ফজল শাহাবুদ্দীনের গদ্য ‘আমার কথা কবিতার কথা’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২০
কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের আজ জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিংশ শতকের ষাট দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার আত্মজীবনীমূলক গদ্য ‘আমার কথা কবিতা কথা’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
কবিতা সম্পর্কে আমার নিজের কথা বলতে গিয়ে একবার আমি একটি ক্ষুদ্র নিবন্ধ পাঠ করেছিলাম বেতারের একটি অনুষ্ঠানে। সেই রচনাটিতে আমি বলেছিলাম কবিতা এক ধরনের এক স্বগতোক্তি। বলেছিলাম, কবিতা এক ধরনের ঘনিষ্ঠ উচ্চারণ এক ধরনের স্বগত সংলাপ।
একজন কবি যাই লেখেন না কেন প্রথমে তা একটি অন্তর্গত হাহাকারের মতো কেবলি ধ্বনিত হতে থাকে তার সর্বসত্তায় তার সকল অস্থিমজ্জা জুড়ে। নদীর ভাঙনের মতো ক্রমাগত ধস নামতে থাকে কবির রক্তমাংসে, কবি অলৌকিক একক শক্তির খেলার মধ্যে কেমন করে যেন ডুবে যান এবং এই অবগাহনে অচিন্তনীয় অতল থেকে তাকে আবিস্কার করতে হয় তার কবিতার আত্মা কবিতার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত চিরকালের সঙ্গীত। কবিতার ভাষা ও শব্দের মধ্যে গ্রহিত করতে হয় তাকে সেই নিঃশ্বাসের শব্দ যার সঙ্গে মিশে আছে বিশ্ব ভূবনের সকল প্রেম ও কাম মিশে আছে সকল প্রার্থনার মগ্নতা সকল অরণ্যের গন্ধ।
তখন আমার কাছে মনে হয়েছিলো কবিতা হাজার হাজার স্বপ্নের ভেতর অচিন্তনীয় পাখিদের যে অবিশ্বাস্য উড়াল তার শব্দের মতো এক ধরনের নিস্তব্ধতা। মনে হয়েছিলো কবিতাকে আমি জানি। কবিতার সংজ্ঞাকে আমি লিপিবন্ধ করতে পারি অনায়াসে। এতদিন পরে এখন আমি বুঝি কবিতাকে আমি কখনোই সম্পূর্ণ জানতে পারিনি, ছায়াকে যেমন কোন দিন আমি স্পর্শ করতে পারনি এও যেন ঠিক তেমনি। আরো পরে আমি কবিতা প্রসঙ্গিত একটি প্রশ্ন শুনে খুব বিব্রত হয়েছিলাম। সেই কথা বলি এবার। এও অনেকদিন আগের কথা। দুপুরের দিকে বাসায় ব’সে একটি কবিতার কপি করছিলাম। কার্পেটের উপর বসে আমার সেই কপি করা দেখছিলো- কয়েক মিনিট পর হঠাৎ করেই প্রশ্ন করে বসলো সে- বললো, তুমি কি কবিতা লিখছো?
অমিতের বয়স তখন আট-দশ বছর হবে। এতটুকু ছেলে এমন প্রশ্ন করে বসবে ভাবিনি? ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম,বললাম, না ঠিক কবিতা লিখছিনা কবিতার-কপি করছি। জবাব শুনে সে সন্তষ্ট হল ব’লে মনে হ’লনা। কেননা সে আবার প্রশ্ন করলো, তাহলে কখন তুমি কবিতা লেখো?
বললাম, তার কোন ঠিক নেই। যখন ভালো লাগে ইচ্ছে হয় তখন লিখি। আমার জবাব যে সে বুঝলো তা নয়। তবুও সে তার শেষ প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আমার দিকে- কেমন করে কবিতা লেখো তুমি?
