ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৪, ২০২৩

এই কবিতায় ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ তার হারানো প্রেমিকা এবং একইসঙ্গে নিজের মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া ও আকাঙ্ক্ষার থিমটি অনুসন্ধান করেছেন। A Lover From Palestine কবিতাটি হারানো প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে একজন প্রেমিকের বয়ান। তিনি তাকে তার হৃদয়ের কাঁটা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ব্যথা হলেও তিনি ভালোবাসার সেই কাঁটা পরম যত্নে হৃদয়ে লালন করেন। তিনি প্রেমিকার সঙ্গে একসাথে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতিতে ভাসেন। কবিতাটি ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন নব্বই দশকের খ্যাতিমান কবি শাহেদ কায়েস

ফিলিস্তিনের এক প্রেমিক

তোমার চোখ আমার হৃদয়ে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে
কষ্ট হচ্ছে, তবুও আমি সেই কাঁটাকে বুকে ধরে আছি
এবং ঝড়ো হাওয়া থেকে তাকে রক্ষা করছি
পরম যতনে একে আমার দেহে লুকিয়ে রাখি
আমি এই কাঁটা রাত এবং যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করছি
আর তার ক্ষত আঁধারকে উজ্জ্বল করে তোলে―
এর ভবিষ্যৎ আমার বর্তমানকে আলোকিত করছে
এই কাঁটা আমার আত্মার চেয়েও প্রিয়―
এবং শীঘ্রই আমি ভুলে যাব, যখন আমার চোখ
                       কাঙ্ক্ষিত চোখের সাথে মিলিত হবে
সেই যে মিলিত হয়েছিলাম একবার আমরা
                                                  দরোজার ফাঁকে
 
তোমার কথাগুলো আমার কাছে গান হয়ে আসে
আমিও গাইতে চেষ্টা করেছিলাম সেদিন―
কিন্তু বসন্তের ঠোঁটকে ঘিরে রেখেছিল তীব্র শীত
তোমার কথাগুলো চড়ুই হয়ে উড়ে যায় অন্য কোথাও
চড়ুইয়ের চঞ্চলতা নিয়ে কখন যে পালিয়ে গেলে তুমি!
কোথায় যে এখন তুমি!
উড়ে গেল বাড়ির দরোজা, পরিযায়ী হলো শরৎ
ভেঙে গেল আয়না, বেদনা ভর করলো চোখে
             আর আমাদের দুঃখ বেড়ে গেল হাজার গুণ

বোমার শব্দে কেঁপে উঠি, শব্দের স্প্লিন্টার কুড়িয়ে শিখে নিই
কীভাবে লিখতে হয় শোকগাঁথা আমাদের পিতৃভূমির জন্য
সেই থেকে লায়ারে (বাদ্যযন্ত্র) তুলছি যৌথ-বেদনার সুর
          যন্ত্রণার চূড়ায় আমরা গেয়ে চলেছি জীবন-সঙ্গীত―
                    পাল্টে দিতে চাঁদ আর পাথরের দেয়ালচিত্র
কিন্তু আমি ভুলে গেছি অজানা সেই কণ্ঠস্বর
এটি কী তোমার প্রস্থান ছিল, নাকি আমার নীরবতা!

গতকাল তোমাকে আমি বন্দরে দেখেছি―
সঙ্গে লাগেজ ছিল না, প্রস্তুতিহীন একাকী এক দীর্ঘভ্রমণ
এতিমের মতো আমি তোমার কাছে ছুটে গেলাম,
আমাদের পূর্বপুরুষের প্রজ্ঞা থেকে উত্তরের প্রতীক্ষায়:
কিভাবে চিরসজ্জিত কমলা গাছটি উপড়ে ফেলা যায়
বন্দরে, জেলখানায়, নির্বাসনে―
                                 এবং তার সমস্ত ভ্রমণ সত্ত্বেও
লবণের গন্ধ এবং আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও থাকবে চিরসবুজ
আমি আমার ডায়েরিতে লিখেছি:
আমি কমলা ভালবাসি এবং বন্দরকে ঘৃণা করি
আমি আরও লিখেছি:
ডকে দাঁড়িয়েছিলাম, নিঃস্ব চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখেছিলাম
আমাদের জন্য রইলো শুধুই কমলার খোসা,
                                             আর পিছনে ধুধু মরুভূমি।

দুর্গম পাহাড়ে আমি তোমাকে দেখেছি,
যেন ভেড়াবিহীন এক মেষপালক
ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আমার চোখ অনুসরণ করলো তোমাকে
তুমি ছিলে আমার সবুজ উদ্যান,
আর আমি একজন অচেনা মানুষ―
তোমার দরজায় কড়া নেড়েছি, আমার প্রিয়তমা
আমার অন্তরে ঝঙ্কৃত হচ্ছিল একটিই শব্দ ‘তুমি’
দরজা-জানালা, সিমেন্ট আর পাথরে কম্পন তুলেছিল

আমি তোমাকে দেখেছি পানির পাত্রে, শস্যভাণ্ডারে
নাইট ক্লাবে তোমাকে দেখেছি আমি মেছিয়ার হয়ে...
তোমাকে অশ্রুর ঝলকানিতে ও বেদনায় দেখেছি
তুমি আমার বুকের অন্য ফুসফুস;
                        তুমি আমার ঠোঁটের আওয়াজ
আমার দয়িতা—  তুমি আগুন, তুমিই পানি।

