প্রসঙ্গ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
জগলুল আসাদপ্রকাশিত : জুন ২৪, ২০১৯
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রহ বহুগামী নয়। তিনি আপাদমস্তক সাহিত্যমগ্ন মানুষ। যখন তিনি ইতিহাস রচনা করেন, তখনও তিনি সাহিত্যই করেন মূলত। পশ্চিমা অনেক দার্শনিক তত্ত্ব এ মুলুকে এসেছে সাহিত্যের সূত্র ধরে। ড. চৌধুরীর দার্শনিক বোধও সাহিত্যাগত ও সাহিত্যসিক্ত। সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে তার পদচারণা মূলত উপন্যাস ও নাটকে। সমাজও ড. চৌধুরীর কাছে সাহিত্যের টেক্সটের মতোই। তার সমাজ বিশ্লেষণ আর সাহিত্য পর্যালোচনা দূরের নয় মোটেই। একই চৈতন্যের `দুই রকম উৎসারণ`। গৎবাঁধা কিছু বুলিকে কত আবেগমথিত, কমনীয় ও হৃদয়সংক্রামিত করে উপস্থাপন করা যায়, তার অনন্য নজির তিনি। তিনি প্রায় অনড় ও স্থির। তার প্রধান এনালাইটিকাল টুল ‘পুঁজিবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। তিনি ধরা-ছোঁয়ার কিছুটা দূরের বৃহৎ শত্রুর মোকাবেলায় নিষ্ঠ।
পুঁজিবাদ বিরোধিতাকে তিনি ক্লাসিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি অনুত্তেজিত, শান্ত সুশীল। তার গদ্যের লালিত্য বাস্তবতার কষাঘাতে দেয় ‘কাশফুলের নরম ছোঁয়া’। আবার তার পেলবতা ও হার্দ্য উচ্চারণ, বৈপরীত্যের সূত্রে বাস্তবতার নিঠুরতাকেও ধরিয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তার সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলি সৃজনশীলতা আর মননশীলতার বিভাজনে ধস নামায়। ড. চৌধুরী বেঁচে থাকবেন তার চিন্তার শক্তির কারণে নয়, বরঞ্চ তার নিবিষ্টতায়, তার উদ্দেশ্যের এক মুখিনতায়, আর তার গদ্যের সাহিত্যিক বৈভবে।
চিন্তক হিশেবে সবচেয়ে দুর্বল তিনি ধর্ম প্রশ্নে। ধর্মকে ধর্মনিরপেক্ষতা আর সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে বোঝেন না তিনি। ইংরেজি সাহিত্য পাঠসূত্রে খ্রিস্টানিটি সম্পর্কে তার জানা আছে; বঙ্কিম ও বিবেকানন্দকে নিবিড়ভাবে পাঠের কারণে হিন্দুধর্ম সম্পর্কেও তিনি অবহিত। আর সবচেয়ে কম ওয়াকিবহাল তিনি ‘ইসলাম’ সম্পর্কে। মৌলবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে সম্পর্কিত করেই তিনি ইসলামকে দেখেন। তার সমগ্র রচনাবলি থেকে ইসলাম ও মুসলিম প্রসঙ্গ যদি আলাদা করে দেখা হয়, তবে তাকে তথাকথিত দ্বিতীয় শ্রেণির প্রগতিশীলদের মতোই দেখাবে। কিন্তু তার সিদ্ধান্তসমূহকে বাতিল করার পরও তার হৃদয়সংবেদি ভাষা আর লেখালেখির ভেতরকার মানবিক আবেদন অক্ষয় থাকে। সমাজ রূপান্তরে তার ভাবনা সংস্কৃতিবাদী।
তিনি তিনি বেচে থাকবেন তার সাহিত্যসংশ্লিষ্ট রচনার কারণেই। স্বপ্নালু তারুণ্যের পাঠ্য থাকবেন তিনি। তিনি পঠিত হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও বাংলা বিভাগে। পোয়েটিক্সের অনুবাদ ও এটির দীর্ঘ ভুমিকা, শেক্সপীয়ারের মেয়েরা, ধ্রুপদী সাহিত্যের নায়িকারা, বাংলা সাহিত্য ও মধ্যবিত্ত (বাংলাসাহিত্য বিষয়ক তার প্রায় সব রচনার সংকলন), টলস্টয়: অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি, ইত্যাদি গ্রন্থ ও প্রবন্ধরাজি তাকে তারুণ্যের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে।
ইতিহাস রচনা শাস্ত্রের নবতম নানা উন্মোচন ও বিবেচনার কারণে এবং সংস্কৃতি-অধ্যয়ন ও সংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ে নতুন নতুন তত্ত্বায়নের প্রেক্ষিতে তার ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভাবনা টেকসই হওয়ার কারণ নেই। তার যেসব প্রত্যয় ও ভাবনাভিত্তি আর ভক্ষণযোগ্য নয়, তা আরেক আলোচনার বিষয়। তবে সাহিত্যমোদী তরুণকে ইতিহাস-নাট্যের প্রাথমিক পাঠ নিতে তার রচনার কাছে হয়তো যেতে হবে। তবে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে বৃহত্তর ও বিস্তৃত ভাবনা-পরিসরে ডানা মেলতে, যদিও অনেকে আর ফিরতে পারে না, গদগদ ভক্তিতে আটকা পড়ে থাকে।
ভক্তির বাধা অতক্রম করে স্যারকে পাঠ করতে শিখলেই আমরা সাবালক পাঠক হবো। তার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাবমূর্তি তার চিন্তা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেয়। তিনি বাঙালির শক্তি ও দুর্বলতার প্রতীক, ইতস্তত উদ্ভ্রান্ত ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে একখানি অটল দণ্ডায়মান স্তম্ভ। তিনি সময়কে প্রভাবিত করেন না, সময়ের স্রোতে অন্ত:সলিলের মতো প্রবাহিত হন। তা না-হলে তাকে নিয়ে আলোচনা কেন?
ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিশেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে আমার অনেক অদৃশ্য ঋণ রয়েছে। স্যারের সম্পাদক-সত্তার সুদীর্ঘ আয়ু প্রত্যাশা করি। স্যার সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।