এই সব কথা আমি ভুলে গেলাম অচিরেই- শুধু আমার কনিষ্ঠপুত্র অমিতের সেই শেষ প্রশ্নটিকে আমি এখনো বহন ক’রে চলেছি। আমার মনে- কেমন ক’রে কবিতা লেখো তুমি? আসলেই কেমন ক’রে কবিতা লিখি আমি? রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন,
‘তুমি কেমন ক’রে গান করহে গুণী
আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।’
রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন তিনি কেমন করে লিখছেন কেমন করে গান করছেন? জানতেন কি শেক্সপীয়ার কিংবা ফেরদৌসী অথবা জীবনানন্দ যে, তারা বিরলে ব’সে যে পংক্তিমালা রচনা করছেন তা একদিন চিরকালের অমর কাব্য বলে চিহ্ণিত হবে,- চিরকালের কাব্য পিপাসু পাঠক ভালোবাসবে সেই কবিতা? তারা কি জানতেন সেই অচিন্তনীয় কৌশল অনুভব এবং মেধা প্রজ্ঞা তাদের করায়ত্ত যা কবিতাকে অমর করে-নাকি তারা নিজেরাই ছিলেন প্রকৃতির মতো যার মধ্যে সকল অমর শব্দ ও সঙ্গীতের জন্ম হয় যুগে যুগে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদি তাদেরকে কেউ প্রশ্ন করতেন, তুমি কেমন করে গান লেখো গুণী কিংবা আমার নাবালক পুত্র অমিতের মতো প্রশ্ন করতো কেউ, তুমি কেমন করে লেখো? তাহলে তারা কি জবাব দিতেন? তারা কি আদৌ জবাব দিতে পারতেন? কোন কবির কাছ থেকে এইসব প্রশ্নের জবাব কি আমাদের চাওয়া উচিত? আমার ধারনা নয় শুধু, আমার বিশ্বাস- এ ধরনের প্রশ্নের না কোন অর্থ আছে, না কোন প্রয়োজন? এবং বলাই বাহুল্য এ কোন সত্যিকার জবাবও নেই। কিন্তু তবুও একালে এবং এই সময়ে একজন কবির কাছে কবির প্রতি প্রশ্নের যেন কোন অন্ত নেই। সারা পৃথিবীই-বিশেষ ক’রে আমাদের দেশে।
সেদিন একজন সাংবাদিক কবি এসেছিলেন আমার অফিসে। বয়স কম। সাংবাদিকতা করেন এবং কবিতাও রচনা করেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক তার পুরোপুরি। কথায় কথায় প্রসঙ্গ এলো কবিতা-আমাদের কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা। এক সময় তিনি বললেন, বাংলা ভাষায় ত্রিশের কবিদের রচনা আসলে একভান্ড বিদেশী আবর্জনা মাত্র। সেইসব কবিতায় না আছে নিজের দেশ নিজের দেশের প্রকৃতি নিজের দেশের মানুষ কিংবা নিজের দেশের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি। এরা অচিরেই আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হবেন-ত্রিশের কবিদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন একমাত্র জসীমউদ্দিন। কথাগুলো তিনি এমনভাবে বললেন যে মনে হলো তিনি যা বিশ্বাস করেন তিনি যা উচ্চারণ করলেন তাই চুড়ান্ত এবং একমাত্র সত্য। আমার রুম থেকে নিস্ক্রান্ত হওয়ার আগে আবার বললেন ফজল ভাই মনে রাখবেন আপনারা এদেশেরই কবি। এদেশে আপনাদের কাছে অনেক কিছু আশা করে এদেশে আপনাদের লালন করেছে এবং লালন করছে।
চ’লে গেলেন তিনি। আমি কিছুই বললাম না-আসলে বলতে পারলাম না। কী বলবো আমি। অনেকক্ষণ চুপ ক’রে ব’সে থাকলাম নিজের নিঃসঙ্গ রুমে। হঠাৎ মনে হল কবিতা লেখাই এখন এদেশে একটা বড় রকমের দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জসীমউদ্দিন ত্রিশ দশকের একজন বড় কবি। এর সঙ্গেতো আমি দ্বিমত পোষণ করছি না- কিন্তু তাই ব’লে ত্রিশের অন্যসব কবিরা কিচ্ছু নয়- তাদের কবিতা বিদেশী আবর্জনার ভান্ড এ কেমন কথা, কেমন উচ্চারণ? কবিরা স্বদেশের কাছে দায়বদ্ধ নন এমন কথাওতো কেউ কোনকালে বলেন নি- কিন্তু তাই ব’লে সারা পৃথিবী আমাদের কাছে চিরকালই বিদেশ থাকবে এ কথাতো সত্য নয়, গ্রহণযোগ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ এক সময় বাঙ্গালীদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙ্গালী ক’রে মানুষ করোনি’। বাংলাদেশের মানুষেরা বাঙ্গালী কিংবা বাংলাদেশী এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য তারা মানুষও। একদিকে তারা যেমন বাংলাদেশের বাসিন্দা তেমনি তারা পৃথিবীরও অধিবাসী। একথা অস্বীকার করবো কোন যুক্তিতে?
