ফরিদ সুমন
ফরিদ সুমনের ছয়টি কবিতা
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২০
লোকটা পরিব্রাজক হতে পারে
এই যে, যাকে আপনারা এখানে বসিয়ে রেখে গেছেন
সে এখানকার নয়।
অত্র রাজ্যের কোনো বালামে তার নাম-সাকিন পাওয়া যায়নি।
নতমস্তকে বসে থাকা লোকটা দাবিও তুলেছে অদ্ভুত এক;
তার নাকি বুকের ভেতর জেগে আছে রাজার হৃদয়! কী পরিহাস!
নুলো ভিখিরির পোশাকে মৃত আগ্নেয়গিরির খুঁটিনাটি আঁকা আছে তাই
পরিব্রাজক ভাবা যেতে পারে লোকটাকে। তার কপালের শ্রান্ত রেখায়
অজস্র মৃত নদী, বেশুমার বনভূমি আর আহত পাখিদের নাম।
প্রখর কাঁধের দিকে চোখ ফেরালে আপনারা সহজেই দেখতে পাবেন
জলাশয়, নগর এবং প্রত্নসম্পদের দায়ে বন্দরের প্রাচীরে জমে থাকা
সভ্যতার রক্তনিশান। লোকটার বেয়াড়া বয়ান, কিছুই যায় না বোঝা
তাই চলুন তাকে পরিব্রাজক ধরে নিয়ে বাকি কথাটুকু বলি;
অবধারিত মৃত্যুদণ্ড জেনেও কোনোপ্রকার মুক্তির আকুতি ছাড়া
লোকটা শুধুই ধোঁয়া-ওঠা ভাত খেতে চাইছে
আর শুকনো ঠোঁটের খরা ও মহামারি দেখিয়ে বলছে—
আমি ক্ষুধা, জরা ও মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছিলাম।
যুদ্ধ-টুদ্ধ গোল্লায় যাক
এই যে তোমার পায়ের
লাজরাঙা এই আভাটুকুই
আমাকে ঋদ্ধ করেছে;
করেছে পুরুষ এবং যোদ্ধা।
নূপুরলতার পুষ্পশোভায়
ঠোঁট রাখলেই হয়ে উঠি
রঙ ঝিলমিল;
উড়নচণ্ডি প্রজাপতি।
আজকে না-হয় পিঠের ওপর
দীঘল চুলের রূপকথাটা মেলে দিও
যুদ্ধ-টুদ্ধ গোল্লায় যাক;
এবার আমি কবি হবো।
চন্দ্রিমার আয়তন
একেকটি বিস্মিত রাত
কতখানি চন্দ্রিমা ধরে রাখে;
ভেবে ভেবে জোছনা ফুরালো আমার
কেটে গেল অথৈ বর্ষামাস।
স্বনামে চিঠিও লিখেছি তারার কাছে
কোথা থেকে কোথা গেল সেই মৃদু জিজ্ঞাসা
পথঘাট ভুলে সেও কি বিবাগী নাকি?
তুরুপের শেষ তাস চলে গেছে হাত ছেড়ে
প্রতীক্ষাস্নাত চোখেরা তবুও পলক ফেলে না।
নিশিরাতে আকুল হলে মনের ময়না
আবছায়া পাহাড়ের কোলের কাছে
কুয়াশামগ্ন বালিশে আমারও ঘুম আসে না।
জোছনার বনে সাপ
আমি সজ্ঞানে একটা স্বপ্ন দেখেছি কাল
ওটা কি স্বপ্ন ছিল?
বুঝিবা মাটির টানে নতমুখী ঝুরির ভিড়ে
এ আমার নিশীথের অনুতাপ।
প্রকাণ্ড বটের বয়েসী ছায়ার নিচে
কোত্থাও তুমি নেই
ঘুমহীন জোছনার বনে নারী থাকে না
সাপ থাকে, সাপ।
আর—
পূর্ণিমা রাতে মুদ্রাহীন জেগে থাকতে থাকতে
তন্দ্রাব্যাকুল শিশিরের কণাগুলো হয়ে যায়
বিষের নহর।
যে মেঘ কথা রাখেনি
আমি এখন
কিছুই লুকোতে পারি না আর।
রৌদ্রোজ্জ্বল ত্বকে সময়ের রেখা
চোখের গহীনে পোড়া ঘ্রাণ
বুকপকেটের ভেতর ভাঁজ করা নদী;
এইসব গোপন বিষয়-আশয়
সবই খালি চোখে দেখা যায়।
দেখা যায় সামান্য মনোযোগে
হাতের রেখায় আঁকা ব্যাকুল ফাগুন।
এত যে খোলাখুলি মহুয়ার বন
কপালজুড়ে এত দৃশ্যমান জ্বর
চোখে মুখে রাজ্যের ধুলো-বালি-ছাই।
আজকের আহত ভোরে বৃষ্টির শুশ্রুষা হয়ে
যে মেঘের আসার কথা ছিল—
কই, সেও তো আসে নাই।
প্রাচীরবন্দি গোলাপ
আমি চলে যাব বললেই বৃষ্টি আসে
কাজলদিঘির কূল ছাপিয়ে
গীতিকবিতার মতো নামে জলের ধারা।
আমার বুক ভিজে যায়, ডোবে কাঁধের সবুজ;
এক অনিঃশেষ অগ্নিশিখায় পুড়ে ক্ষয় হয়
এই পরিপাটি-নিরিবিলি মাটির হৃদয়।
আমি পথের দিকে তাকালে
মর্মাহত নদীর মতো বাজে ঠোঁটের কল্লোল;
নিশ্বাসের উতলা হরিণ
কবিতার ওম খোঁজে ব্যথিত কাশের বনে।
চলে যাওয়াতে এমনই মরণ যদি
মনের মুনিয়া হয় এমনই অধীর;
থাকতে চাইলে কেন জেগে ওঠে
গোলাপ আড়াল করা রেশমপ্রাচীর?