ফারুক আহমেদ
ফারুক আহমেদের ছয়টি কবিতা
প্রকাশিত : আগস্ট ০৮, ২০২১
তোমার আমার ভ্রমণ
তোমার সঙ্গে আমার যে ভ্রমণ
তা কি পৃথিবীর আলো-বাতাসে বড় হওয়া কোনো গিটার!
স্পর্শ লাগলেই সুর ওঠে। স্পর্শ না লাগলে
অগণন সুরের ভাণ্ডার নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে।
তোমার সঙ্গে আমার যে ভ্রমণ
তাতে পা বাড়ালে বৃষ্টি ফোটে, ফুল কথা বলে
পা না বাড়ালে মর্ত্যসুধা চুপচাপ পড়ে থাকে চারদিক।
মনে হয়, গেলেই ওরা করতালিতে ফোটাবে অধর
মনে হয়, সন্ধ্যার গান লতিয়ে উঠবে শহরময়।
ছোট ছোট নদীগুলোর যখন দেখা হয়
ছোট ছোট হাওয়াদের যখন দেখা হয়
আবার বড় বড় নদীগুলোর যখন দেখা হয়
বড় বড় হাওয়াদের যখন দেখা হয়...
ওরা কীভাবে পাপড়ি মেলে জানায় চরাচর।
তোমার সঙ্গে আমার যে ভ্রমণ
তা কি ভূগর্ভে বয়ে যাওয়া কোনো জলধারা;
বয়ে যাচ্ছে, বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর
বধির দিনগুলো তা টের পাচ্ছে না!
মালা ও মুকুট
মোড় পেরুতে গিয়ে একটি কোলাহল মুকুটের মতো এলো
মোড়েই একটি কোলাহল গলায় ঝুলে পড়লো মালা হয়ে।
এ শহরে এসে পেয়ে যাই একটি কোলাহলের মালা ও মুকুট।
বাল্যশিক্ষার মতো বগলে থাকা সবুজ প্রান্তর খসে পড়ে
গোল্লাছুটের মতো ভাইবোনেরা পেরিয়ে যায় কৈশোরের সীমা,
মফস্বল শহর দূরে দাঁড়িয়ে থাকে একটা নদী কোলে নিয়ে।
আমরা আর কিছু মনে করতে পারি না, ম্লান আলোর সন্ধ্যা
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে কৈশোর,
আমরা হেঁটে হেঁটে কোলাহলের বাড়িতে এসে পৌঁছাই।
এখানে মায়া বৃদ্ধ মায়ের মতো দূরে থাকে, দূরে চলে যায়
এখানে মায়া গরিব আত্মীয়ের মতো উঁকিঝুঁকি মারে
ঘরে আসে না, ঘরে আসার কথা বলা হয় না কখনো।
কোলাহলে গাঁথা হয় অনবরত আসতে থাকা জীবনের ঘ্রাণ
জীবন মাড়াই হয়ে তার যে নির্যাস, জীবন কচলে যে স্বপ্ন,
জীবন সরোবর তৈরি হয় নানা দিক থেকে আসা দিনগুলো দিয়ে।
কোলাহলের মুকুট আমাকে খেয়ে ফেলে মনোহর আনন্দে
যেভাবে সন্ধ্যায় একটি গাছ খায় অনেকগুলো পাখিকে;
যেভাবে একটি চুমু খেয়ে ফেলে বেদনার বুদ্বুদকে।
মোড় পেরুতে গিয়ে একটি কোলাহল মুকুটের মতো এলো
মোড়েই একটি কোলাহল গলায় ঝুলে পড়লো মালা হয়ে।
এ শহর এভাবে একটি মুকুট ও মালায় আমাকে ফেলল খেয়ে।
শহর একটি মায়া
সে চলে যাচ্ছে
চলে যাচ্ছে ঢালু উপত্যকার পথ বেয়ে একা
মেশিনে সকালকে সে সন্ধ্যার সঙ্গে সেলাই করতো,