তোমাকে দেখেছি গুহার মুখে, কখনো গুহার ভিতরে
স্নানের স্থানে ছেঁড়া ন্যাকড়ায়
দেখেছি উনুনে, রাস্তায় পাশে
প্রখর রৌদ্রে, দুঃখের বিলাপে
এতিম ও হতভাগ্যদের গানে আমি তোমাকে দেখেছি
তোমাকে দেখেছি আমি সমুদ্রলবণে এবং বালিয়াড়িতে
তবুও তোমার চেহারায় ছিল পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য,
শিশুমুখের সরলতা এবং আরবীয় জেসমিনের সৌন্দর্য।

এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছি―
চোখের পলকে একটি রুমালে
তোমার চোখে সূঁচিকর্মে সাজিয়ে দেব হৃদয়ের আয়াত
তোমার নাম আমার হৃদয়ে তসবির দানায় জপতে থাকবো
আমি মধু এবং চুম্বনের চেয়েও মূল্যবান একটি পঙক্তি লিখব:
                   ‘ফিলিস্তিনে তুমি ছিলে এবং এখনও আছ`।

ঝড়ের রাতে আমি দরজা ও জানালা খুলে দিলাম
অদৃশ্য এক চাঁদকে কল্পনা করে―
আমি রাতকে বললাম― দৌড়াও, পালাও
অন্ধকার এবং উঁচু-উঁচু দেয়াল ছাড়িয়ে দূরে কোথাও;
শব্দ ও আলোকে দেওয়া আমার এক প্রতিজ্ঞা ছিল
তুমি আমার কুমারী উদ্যান, শস্যের মতো বিশ্বস্ত
যতদিন আমাদের গান―
জিইয়ে রাখবে মাটির ঊর্বরতা, যেখানে রোপণ করেছি স্বপ্ন
আমার মনে তুমি খেজুর গাছের মতো:
ঝড়, কাঠুরিয়ার কুড়াল কিছুই আঘাত করতে পারবে না।
এর শাখা এখনো কেটে ফেলা হয়নি
            মরুভূমি ও জঙ্গলের হিংস্র পশুদের দ্বারা
দেয়াল ও দরজার আড়ালে আমি নির্বাসিত…

প্রিয়তমা, তোমার দৃষ্টির উষ্ণতায় আমাকে আশ্রয় দাও।
তুমি যেখানেই যাও― আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও
তুমি যেভাবেই থাকো না কেন, আমাকে নিয়ে চল
তোমার দেহ ও হৃদয়ের উষ্ণতায় রাখো আমাকে
হৃদয় ও চোখের আলোতে,
রুটির লবণে আর হৃদয়-সঙ্গীতে,
সমস্ত জাহান আর মাতৃভূমির স্বাদে―
তোমার দৃষ্টির উষ্ণতায় আমাকে আশ্রয় দাও,
দুঃখের কুঁড়েঘরে, বাদাম কাঠের ছায়ায় আমাকে নিয়ে যাও
আমাকে নিয়ে যাও, কষ্ট-বইয়ের একটি আয়াত থেকে
বাড়ি থেকে সঙ্গে নিও একটা খেলনা বা পাথর
যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্মরণ করতে পারে
                         আমাদের বাড়ি ফেরার পথ।

আমার দয়িতার চোখ ও হাতের ট্যাটু ফিলিস্তিনীয়,
তার নাম ফিলিস্তিনীয়,
তার স্বপ্ন, এবং দুঃখ, ফিলিস্তিনীয়,
তার মাথার স্কার্ফ, তার পা এবং শরীর ফিলিস্তিনীয়
তার কথা এবং তার নীরবতা ফিলিস্তিনীয়
তার কণ্ঠ ফিলিস্তিনীয়
তার জন্ম ও মৃত্যু ফিলিস্তিনীয়
আমি তোমাকে আমার পুরানো নোটবুকে...
যেন আমার কবিতার আয়াতসমূহের আগুন
আমার ভ্রমণ যাত্রার রাহা-খরচ...
তোমার নামে উপত্যকায় আমার কণ্ঠ বেজে উঠল:
আমি শুনছি বাইজান্টিয়ামের ঘোড়ার খুরধ্বনি
যদিও এই যুদ্ধটা আমাদের মরণ কামড়
                                সাবধান, ওহে বন্ধু, সাবধান!

গ্রানাইটে আমার কণ্ঠ বজ্রাঘাত হানে―
তোমাদের জন্য আমি গেয়ে যাচ্ছি অবিনাশী গান
আমি তারুণ্যের গোলাপ ও নাইটদের নাইট!
আমি অচলায়তনের ধ্বংসকারী।
আমি কবিতায় লেভান্টাইন সীমানা নির্ধারণ করছি
যা ঈগলকে মুক্ত করে দিচ্ছে, মুক্ত আকাশে ডানা মেলছে
আর তোমার নামে আমি―
শত্রুর বিরুদ্ধে চিৎকার করে বলছি:
যদি কখনো আমি ঘুমিয়ে পড়ি, বিচ্যুত হই শপথ থেকে
কীটপতঙ্গ দিয়ে খাইয়ে দিও আমার মাংস
কারণ পিঁপড়ার ডিম কখনো ঈগল জন্ম দিতে পারে না
এবং সাপের ডিম ফুটে জন্ম নেয় বিষধর এক সাপ!
আমি বাইজান্টিয়ামের ঘোড়া দেখেছি―
ওই শুনতে পাচ্ছি দখলদারদের ঘোড়ার পায়ের শব্দ
এবং সবকিছুর পরও আমি নিশ্চিত জানি, বিজয় আসন্ন
আমিই যৌবনের প্রতীক এবং নাইটদের নাইট!