ফারুক ইমনের গল্প ‘আমিন মিয়ার ভাতের হোটেল’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২১
গভীর রাত। চানখার পুলের রাস্তায় কয়েকটা কুকুর শুয়ে আছে। দূরে কোথাও দু’একটা গুলি ফোটার আওয়াজ শোনা গেল। রাস্তার কুকুরগুলো হঠাৎ সচকিত হয়ে শুরু করে দিল ত্রাহি ডাক।
ঢাকার অল্পকিছু কুকুর এখনও জীবিত। তাই বলতে হবে, এই কুকুরগুলো এখনও ভাগ্যবান। যুদ্ধের পুরো সময়টা যখন খাবারের খুব আকাল, তখন আমিন মিয়া তাদের প্রতিদিন একবেলা করে খাবার দিয়েছে। পাশেই আমিন মিয়ার খুপড়ি চালা।
সারা দেশে যুদ্ধ। মানুষের প্রাণ এখন হাতের মুঠোয়। চারদিকে মৃত্যুর নিনাদ। ঢাকায় যারা রয়েছে, এসময়ে বাইরেরও তারা বের হয় না। খুব দরকার পড়লে সাবধানে পথে নামে। সারা দিন ট্রাকে করে টহল দিচ্ছে আর্মি। ট্রাকের ভয় জাগানিয়া শব্দ ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য শব্দ নেই।
আমিন মিয়ার ভাতের হোটেলে খদ্দের না থাকলেও ঢাকা ছাড়ার কথা একবারও তার মনে হয়নি। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। স্বজন বলতেও তেমন কেউ নেই। তার ভাতের হোটেলের কারণেই এলাকায় সে বেশ পরিচিত।
যুদ্ধের আগে আমিন মিয়ার হোটেল বললে সবাই একনামে চিনত। রিকশাঅলা কিম্বা মজুরদের তিনবেলা ভিড় লেগে থাকত তার হোটেলটায়।
আমিন মিয়া তার ষাটোর্ধ্ব দেহটা নিয়ে হঠাৎ নির্জন হয়ে ওঠা চানখারপুলের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে বেড়ায়। দু’একবার আর্মির টহল-জিপ তাকে আটকায়। জেরা শেষে আবার ছেড়েও দ্যায়।
শাঁখারি বাজারে হিন্দুদের পোড়া বাড়িগুলোর দিকে সে চেয়ে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে গোলাপ শাহ’র মাজারের সামনে আসে। মাজারের রেলিংয়ের ভেতর মানুষের দান-সদকার সিকিটা-আধুলিটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার ওপর জমেছে ধুলো-বালির আস্তরণ। ঝালরগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। এসব পরিষ্কার করার কেউ নেই।
অন্য সময়ে এখানে সবসময়ে ভিড় লেগে থাকত। ধুপধুনোর গন্ধে ম ম করত পুরো এলাকা। এখন চারদিক ফাঁকা। ডিসেম্বরের কড়া রোদে একটা ভৌতিক পরিবেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপ শাহের স্মৃতি।
কুকুরের ডাক ছাপিয়ে একটা আর্মির ট্রাক ঘড়ঘড় করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল এলাকার দিকে। পেছনে আরও কয়েকটা জিপ ও ট্রাক। থমথমে মুখে আর্মির জোয়ানরা বসে আছে ট্রাকের মধ্যে। ককুরগুলো ট্রাক লক্ষ্য করে ঘেও ঘেও শব্দে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
তখনও কেউ জানে না, ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে পালন করতে হবে পরম মমতা গাথায়। তখনো কেউ জানে না, একটা কাপুরুষ হত্যাযজ্ঞের আয়োজন চলছে পূর্ব বাঙলার প্রাণকেন্দ্রে।