সে দিনভর অনেক রঙ মাথা গুঁজে সেলাই করতো;
সাইকেলের পেছনে একটি গানকে বসিয়ে পৌঁছে
দিত তোমাদের দরজায়।
সে কাপের পর কাপ আনন্দ বানিয়ে হাতে তুলে দিত;
আর চোখজোড়া ভরে থাকত এক দূর গ্রামের ছায়ায়।
উপত্যকার ভাঁজে যে পথ, সে পথ ধরে সে চলে যাচ্ছে।
এ শহরে মাইলের পর মাইল বৃষ্টি হেঁটে সে যাবে
তার প্রেমিকার কাছে, কথার পুডিং নিয়ে
একটা মুহূর্ত ভাগাভাগি করে খাবে বলে;
অথচ তাকে চলে যেতে হচ্ছে উপত্যকা ধরে।
সে জ্যোৎস্না কেটে কেটে বানাতো সরোবর
প্রেমিকযুগল যেত যেখানে প্রগলভতায় ভেসে।
সে রিকশা ভরে পৌঁছে দিত লাল-নীল শব্দের তোড়া
তোমরা তা পেয়ে সাজাতে প্রেমিকাকে।
সে শেখাতো কীভাবে অরণ্যকে বিলি কেটে
ঢুকে পড়তে হয় গহিনে, স্যাঁতসেঁতে পাতার
নিচে কীভাবে একটি প্রজাপতির বর্ণিলতা
দেয় বেঁচে থাকার রসদ।
শহরের ক্রোধ চেপে ধরে তার হাতে ঘা হয়েছে
তোমাদের আরাম সেলাই করতে করতে তার
হাত দুটা মরা নদীর মতো পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
তোমাদের যৌনতার দংশনে সে তার সংসারকে
বেহুলার ভেলার মতো ভাসিয়ে দিয়েছে জলে;
তার হাতে ঘা, তার চোখে গুমোট চাহনি
সে একটি হাবসি ক্রীতদাসের মতো দূরে দাঁড়িয়ে
অপেক্ষা করে করে ক্ষুধা, বিষাদ পকেটে নিয়ে
আস্তে আস্তে উপত্যকার পথে রওনা হয়ে গেল।
যেতে যেতে পথে ফুলের সঙ্গে পাখির সঙ্গে
বাতাসের সঙ্গে বলে গেল, তার সেলাইয়ের গল্প।
সে পৌঁছে দিত বাবার হাতে সন্তানের যে আহ্লাদ;
ঘষে ঘষে সকাল পরিষ্কার করে দেওয়ার যে স্মৃতি;
তাও বলে বলে গুমোট একজোড়া চোখ নিয়ে
চলে যাচ্ছে, বিষাদ মুখ, অভিযোগ নেই তবু।
কিন্তু দেখো বাতাস জেনে গেল
ফুল জেনে গেল, পাখি জেনে গেল।
এই শহর একটি ভোগের থালা নিয়ে বসে আছে;
তারপর আর কিছু নাই, মায়া, প্রেম কিছু নাই।
এই শহর যত বড়, তার দেহখানিও তত বড়;
শুধু হৃদয় শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়া শহরের খাল।
সে চলে যাচ্ছে উপত্যকার পথ বেয়ে একা;
থাকছে শহরের পিঠজুড়ে বসে থাকা দালান
শহরের পিঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়া পথের নদী;
ক্যাফে, ফুটপাত, থাকছে লোভের ঢেউ;
সে চলে যাচ্ছে ঢালু উপত্যকার পথ বেয়ে একা।
আমরা ক্রিট, ব্যাবিলন, পেত্রা এমন নগরের কথা জানি
হয়তো পিঠভরা দালান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
এ শহর লোভের থালায় স্থূলতার ভাগাড় নিয়ে বসে থাকবে।
দুই.