তাহলে একজন কবি কার কাছে দায়বদ্ধ, কার কাছে অঙ্গিকারদ্ধ? কবিকে কি সত্যিকার কারো কাছে দায়বদ্ধ কিংবা অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন আছে? কবি কি আসলেই কোন দায়বদ্ধতা থেকে কোন পংক্তি কোন কবিতা রচনা করেন? তাহলে রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘আমার নয়নে লেগেছে ঘোর’- তার অর্থ কি? এ ঘোর কিসের এ ঘোর কার জন্যে এ ঘোর কাকে আবিষ্কার করতে চায় ক্রমাগত। একজন কবি কি প্রকৃতপক্ষে বাস করেন একটি ক্রমাগত ঘোরের ভেতরে ঘোরের আত্মায় একটি ঘোরের অবিনশ্বর অন্তহীনতায়? এ ঘোর কি জীবনের যৌবনে প্রকৃতির নিসর্গের অন্তরীক্ষের মৃত্যের প্রেমের কিংবা সৃষ্টির আর নির্মাণের? এ ঘোরের আলো অন্ধকার থেকেই কি একজন কবি আবিষ্কার করেন সব কিছুকে এমনকি তার সকল সময়। এক সময় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নজরুল বলেছিলেন, আমিতো শুধু কবি আমিতো একজন বাঁশি মাত্র। তিনি আমাকে যেমন ক’রে বাজান আমিতো ঠিক তেমনি ক’রেই বাজি। নজরুল যেন বলতে চেয়েছেন তার সকল উচ্চারণের সকল শব্দের সকল গানের সুরের দায়ভারতো সেই একজনের-সেই তিনি-যিনি তাকে বাজিয়ে চ’লেছেন অবিচ্ছিন্নভাবে। রবীন্দ্রনাথ একটি গানে লিখেছেন ‘একি কৌতুক নিত্য নতুন, ওগো ‘কৌতুকময়ী’/ যে কথা আমি বলিবার চাই বলিবারে দিতেছো কই’। এই যে তিনি এই যে কৌতুকময়ী এরা কি মহাপ্রকৃতির মতো যে বিধাতা, তারই অন্য নাম। নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেই কি সেই অমোঘ নিয়ন্ত্রকের দিকেই অঙ্গুলী সংকেত ক’রেছেন যিনি কবির ঘোরকেও নিয়ন্ত্রণ করেন-যে ঘোরের স্বপ্নাপ্লুত সব উচ্চারণের নামই কবিতা। তাহলে? একজন কবিকে কেন আমরা টেনে আনতে চাই একটা সীমিত গন্ডিতে- অসংখ্য প্রশ্ন আর তার জবাবের দায়বদ্ধতার মধ্যে, অঙ্গীকারের মধ্যে।
কেউ কেউ ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করে কেন একজন কবি থাকবেন সকল ধরা ছোয়ার উর্দ্ধে। তারাওতো এ সমাজের মানুষ-বাঁচার জন্য তাদেরওতো সকল সুযোগ ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন হয় যা অন্য সবার লাগে। একজন কবিতো হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবেন না বাতাসের ঘনিষ্ট আলিঙ্গনের নিজেদের আচ্ছাদিত ক’রে রাখেন না। তবে কেন সমাজের বাইরের কেউ নন। সুতরাং শাসন এবং অনুশাসন সমানভাবে তাদের জন্য প্রয়োজন হওয়ার উচিত। প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
তবুও আরো স্পষ্ট বলছি একজন সত্যিকার কবিকে উপরে উচ্চারিত বাক্যসমূহের আদালতে বিচার করতে যাওয়া আমার মনে হয় ঠিক হবে না। অন্ততঃ তাতে কোন লাভ হবে না। জীবনানন্দ দাশ একসময় যাদের কথা বলেছেন সেই কেউ কেউ যারা কবি তাদের বিচারের জন্য একটি ভিন্নতরো প্রেক্ষিতের কথা আমাদের ভাবতে হবে। কেননা আমার বিশ্বাস ‘কবি’ ব’লে চিহিৃত পরিচিত যে মানুষটিকে বা ব্যক্তিটিকে আমরা টেনে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো তার সবটুকুই একজন ব্যক্তিমাত্র-আমাকে যিনি নিরন্তর বাজিয়ে চ’লেছেন সব দোষ তার। সেই অমোঘ নিয়ন্ত্রকের। সুতরাং আমার মতে একজন ব্যক্তি যিনি কবিতা রচনা করেন তার সেই কবিসত্তাটুকুই আমাদের বিবেচ্য হওয়া উচিত, যিনি এমন ঘোরের মধ্যে বসবাস করেন যেখানে থেকে কোন অন্যায় অবিচার কিংবা অশুভ কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেখা গেছে বহু স্মরণীয় কবিই এমন সব কাজ করেছেন যা সমাজ গ্রহণ করেনি যা সামাজিক অর্থে গর্হিত অর্থাৎ সেই অস্তিত্ব যার নাম কবি যখন তিনি তার সেই ঘোর থেকে জাগতিক দেনা পাওনার মধ্যে প্রবেশ করেছেন তখনই তিনি পতিত বলে চিহিৃত হয়েছেন সমাজের কাছে দেশের কাছে কাজেই একজন কবির অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে যে ব্যক্তি তিনি সকল সময়ে শ্রদ্ধাভাজন এবং পূজনীয় নাও হতে পারেন। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এখনোতো একজন কবিকে প্রেম ও রমণী প্রসঙ্গিত ব্যাপারে মোটামোটি দুঃশ্চরিত্র বলেই চিহিৃত করা হয়। আমার ধারণা একজন কবির কমিটমেন্ট সেই ঘোরের কাছে যা তাকে কবি বানায় অন্য সবকিছুই তার অনুসঙ্গমাত্র।
কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক আপাততঃ। এ জটিল প্রসঙ্গে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে র্দীঘ সময় এবং র্দীঘ পরিসরের প্রয়োজন। এবং এ আলোচনায় আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না এমনকি হয়তো অনেক কবিরাও নয়। সুতরাং এই জটিল বিষয়টিকে আপাততঃ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। বরং ফিরে আসি সেই প্রশ্ন যার প্রসঙ্গে শুরতেই আলোচনা সূত্রপাত করেছিলাম। ফিরে যাওয়া যাক আমার তখনকার নাবালক সন্তানের সেই প্রশ্নে কেমন করে কবিতা লেখো তুমি? সঙ্গে আমি আরো একটু যোগ করে দিতে চাই কার নির্দেশে কার উদ্দেশ্যে?
সত্যি, কার উদ্দেশ্য একজন কবি রচনা করেন তার কবিতা? কার নির্দেশে? আমাকে যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাহলে আমি শুধু একটুকুই বলতে পারবো সত্যি আমি জানিনা কেমন করে কবিতা লিখি আমি কার উদ্দেশ্যে লিখি সেতো আরো জানিনা। শুধু এটুকু আমি জানি যে আমাকে লিখতে হয় লিখতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘আমি যে গান গাই জানিনে সে কার উদ্দেশ্যে?’
আমার ধারণা সত্যিকার যিনি কবি তিনি কখনোই জানতে চাননা জানেন না তার কবিতার উদ্দেশ্যে কিংবা প্রয়োজনটুকু কোথায় কার জন্য? এই সুযোগ বা সূত্রে আমি কস্মিনকালেও নিজেকে
একজন সৎ কিংবা মহৎ কবির কাছাকাছি দাঁড় করাতে চাই না। এমনটি যেন কেউ মনে না করেন। আমি শুধু সেই সত্যটুকুই প্রকাশ করতে চাই যার অবিনশ্বর এক রজ্জু একজন প্রকৃত কবি জড়িয়ে রাখে সর্বক্ষণ। আমার কেন জানি মনে হয় একজন প্রকৃত কবি স্বভাবতই বড় একা বড় নিঃসঙ্গ বড় অসহায়। কবির একাকীত্বকে নিয়ে আমি একটি কবিতাও লিখেছিলাম একসময়। সেই কবিতায় বলেছিলাম কবির একাকীত্বকে কেউ বোঝে না-সমুদ্র যেমন একা অন্তরীক্ষ যেমন একা-যেমন একা নক্ষত্রপুঞ্জঃ নদী রাত্রি কিংবা রমণীর শরীর পৃথিবীর সব উপত্যকা সব গোধুলি সব বৃক্ষরাজি যেমন একা তেমনি একা একজন কবি। আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম