ফরাসি তত্ত্বকথা: দুর্বোধ্যবাদের সন্ত্রাসবাদ
আহমেদ শামীমপ্রকাশিত : আগস্ট ২৩, ২০১৮
দার্শনিক বিভাগ ও বিবাদের প্রকৃতি
একটা বিচারে পাশ্চাত্য দর্শন মোটাদাগে কন্টিনেন্টাল এবং এনালেটিক্যাল এই দুইভাবে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে একটা বেখাপ্পা বিষয় হলো, কন্টিনেন্টাল বলতে ইউরোপে চর্চিত দর্শনকে বোঝানো হয়, আর কনসেপ্টকে বিশ্লেষণপূর্বক যে দর্শন চর্চা তাকে এনালেটিক্যাল ফিলসফি বলা হয়। তাহলে ভাগটার প্রতিসাম্য কোথায় রক্ষা হলো? আসলে নর্থ আমেরিকায় এনালেটিক্যাল ফিলসফির চর্চা বেশি হয়, তাই ভূগোল বিচারে বিভেদটার একটা গতি হলো। তো, ইউরোপের দর্শন চর্চায় কনসেপ্টকে বিশ্লেষণ করার চর্চা নেই? আছে, কিন্তু ইউরোপীয় দর্শনের চরিত্র নির্মিত হয়েছে ফেনোমেনালজি এবং অস্তিত্ববাদী দর্শন চর্চা দিয়ে। আমেরিকাতেও ফেনোমেনালজি এবং অস্তিত্ববাদী দর্শন চর্চা চলে কিন্তু সেটা মূলধারা নয়। তো এই দুপক্ষের মধ্যে কিছু তিক্ততা আছে, বিশেষ করে ফরাসি উত্তরাধুনিকতাবাদ যাদের লেখা থেকে উঠে এসেছে (মূলত লাকা, ফুকো, দেরিদা) তাদের সঙ্গে আমেরিকার এনালেটিক্যাল চিন্তকদের (সার্ল, চমস্কি, সওকাল) তিক্ততা নিমকেও ছাড়িয়ে গেছে কোথাও কোথাও। সেখান থেকে এখানে কিছু তুলে ধরব আজ।
সার্লের কাছে ফুকোর স্বীকার: ইচ্ছে করে প্যাঁচাই
আমেরিকান ফিলোসফার জন সার্ল একবার মিশেল ফুকোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা ঠিক ঠিক বলতো তুমি এতো বাজে লেখ কেন, (এ প্রশ্ন করলাম) কেননা কথাবার্তায় তো তুমি আমার মতোই পরিষ্কার?” উত্তরে ফুকো বলেছিলেন, “ফ্রান্সে তোমাকে ১০% অবোধ্য লিখতে হবে, নাইলে লোকে সেটাকে গভীর বলে ভাববে না। তারা তোমাকে গভীর চিন্তক বলে মনে করবে না।” ফুকোর এই কথা সার্ল আরেক ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার পিয়ের বোর্দিওকে বলেছিলেন, বোর্দিও জবাবে বলেছিলেন, “এটা ১০% থেকেও খারাপ, এটা প্রায় ২০%”। (জন সার্লের একটা বক্তৃতা থেকে নেয়া, ইউটিউবে পাওয়া যাবে)
ফুকো অতো খারাপ না চমস্কির কাছে
ফুকোর সঙ্গে চমস্কির বড় একটা বিতর্ক হয়েছিলো ১৯৭১ সনে। তাদের দ্বিমতটা সবাই জানে- মোদ্ধা কথায় বললে এমন দাঁড়ায়- চমস্কি মানবের মৌলিক প্রকৃতি (স্বভাব)কে ইউনিভার্সাল বলেন, অন্য দিকে ফুকোর কাছে এমন কোন বিষয়ের অস্তিত্ব নেই। চমস্কি মনে করেন জাস্টিস মানবের মৌলিক প্রকৃতির অংশ, ফুকো মনে করেন এটা সমাজের আবিষ্কার, ক্ষমতার সঙ্গে এটা সম্পৃক্ত এবং আপেক্ষিক। যাহোক, চমস্কি ফুকোর সঙ্গে দ্বিমত করেছেন, এর মানে তিনি ফুকোকে বুঝতে পেরেছেন। ফরাসি দুর্বোধ্যবাদ দুষ্ট চিন্তকদের মধ্যে তাহলে ফুকো বেহতর। চমস্কি সেই সনদ ফুকোকে দিয়েছেন। "আমি অবশ্য আলাদা করে ফুকোকে এর (দুর্বোধ্যবাদ) জন্য দোষ দিই না: এটা প্যারিসের একটা খুব গভীরে প্রথিত নষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির অংশ যাতে স্বাভাবিকভাবেই ফুকো পড়ে গিয়েছে, যদি ওর কৃতিত্ব এই যে, ও এর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।" (ওপেন কালচারে প্রকাশিত একটি ব্লগ থেকে নেয়া)
ফুকোর চোখে দেরিদার দুর্বোধ্যবাদের সন্ত্রাসবাদ