সমুদ্রকে ডেকে আনো
হাতে গোলাপ ধরিয়ে বলো পাশে বসতে;
নিসর্গকে ডেকে আনো;
বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই ধরিয়ে বলো পাশে বসতে।
বকুল ফুলকে ডেকে আনো
হাতে ধরিয়ে দাও মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’।
মাধবীলতাকে ডেকে এনে বলো
‘ছিন্নপত্র’ গাইতে, যেন নদী, যেন গ্রাম, যেন মায়া।
তারপর শহরকে ডাকো, বলো মুখোমুখি বসতে;
সে বসে আবৃত্তি করুক জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’,
তার বুকে বুলেটের মতো বিঁধে যাক শব্দ, উপমা;
সে একটি গলিত মোমের মতো একাকার হয়ে
কান্নায় ভেঙে পড়ুক, কান্নার মাতমে অভাবনীয়
এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হোক, যাতে অংশ নেবে
ফুল পাখি মানুষ—সর্বোপরি পৃথিবীর সন্তানেরা।
বাষ্পরুদ্ধ দু’চোখে কেঁদে কেঁদে চলে যাওয়া
পৃথিবীর সন্তানদের মুখ মনে করে শহর এক
আশ্চর্য অনুশোচনায় সেজদা দিয়ে পড়ে থাকুক।
তারপর উঠে লাইনে দাঁড়াক
হারিয়ে যাওয়া অবয়বকে ফিরিয়ে আনতে।
যে মুখ হারিয়ে ফেলেছে শহর;
যে শহর অবয়বহীন একটি শরীর নিয়ে
দিন কাটাচ্ছে ভাগাড়, বিষ্ঠা, লোভ আর স্বার্থপরতায়,
তার তলপেটে নিসর্গের উপমা ঢুকিয়ে দাও,
তার স্কুলে স্কুলে পাঠাও কোমলমতী নদীগুলোকে,
তাকে বলো রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত হতে...
তাকে বলো সুলতানে মাথা নত করে পড়ে থাকতে।
এভাবে তাকে নিসর্গে, কবিতায়, চিত্রকলায়
খুন করো, সে খুন হোক, ভেঙে পড়ুক, তছনছ হোক
তারপর একটু একটু করে দাঁড়াক, একটু একটু করে
বুঝুক, কেন কবিকে স্যালুট করবে, কেন শিল্পীর হাতে
চুমু দিয়ে সকাল শুরু করতে হবে।
এভাবে সে ঠিক জেনে যাবে
একটা সুর কীভাবে তাকে পৃথিবীর করে দেবে;
কীভাবে জ্ঞান তাকে মানবিক হওয়া শেখাবে।
কীভাবে পিঠজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালান
একেকটি মায়ার জংশন হয়ে উঠবে।
তিন.
শহরকে ভেঙে পড়তে দিতে হবে;
তাতে নিসর্গের ছুরি তার তলপেটে ঢুকে
একটি মোহময় মৃত্যু এবং জেগে
ওঠার স্তবক রচনা করবে, তার নিয়তিতে।
শহরকে আমরা ভালোবাসি
শহরকে আমরা তীব্রভাবে ঘৃণা করি
শহর একটি মায়া, শহর একটি খুনির হাত
শহর কফিশপে চুমুক দিতে দিতে
হাজার হাজার সন্ধ্যাকে হত্যা করে;
শহর একটি ক্ষুধার্ত শিশুকে ফুটপাতে বসিয়ে
যৌন সুড়সুড়ি পেতে চলে যায় ক্ষমতার পকেটে।
আর শিশুটি, আর শিশুটি... বাষ্পরুদ্ধ, ঝাপসা...
