাল করেই বুঝিয়ে দিতুম বাছাধনকে—
বৃদ্ধা অনুভব করিলেন ইতিপূর্বে কোন সাহেবের সঙ্গে বোধহয় লোকটির তর্ক হইয়াছিল। শ্বেতবর্ণ সাহেব সম্ভবত এই সাহেবী পোশাক-পরা কৃষ্ণচর্ম বঙ্গ-সুন্দরকে বর্বর বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়াছিলেন।
বৃদ্ধা মনে মনে বলিলেন, ‘তোমরা বর্বরই বাছা। তোমাদের শিভ্যালরি অবশ্য আছে, কিন্তু তার প্রকাশ কেবল যুবতী মেয়েদের বেলা।’
বৃদ্ধার বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজীতে কিঞ্চিৎ দখল ছিল। সেকালের বেথুন স্কুলে পড়িয়াছিলেন।
হঠাৎ দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি বৃদ্ধাকে দেখিতে পাইলেন।
‘আরে, এ আবার কোত্থেকে জুটল এসে এখানে?’
‘কোনো ভিখিরী-টিকিরী বোধ হয়া’
প্রথম ভদ্রলোক আন্দাজ করিলেন।
‘সত্যি, ভিখিরীতে ভরে গেল দেশটা স্বাধীনতার পর ভিখিরীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। সবাই আবার মুখ ফুটে চাইতেও পারে না।’
দেখা গেল ভদ্রলোকটি একটি পয়সা বাহির করিয়া বুড়ীর দিকে ছুঁড়িয়া দিলেন।
নির্বাক হইয়া বসিয়া রইলেন বৃদ্ধা।
‘পয়সাটা তুলে নাও, পয়সাটা তোমাকেই দিলাম।’
বৃদ্ধা তবু কোনো কথা বলিলেন না।
দাতা ভদ্রলোকের সন্দেহ হইল বোধহয় বুড়ী বাঙালী নয়। তখন রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করিলেন চাকুরির অনুরোধে কিছুদিন পূর্বেই রাষ্ট্রভাষায় পরীক্ষা পাস করিয়াছেন।
‘পয়সা উঠা লেও। তুহমী কো দিয়া।’
তখন বৃদ্ধা পরিষ্কার বাংলায় বলিলেন, ‘আমি ভিখিরী নই বাবা, আমি আপনাদের মত একজন প্যাসেঞ্জার।’
‘এখানে কেন? এটা যে আপার ক্লাস ওয়েটিং রুম।’
‘আমার সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট আছে।’
পরমুহূর্তে সেই বলিষ্ঠ কুলীটি দ্বারপ্রান্তে দেখা দিল।
‘চলিয়ে মাইজি, গয়া প্যাসেঞ্জার আ গিয়া।’
তাহার বলিষ্ঠ বাহুর দ্বারা পুনরায় বৃদ্ধাকে শিশুর মতো বুকে তুলিয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল।
গয়া প্যাসেঞ্জারে একটু ভিড় ছিল। কিন্তু কুলীটি বলিষ্ঠা শক্তির জয় সর্বত্র। সে ধমক-ধামক দিয়া বুড়ীকে একটা বেঞ্চের কোণে স্থান করিয়া দিতে সমর্থ হইল।
বৃদ্ধা তাহাকে দুইটি টাকা বাহির করিয়া দিলেন।
এই প্রসঙ্গে কুলীর সহিত হিন্দীতে যে কথাবার্তা হইল তাহার সারমর্ম এই—
‘আমার মজুরি আট আনা। দু টাকা দিচ্ছেন কেন?’
‘তুমি আমার জন্যে এত করলে বাবা, তাই বেশী দিলুম।’
‘না মাইজি, আমাকে মাপ করবেন। আমি ধর্ম বিক্রি করি না।’
‘তুমি আমার ছেলে বাবা, ছেলের কাজই করেছ। আমি তো তোমাকে দুধ খাওয়াইনি, সামান্য যা দিচ্ছি তা দুধের দাম মনে করেই নাও বাবা। দীর্ঘজীবী হও, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।’
বৃদ্ধার গলার স্বর কাঁপিয়া গেল। চোখের কোণে জল টলমল করিতে লাগিল।
কুলী ক্ষণকাল হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর প্রণাম করিয়া নামিয়া গেল।