সার্ল ফরাসি চিন্তকদের মধ্যে দেরিদার লেখাকে চরম অবোধ্য মনে করেন। এ দুইজনের মধ্যে একবার তর্কও লেগেছিল। দেরিদা জে এল অস্টিনের ইলোকিউশনারি অ্যাক্ট নিয়ে একটা পর্যালোচনা লিখেছিলেন যার জবাব লিখেছিলেন সার্ল- সেই জবাব পড়ে দেরিদা সার্লের সমালোচনা করেন, বলেন সার্ল ‘ফেনামেনলজিক্যাল পার্স্পেক্টিভ অন ইন্টেনশনালিটি’-এর সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত নন। জবাবে সার্লও বলেন, দেরিদা অস্টিন (এবং পিয়ার্স)-এর টাইপ-টোকেন ভেদকে ভুল বুঝেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যাহোক, সার্ল একবার ফুকোকে দেরিদার লেখালেখি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ফুকো দেরিদার উপর সার্লের চেয়েও ক্ষ্যাপা ছিলেন। ফুকো সার্লকে বলেন, দেরিদার চর্চিত মেথডকে বলা যায় দুর্বোধ্যবাদের সন্ত্রাসবাদ। ও এমন দুর্বোধ্য করে লেখে যে তুমি বুঝতে পারবে না ও কী বলছে। এটা হলো তার দুর্বোধ্যবাদের অংশ। আবার যখন তুমি ওকে সমালোচনা করবে, ও সর্বদা বলতে পারবে, ‘আপনি আমাকে বোঝেননি, আপনি একটা ইডিয়ট’। এটা হলো তার সন্ত্রাসবাদের অংশ। (ওপেন কালচারে প্রকাশিত একটি ব্লগ থেকে নেয়া)
লাকঁর ম্যাথমেটিকাল মেটাফর বুঝলেন না পদার্থবিদ সওকাল
“মানব জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে একটা ক্যালকুলাস হিসেবে যেখানে শূন্য একটা ইরেশনাল। এই ফর্মুলা কেবল একটা ইমেজ, একটা ম্যাথমেটিকাল মেটাফোর। আমি যখন বলছি “ইরেশনাল,” আমি কোন অপরিমেয় আবেগের অবস্থাকে নির্দেশ করছি না, বরং [নির্দেশ করছি] নির্ভুলভাবে যাকে বলা হয় একটা ইমাজিনারি সংখ্যা।” [মনোবিশ্লেষক, মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক লাকঁ]। এই উদ্ধৃতিতে, লাকঁ ইমাজিনারি সংখ্যার সঙ্গে ইরেশনাল সংখ্যাকে গুলিয়ে ফেলেছেন, [এবং] একইসঙ্গে দাবি করছেন তিনি নির্ভুল।[…] লাকঁ এখানে বিচক্ষণতার সঙ্গে মেটাফোরের কথা বলেছেন, যদিও এটা উদ্ধার করা কঠিন ঠিক কোন তাত্ত্বিক রোলটা এখানে এই মেটাফোরটা (মানব জীবন হলো একটা “ক্যালকুলাস যেখানে শূন্য ইরেশনাল”) নির্বাহ করে।” (ফ্যাশনেবল ননসেন্স, পৃষ্ঠা ২৫, লেখক পদার্থবিদ সওকাল এবং পদার্থবিদ ব্রিকমঁ)
লাকঁর মনোদৈহিক মেটাফর বুঝলেন না চমস্কি
চিন্তা কী ভাবে ঘটে চমস্কির এই প্রশ্নের জবাবে লাকঁ বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বাস করি আমরা আমাদের মগজ দিয়ে চিন্তা করি, কিন্তু আমি মনে করি আমার পা দিয়ে। এটা শুধু সেখানে যখন আমি শক্ত কিছুর সংস্পর্শে আসি। মাঝে মাঝে আমি আমার কপালের মাংসপেশী দিয়ে চিন্তা করি যখন আমি কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাই। আমি পর্যাপ্ত ইলেক্ট্রো-এনসেফালোগ্রাম (EEG) দেখেছি, জেনেছি চিন্তার কোন ছায়া নাই।” চমস্কি এই উত্তর শুনে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে লাকঁ একটা পাগল। লাকঁর জীবনীকার এবং ফরাসি মনোবিশ্লেষক রুদিনেস্কো বহু বছর চেষ্টা করেন চমস্কিকে লাকঁর বক্তব্যের মেটাফরিকাল প্রকৃতিটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে, কিন্তু চমস্কি তার আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন। (লাকঁ, রাজনীতি, নন্দনতত্ত্ব, সম্পাদনা এপলন এবং ফেল্ডস্টাইন, পৃ ১৩৫)
বাংলাদেশে দর্শন চর্চায় ইউরোপের প্রাধান্য
বাংলাদেশের দর্শন চর্চা, আমার অভিজ্ঞতায়, পাঁচ মেশালি, তবে কন্টিনেন্টাল ফিলসফির বাজার বেশ গরম। একাডেমির বাইরে শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র ও রাজনীতি নিয়ে চর্চা হয় সেখানে দর্শনের ডামাডোল বেশ উচ্চকিত। ফ্রয়েড ও ফ্রান্সের চিন্তাধারা, বিশেষ করে পোস্ট কলোনিয়াল, পোস্ট স্ট্রাকচারাল, পোস্ট মডার্ন, বিনির্মাণ ইত্যাদি বর্ষণে বাংলাদেশে প্লাবিত হয়েছিলো বিশেষ করে নব্বইদশকে। ধ্রুপদী মার্ক্সিস্টদের মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো এই উত্তরবাদীরা। সম্প্রতি সেই জ্বর একটু কম। তবে সেই প্রভাব সবকিছুকে বদলে দিয়ে গেছে এটা মানতে হয়। ইউরোপীয় উত্তরাধুনিকতাবাদ আরসব বাদকে আত্মসচেতন করে দিয়ে গেছে। এটা ইতিবাচক দিক। আর নেতিবাচক দিক হলো বাংলাদেশের বেশি কিছু চিন্তকদের ঘাড়েও ফরাসি দুর্বোধ্যবাদের ভূত চেপে বসেছে।