শহরের তলপেটে আস্ত একটি নদী ঢুকিয়ে দাও
শহরের তলপেটে ঢুকিয়ে দাও বিত্তহীন মায়াময়
একটি সংসার।
শহর দেখুক প্রেম কী, শহর দেখুক
মানুষ আসলে কংক্রিট আর মেশিন না।
মানুষ আসলে ভালোবাসার একটি রত্ন ভাণ্ডার
মানুষ আসলে ভালোবাসায় তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখ।
শহরকে শেষ পর্যন্ত আমরা ভালোবাসি
শহর এই দীর্ঘ অসুখ এবং খুনের শুশ্রুষা পেয়ে
ফিরে আসুক, কান্নায় ভেঙে পড়ে বলুক—
ফুটপাতের শিশুটি আমার মা
শিশুটির মাও আমার মা...
ক্যামেরা আসছে
একসঙ্গে জড়ো হও— শিশির, বিহঙ্গ, ঢেউ, ফুল
একসঙ্গে জড়ো হও— হাসি, সংগীত, কথাবকুল।
ক্যামেরা আসছে, রাজহংসীর মতো ক্যামেরা আসে
একটি রক্তাক্ত পথ, কেঁপে ওঠে লেন্সের বাতাসে।
তেমনটা কেন বলো? পৃথিবী তো শান্তির দোকান
যেখানে বিহ্বল বর্ষা, আছে কাঁটা-কুসুমের গান;
জোছনাফুল, মুহূর্তবন, আর তার গাঢ়তর
তীব্র হয়ে ওঠা, দেহমুহূর্তে জাগা নারী ও নর
এইসব ছবি ধরা পড়বে লেন্স, সবুজ লেন্সে
তোমার ক্যামেরায়।
একসঙ্গে জড়ো হও— শিশির, বিহঙ্গ, ঢেউ, ফুল
একসঙ্গে জড়ো হও— হাসি, সংগীত, কথাবকুল।
ক্যামেরা আসছে।
কালের রেদা
ধরো একখানা সাঁকো, ধরো দুই দিকে দুই কাল
বলো জীবন থামাবে কীভাবে, যথা গতিই সব
একদিকে তুমি জাগো, একদিকে বিষণ্ণ নীরব;
ধরো একই সংগ্রাম, রক্তজবা হতে হতে লাল
একে একাত্তর, অন্য পাশে দু’হাজার তেরো সাল।
কামনার মতো ফোটে, ভোগের মতো হয় প্রসব
যাকে বলা হচ্ছে দিন, তা হলো গিয়ে আলোর শব
আঙুলের ইশারায় আমরা সব শুয়োরের পাল।
কালের রেদাটানছে, বলি আশা অবশ্যই আছে
পলাতক এক পট, আমাদের ভেতর পটুয়া
ভোগের ভেতর খুন হলেও রেখায় ওঠে বেঁচে,
হয় টর্নেডো যখন মিলে হাওয়া আর হাওয়া।
জমছে আলখেল্লার মতো মেঘ, জমছে হিসাব
জমে গেছে আমাদের অনেক বিষ্ঠা আর প্রস্রাব।
সংগীত
তোমার থেকে আমার দূরত্ব তিন বছর
ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দাও, ফুটুক পুষ্পনহর।
চৈত্র এলে কৃষকের রেখাগুলো ফাটামাঠ
তোমার জমিন, হাসি, স্পর্শ— বিস্ময়বিরাট;
প্রেম-বসন্ত-অনন্ত ইঁদুরদৌড়ের ক্ষুধা
এর থেকে ঢেউয়ের ফুল, তার বেশি সুধা।
বসন্তের ফুলগুলো, চিরল কথা তোমার
এমন পুষ্পের দলে ভরে আছে পারাপার,
তাতে ফুটে নানা স্বর, ঘটনা, তাল, আকুতি
জীবন একটি ঢেউ, জীবন একটি স্মৃতি।
নগ্ন সকালের মতো লাল জরির পালক
সেখানে আমি কেউ না, এক নাদান বালক।