প্লটার বনাম প্যানসার

মাহবুব মোর্শেদ

প্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০১৯

কলেজে পড়ার সময় থেকে উপন্যাসের কারিগরি শেখার বিষয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল। তখন তো বটেই, পরেও অনেকদিন ইন্টারনেট আমার আয়ত্তের বাইরে ছিল। আমার ধারণা, এখনও এ নিয়ে বাংলা বইয়ের যথেষ্ট অভাব আছে।

এদেশে আমরা উপন্যাস পড়ে উপন্যাস লেখার টেকনিক শিখি। অনেকটা একটা বাড়ি দেখে আরেকটা বাড়ি বানানোর মতো ব্যাপার। একটা একতলা বাড়ি দেখে আমি হয়তো আরেকটা একতলা বিল্ডিং বানাতে পারবো। কিন্তু একটা দশতলা বিল্ডিং দেখে কি আরেকটা দশতলা বিল্ডিং বানানো সম্ভব?

একটা কমপ্লিট দশতলা বিল্ডিং দেখে কি বোঝা সম্ভব, মাটির নিচে কতটা কংক্রিট ফেলতে হবে? কিংবা নিচ থেকে ওপরে ইলেকট্রিক লাইন বা পানির লাইন কীভাবে যাবে? সিঁড়ি কোথায় হবে বা ফ্ল্যাটগুলোর দরজা কোথায় থাকবে? বিল্ডিংয়ের ব্যালান্স কোথায় থাকবে, পিলারগুলো কোথায় কোথায় হবে?

এগুলো শিখে নেবার ব্যাপার এবং এটা রীতিমতো একটা প্রযুক্তিগত অধ্যয়নের ব্যাপার। লেখকরা লিখতে লিখতে, মার খেতে খেতে একটা টেকনিক নিজের মতো করে উদ্ভাবন করে নেন। সাধারণভাবে বলাও হয়ে থাকে যে, লেখালেখি শেখানো যায় না। এটা প্রবৃত্তির মতো ব্যাপার। ভেতরে থাকলে আপনা থেকে লেখা চলে আসে। এগুলো হয়তো সত্যি।

কিন্তু লেখার অনেক বিষয় আছে যেগুলো শিখে নিলে লেখকরা উপকৃত হতে পারেন। মজার ব্যাপার হলো, লেখকরা এগুলো শেখাতে চান না। লেখার কৃৎকৌশলকে তারা রহস্যাবৃত করে রাখতে পছন্দ করেন। আমি লেখকদের সাক্ষাৎকার পড়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, আসলে কীভাবে তারা লেখেন? খুব বেশি বোঝা না গেলেও একটা আভাস পাওয়া যায়। কয়েকজন লেখকের সঙ্গে সরজমিনে মিশেও আমি বোঝার চেষ্টা করেছি।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ লেখক প্যানসার টেকনিক ব্যবহার করে লেখেন। হারুকি মুরাকামির একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম সম্প্রতি। তিনিও প্যানসার পদ্ধতিতে লেখেন। একটা গল্পের মধ্যে চরিত্রকে চালিয়ে দিয়ে তিনি তাকে অনুসরণ করেন, গল্পটা ও এর চরিত্রেরা যার যার মতো করে এগিয়ে যায়।

প্যানসার কথাটা এসেছে fly by the seat of your pants থেকে। আগের দিনের ফ্লাইটগুলো এখনকার মতো প্রযুক্তিগত সহায়তা পেত না। পাইলটের বিচারবুদ্ধির ওপর ভর করে ফ্লাইট পরিচালিত হতো। ত্রিশের দশকে এই টার্মটা চালু হয়। ডগলাস করিগান ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আয়ারল্যান্ডে ফ্লাই করেন। তখন পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছিল করিগান ফ্লাইস বাই দি সিট অফ হিজ প্যান্টস।

আগে থেকে কোনো পরিকল্পনা বা কার্যপদ্ধতি তৈরি না করে নিজের উদ্যোগ, উদ্যম, বোধবুদ্ধি ও কল্পনার ওপর ভর করে লেখাকে বলে প্যানসার। অনেক লেখকই প্যানসার পদ্ধতিতে লেখেন। এতে নভেলা বা ছোট উপন্যাস বা গল্প লেখা সহজ। এমনকি বড় উপন্যাসও সম্ভব। কেননা, পরিকল্পনা এমনকি লেখার বড় একটা কাজ হয়তো লেখকের মাথাতেই হয়ে থাকে। লেখার সময় সেগুলো আকার পেতে থাকে। কিন্তু এতে ভীষণ মনোযোগ দরকার পড়ে। আমাদের যে লাইফ স্টাইল তাতে প্যানসার পদ্ধতিতে সহজে খেই হারিয়ে যেতে পারে।

প্লটার পদ্ধতি বরং ভালো হতে পারে। উপন্যাসের একটা নকশা করে গল্প কোথা থেকে কোথায় যাবে, চরিত্রেরা কীভাবে আসবে, কোথায় টুইস্ট হবে, কোথায় গল্প মোড় নেবে— সেগুলো আগে থেকে ঠিক করা থাকলে লিখতে হয়তো সুবিধা হয়।

দুটো ক্ষেত্রেই, আমার মনে হয় গবেষণা একটা বড় সমস্যা। ধরুন, আপনি নব্বইয়ের দশকের আন্দোলন নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছেন। ওই সময়টাকে রিক্রিয়েট করতে শুধু স্মৃতির ওপর ভরসা করে থাকলে গল্পটা বেশি দূর আগাবে না। কিন্তু এই গবেষণার সময় ও সুযোগ কোথায়?

একজন লেখক প্লটার না প্যানসার সেটা হয়তো লেখকের পছন্দ করে নেবার ব্যাপার। বলা হয়, এটা কাজের নিজস্ব একটা ধরন যেটা লেখককে আবিষ্কার করে নিতে হয়। কেউ হয়তো পরিকল্পনা করে নকশা করে ছক কেটে লিখতে পছন্দ করেন। আবার কেউ গল্পটা শুরু করে কিছু লজিক তৈরি করে সেই লজিকের পেছনে যেতে থাকেন। গল্পে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। সংযোগ Songjog গ্রুপ থেকে সংগৃহীত

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী