ফারুক ইমনের গল্প ‘নীল তিমি’
প্রকাশিত : এপ্রিল ০৬, ২০২৩
চারতলা ফ্ল্যাট বাড়িটার তৃতীয় ফ্ল্যাটের পুরোটা একটা মেসবাড়। বাকি তিন ফ্ল্যাটে বাড়ির মালিক ও কয়েকটা পরিবার থাকে। রাজধানী ঢাকায় এরকম ফ্ল্যাটবাড়ি আছে অনেক। যে গল্পটা লিখছি সেটা মেসবাড়িটার বোর্ডারদের গল্প। শীতের শুরু নভেম্বরের শেষের সকালগুলো খুব শান্ত এই এলাকায়। ভোর ছয়টা ত্রিশ বাজে ঘড়িতে, নিচের কলাপ্সিবাল গেট খোলার শব্দ তিন তলা থেকেও শোনা যায় স্পষ্ট। মেসবাড়ির বুয়া এ সময় গেট খুলে প্রতিদিন, তিনতলায় উঠে এসে সকালের নাস্তার আয়োজন করে।
২৫ জন মানুষের খাবার রোজ তার হাত দিয়েই তৈরি হয়। খাবার নিয়ে শত অভিযোগ থাকে রোজ মেসের বোর্ডারদের। তবুও তার হাতে তৈরি খাবার গলাধকরণ করেই প্রাণগুলো তাদের জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যায় এই নগরযজ্ঞে।
মেসের বোর্ডারের নাম নেই এই গল্পে। তাকে সবাই বুয়া বলে ডাকে। বুয়ার শরীরটা আজ ভালো নেই। গা বেশ গরম। গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি। জ্বর শরীর নিয়েই গতরাতের এঁটো থালাবাটি ধোয়ার জন্য পানির কল চালু করল সে। কল দিয়ে পানির বদলে বেরিয়ে এলো কালো কাদার মতো এক ধরনের তরল। ঢাকা শহরের পানি সাপ্লাইয়ে এটা স্বাভাবিক ঘটনা।
বুয়া কল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো ভালো পানির জন্য। এই রান্না ঘরটায় বসার কোনো জায়গা নেই। মেঝেতেও মালপত্রের কারণে শুধু দাঁড়ানোর জায়গাটুকু আছে। পানি এলো প্রায় তিরিশ মিনিট পর। সকালের রান্না শুরু হতেও দেরি হলো আজ।
সাড়ে সাতটা নাগাদ খাবার প্রস্তুত করে বুয়া নিজের বাসায় যায়। কিন্তু আজ সঠিক সময়ে রান্না শুরু না হওয়াতে মেসের অনেকেই খাবারের জন্য অপেক্ষা না করে বাইরে খেয়ে নেওয়াটাই সহজ মনে করল। কারণ ঠিক সময়ে বের না হলে সময়মতো অফিসে পৌছানো সম্ভবপর হয় না। রাস্তায় অনির্ধারিত জ্যামের কারণে প্রায়ই ভোগান্তি পোহাতে নয় এই নগরের বাসিন্দাদের।
ইমরান পড়ে এখানকার একটা কলেজে। তিন মাস হলো উঠেছে এই মেসবাড়িটায়। ওর বয়সের আর কেউই থাকে না এই মেসে। বাকিরা অফিসে চাকুরে। কলেজ কাছে হওয়ায় আর মেসের ম্যানেজার নিজ এলাকার হওয়ায় সে এখানে থাকে। প্রায়ই ক্লাস শেষে বাড়িটায় যখন সে আসে। তখন চারদিক শুনশান-নীরব। সন্ধ্যা নাগাদ সবাই ফেরে। কারো কারো আরও দেরি হয়। দু’একজন আবার বিকেলেই ফেরে। যাদের অফিসের দূরত্ব অপেক্ষাকৃত অল্প।
আজ দুটা ক্লাস হয়েছে। বাসায় এসে দেখে, প্রতিদিনের মতোই বাসা ফাঁকা। শুধু বুয়া রান্নাঘরে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। মেসবাড়িটার পেছনের বারান্দার রেলিঙের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ইমরান ফস করে একটা সিগারেট জ্বালালো। আরেক হাতে পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বের করে ওয়াইফাই কানেক্ট করে গতরাতের দেওয়া স্ট্যাটাসের আপডেট দেখতে ফেসবুক লগ ইন করল।
ছয় মাস পরের কথা। লোকজন যার যার কর্মে ব্যস্ত। শহুরে কোলাহলের মধ্যেও অনেক উঁচু থেকে বস্তা পড়ার মতো চাপা একটা আওয়াজ লোকজনকে সচকিত করল। চারতলা মেসবাড়িটার নিচে ধীরে ধীরে জড়ো হলো একটা জটালা। ইমারানের থেঁতলানো মাথা থেকে রক্তের ধারা পিচের কালো রস্তায় একেবেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢালুর দিকে। তার ফর্সা হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে আঁকানো একটা নীল তিমির ছবি।