একজন ব্যক্তি যিনি কবি তিনিতো সর্বক্ষণ সেই অচিন্তনীয় অবিনশ্বর ঘোরের মধ্যে মগ্ন তিনিতো সেই মহাপ্লাবনের যে মহাঘূর্ণি তার মধ্যেই একটি তৃণখন্ডের মতো সর্বক্ষণ ভাসমান এবং আবর্তিত। সঙ্গীহীন উদ্দেশ্যহীন ভাসমান ধাবমান-রবীন্দ্রনাথের সেই ঘোর নামক মহাচক্রের মধ্যে বন্দী। যেখানে তিনি ছিন্ন বিছিন্ন হচ্ছেন প্রতি মূহুর্তে, একটি গভীর আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়েছেন ক্রমাগত-একটি সমাপ্তিহীন ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে ভ’রে যাচ্ছেন পলে অনুপলে কার যেন অমোঘ নিদের্শে। কবির সেই আবর্তিত শব্দ এবং শব্দহীনতা আলো এবং আলোহীনতা অন্ধকার এবং অন্ধকারহীনতার কোন ব্যাকরণ নেই কোন নিয়ম নেই কানুন নেই-কবি সেই আন্দোলিত মহাপ্রকৃতির অন্তরআত্মা থেকে যে উচ্চারণ করেন তার নামই যদি কবিতা হয় তাহলে তিনি কী ক’রে বলবেন -তিনি কেমন ক’রে কবিতা রচনা করেন কার উদ্দেশ্য করেন? কেন করেন? আমার সেই কবিতায় আমি বলেছিলাম,
একজন কবি
যেন চিরকালের অমোঘ উচ্চরণ
ধ্বনি প্রতিধ্বনি
মিশে যায় বাতাসের শরীরে
আলো অন্ধকারের অতলে শব্দের অণু পরামাণুতে
একা অসহায় মিশে যায়
একজন কবি’।
জানি কবি এবং কবিতার এই দর্শনকে হয়তো অনেকেই গ্রহণ করতে রাজি হবেন না। আজকের দিনে আমরা যারা নিজেদেরকে কবি বলে অহরহ সনাক্ত করতে চাচ্ছি তারা সকলেই-কিংবা তাদের অধিকাংশই এই দর্শন সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত ক’রে ফেলেছি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি নিজে কী করছি সেটাও প্রশ্নের বাইরে এ দাবীও আমি করতে চাই না। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে একজন ব্যক্তির অন্তর্গত যে কবির অস্তিত্ব তা কিন্তু এ দর্শনের বাইরে। সেই অস্তিত্ব এবং তার বোধ মেধা অনুভব মনন সবকিছুই সেই অসহায় একাকীত্বে ভরা, সেই সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় আন্দোলিত যার নাম কবিতা। যাকে বুঝতে হলে অসীম ধৈর্য্য আর অনুশীলন প্রয়োজন। একজন কবির সকল ভন্ডামী এবং স্খলন তার সেই ব্যক্তি সত্তার যার কোন ঘোর নেই।
তাই একজন কবির অস্তিত্ব থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর- অন্তত যথাযথ উত্তর কখনোই আশা করা যাবে না যে তিনি লেখেন কেমন ক’রে লেখেন কার নির্দেশে এবং কার উদ্দেশ্যে লেখেন। আমার নাবালক পুত্র অমিতের প্রশ্ন তাই আমি এখনও একান্তে বহন করে চলেছি তুমি কেমন ক’রে কবিতা লেখো? যার উত্তর এখনো আমি জানিনা-শুধু সুধীনাথ দত্তের মতো বলতে পারি-‘কি নাম সুধাই/উত্তর নাই/ঝরে শুধু বারিধারা’।
আমার নাবালক কনিষ্ঠ পুত্রের একটি আকস্মিক প্রশ্নকে নিয়ে এই যে এতক্ষণ ধরে আমি নানা কথা বললাম, কবি ও কবিতা বিষয়ক নানা প্রসঙ্গকে টেনে আনলাম ব্যাখ্যা করতে চাইলাম, একাধিক মহৎ কবিকে স্মরণ করে চিরকালে কবি ও কবিতাকে একটি শুদ্ধতার সর্বকালের প্রেক্ষিতে বিচার করতে চাইলাম গ্রহণ করতে চাইলাম তার মধ্যে কতটুকু আমার কথা আছে কতটুকুই কবিতার কথা? জানিনা। শুধু এইটুকু জানি এই ক্ষুদ্র রচনাটির মধ্যে আমি যেমন কবিতার কথা বলতে চেয়েছি তেমনি আমার নিজের কথাও বলতে চাচ্ছি।
