প্রাচ্য তাহেরের পাঁচটি দরবেশি কিস্সা
প্রকাশিত : এপ্রিল ১৭, ২০২১
শেষ পরিণতি
হাসান বসরি হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল এক লোক। হাসান তাকে চিনতেন। লম্পট ও জুয়ারি হিশেবে লোকটা পরিচিত ছিল। হাসান বসরি নিজের গায়ের কাপড় গুটিয়ে নিলেন, যেন লোকটার গায়ে ছোঁয়া না লাগে। এটা দেখে লোকটা বলে উঠল, ওহে হাসান, আমার গায়ে লাগবে বলে নিজের কাপড় আপনি গুটিয়ে নিলেন! আপনি কি ভুলে গেছেন, মানুষের শেষ পরিণাম কী হবে, এটা শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন।
মুখের পরদা
মুখের পরদা ছাড়া এক নারী এলো হাসান বসরির সামনে। নারীটি তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিল। সেই অভিযোগই সে করছিল। হাসান বসরি তাকে বললেন, আগে তোমার মুখের পরদা করো। এরপর কথা বলো।
নারী জবাব দিলো, আমি এতই উত্তেজিত ছিলাম যে, মনেই ছিল না মুখ ঢাকিনি। আপনি না বললে হয়তো এভাবেই বাজারে চলে যেতাম। কিন্তু আপনি তো আল্লাঅলা মানুষ, আপনার চোখ কি এরকম সংযত হওয়া উচিত ছিল না যে, আমার মুখে পরদা আছে কী নেই তা খেয়াল না করা?
মুদ্রার থলে
বায়েজিদ বোস্তামির ডেরায় এক লোক এসে তাকে জিগেশ করল, শুনলাম আপনি নাকি কোথায় যাচ্ছেন?
বায়েজিদ জবাব দিলেন, জি। মক্কায় যাব বলে ঠিক করেছি। কাবা শরিফ তওয়াফ করব।
লোকটি জিগেশ করল, আপনার কাছে কত টাকা আছে?
বায়েজিদ জবাব দিলো, দুশা সোনার মুদ্রা।
লোকটি এবার বলল, ওই মুদ্রাগুলো আমারে দিয়ে দেন। এরপর আমার চারপাশে সাতবার চক্কর মেরে নিন। আমাকে দেয়া এই দান কাবা তওয়াফের চেয়ে বেশি সওয়াব আপনাকে দেবে।
বায়েজিদ আর কিছু বললেন না। চুপচাপ মুদ্রার থলেটা লোকটির হাতে তুলে দিলেন।
সরল পথ
বায়েজিদ বোস্তামির একদিন ধারণা হলো, তিনিই হয়তো তার সময়ের সবচে সেরা সুফি। এই ভাবনার পরপরই তিনি আহত হলেন। এ কি! তার ভেতর তো অহং ঢুকে যাচ্ছে। এটা তো জঘন্য পাপ। বায়েজিদ খুবই অনুশোচনায় ভুগতে লাগলেন। মনের স্বস্তি ফিরে পেতে তিনি চলে গেলেন খোরাসানরে এক ঊষর মরুভূমিতে। এরপর বসে প্রার্থনা করতে লাগলেন, হে আল্লাহ, হে দয়াময়, এমন একজন লোককে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন যে আমাকে বলে দেবে আমি কী রকম। নাহলে এই জায়গা থেকে আমি উঠব না।
তিন দিন তিন রাত পেরিয়ে গেল। বায়েজিদ বসেই রইলেন সেই একই জায়গায়। খিদে ও তৃষ্ণা সবই গেলেন ভুলে। ঘুমেও তার চোখ ঢুলুঢুলু হলো না। এতটাই মানসিক চাপ তিনি অনভব করছিলেন তার বুকের ভেতর। চার দিনের দিন রাতে উটের ওপর সওয়ার হয়ে এক পথিক এলেন তার কাছে। উট থামিয়ে বললেন, ওই বোস্তম গ্রাম, গ্রামবাসী ও তাদের সব সম্পদ আমি চোখের পলকে খেয়ে ফেলতে পারি। একটু থেকে লোকটি ফের বলল, আর খেয়ে ফেলতে পারি বায়েজিদকেও।
লোকটির মুখের দিকে চেয়ে বায়েজিদ একটু ভড়কে গেলেন। জিগেশ করলেন, আপনি কে? কোত্থেকে আসছেন?
লোকটি জবাব দিলো, ভাই বায়েজিদ, তুমি যখন এখানে বসে আছো, তখন আমি তিন হাজার মাইল ঘুরে আসছি। ভালো থেকো বায়েজিদ, আর নিজের হৃদয় বেঁধে রেখো। সরল পথ ছাড়া কখনোই হৃদয়কে বাঁকা পথে চলতে দিও না।
বাদ্যযন্ত্র
ঘুটঘুটে রাত। টুংটাং বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ভেসে আসছে কবরস্থানের দিক থেকে। কৌতূহলি হয়ে বায়েজিদ বোস্তামি এগিয়ে গেলেন সেদিকে। দেখলেন, এক যুবক সেখানে বসে মনোযোগ দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। বায়েজিদ বললেন, বাবারে, কবরস্থানে বসে এভাবে বাদ্যযন্ত্র বাজানো ঠিক নয়। তুমি এখন বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
মনোযোগ নষ্ট হওয়ায় যুবকটি রেগে গেল। বাদ্যযন্ত্রটি দিয়ে সে বায়েজিদের মাথায় আঘাত করল। এতে বাদ্যযন্ত্রটি ভেঙে গেল। বায়েজিদও মাথায় ব্যথা পেলেন। কিন্তু কিছুই তিনি বললেন না। চুপচাপ সে জায়গা ছেড়ে চলে এলেন।
পরদিন তিনি কিছু মিষ্টান্ন আর টাকা পাঠিয়ে দিলেন সেই যুবকের কাছে। সাথে একটা চিঠি: কাল আমার মাথায় আঘাত করায় বাদ্যযন্ত্রটি ভেঙে গেছে। এজন্য কিছু টাকা পাঠাইলাম। সাথে কিছু মিষ্ঠান্ন। যাতে এই খারাপ ঘটনাটা তোমার মনে না থাকে।
চিঠিটা পড়ে যুবক ছুটে এলো বায়েজিদের ডেরায়। তার চোখদুটো অনুশোচনার অশ্রুতে তখন ছলছল।