২০০১ সালের কোন এক সময় আমি জাপানের একটি ক্ষুদ্র শহর মায়েবাশীতে গিয়েছিলাম কবিতা পাঠ করতে কবিতা শুনতে এবং কবিতাকে নিয়ে কিছু বলতে। সেই সময় আমার একটি ছোট্ট কবিতার ইংরেজী তর্জমা পাঠ ক’রে একজন জাপানী তরুণী কবি আমাকে শুধিয়েছিলো, তুমি কি কেবল কবি নাকি তুমি একজন সিদ্ধ ঋৃষিপুরুষও। প্রশ্নটি শুনে আমি প্রায় হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক সেকেন্ড কিছুই বলতে পারিনি। আমার দিকে তাকিয়ে যে আবার ব’লেছিলো,
Are you a saint also? মনে আছে সহসা আমি যেন নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। বললাম, না আমি ওসব কিছুই নই। আমি শুধু একজন কবি ছাড়া আর কিছুই নই। আমি একজন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ মাত্র কোন ঋৃষিপুরুষ হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আমার সেই ছোট্ট কবিতাটিতে আমি অন্তকালকে একটি মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম, বলেছিলাম কোটি কোটি অনন্তকালও একজন কবির কাছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু মুহূর্ত মাত্র। সম্ভবত সে কারনেই সে আমাকে এমন প্রশ্ন ক’রেছিলো।
আমার জবাব শুনে সেই তরুনী কবি কিন্তু সন্তুষ্ট হয়নি। বলেছিলো, আমি তোমার সঙ্গে এ নিয়ে আরো কিছু সময় কথা বলতে চাই তুমি কি সময় দেবে? বলেছিলাম, নিশ্চই দেবো।
ব’লেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরো কিছু সময় কথা বলা আমাদের হয়নি। শুধু নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন একজন কবিকে কি একজন সিদ্ধপুরুষ কিংবা Saint হওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে। একজন কবি কিংবা ঔপন্যাসিক কিংবা নাট্যকার অথবা গদ্য লেখককে কি একজন ঋষি হওয়ার দরকার? তার কোনো সুযোগ কি আছে এই একবিংশ শতাব্দিতে।
হয়তো আছে কিংবা হয়তো নেই। আমি জানি এই বিবাদ আমার কথাও নয় কবিতার কথাও নয় তবে আমার একান্ত বিশ্বাস পৃথিবীর সকল সৎ ও মহৎ কবিতার জন্যই এক ধরনের আধ্যাত্মিক অর্জন অবশ্য প্রয়োজন। কেননা একজন কবির জাগতিক এবং অস্তিত্বের সঙ্গেইতো গ্রথিত হয়ে আছে তার অন্য সব কিছু এমনকি মহাজাগতিক এবং আত্মিক অস্তিত্বও। শুরুতেই যে বলেছি কবিতা এক ধরনের ঘনিষ্ঠ উচ্চরণ সে কথা শুধু জাগতিক অর্থে নয় মহাজাগতিক বলে আমি গ্রহণ করেছি আমার কবিতা নির্মাণের সকল ঘোরে। আমার সকল লৌকিক এবং পারলৌকিক ধারণা ও ধ্যানের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য অবস্থানে এই সবকিছুই গ্রহিত। আমার এই গ্রহিত সত্তা বেঁচে থাকে এক ক্রমাগত এবাদতের মতো। এবং সেই এবাদতের অন্তর্গত হাহাকারের সঙ্গেই বেঁচে থাকি আমি আমার প্রকৃতি আকাশ অন্তরীক্ষ আমার শস্যকনা, সবুজ পাতার উদ্ভাস ঝরা পাতার শব্দ প্রসারিত রৌদ্র আর বিরামহীন বৃষ্টি। আমার সকল শব্দ শব্দহীনতা সকল চাঞ্চল্য সকল ধৈর্য আমার সকল নাদ নিনাদ এবং আর্তনাদ। বেঁচে থাকে আমার ধরিত্রী কবলিত রক্ষমাংসময় জীবন তার সকল তৃষ্ণা ক্ষুধা বাসন।