প্রভাংশু সানার গদ্য, ‘সলিমুল্লাহ খান: আলোচনায় সমালোচনা’
প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২৪
বর্তমান দিনে ফেসবুক বা সমজাতীয় প্লাটফর্মে চোখ আটকে যাওয়ার মতো সাধারণ একটা বিষয় হলো, এক বা একাধিক ব্যক্তি দ্বারা সলিমুল্লাহ খান নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছেন। আমি দাবি করছি না, সলিমুল্লাহ খান সমালোচনার অযোগ্য। বরং সলিমুল্লাহ খান শতভাগ সমালোচনার যোগ্য। মোটাদাগে বলতে গেলে, তিনি তার সকল পরিচয় ছাপিয়ে বড় মাপের সমালোচক। সুতরাং, একজন সমালোচককে সমালোচনা করা অনায্য হবে না।
সলিমুল্লাহ খান লেখক, শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ প্রভৃতি পরিচয়ে পরিচিত। সলিমুল্লাহ খানকে সমালোচনা করতে গেলে আপনাকে এসবের কিছুই হতে হবে না। কবি জীবনানন্দ দাশ একদা বলেছিলেন, ‘বরং তুমি নিজেই লেখো না কো একটা কবিতা’। জীবনানন্দ পাঠক হোন বা না হোন, সকলেই এ কথার মর্মার্থ বুঝবে। জীবনানন্দ দাশকে সমালোচনা করায় উনি সমালোচকে কবিতা লিখে দেখাতে বলেছেন।
আমি মনে করি, জীবনানন্দ দাশ এক্ষেত্রে সঠিক ছিলেন না। কবিতা না লিখেও জীবনানন্দকে সমালোচনা করা যাবে। অনুরূপভাবে সলিমুল্লাহ খানকে সমালোচনা করতে গেলে আপনাকে লেখক, শিক্ষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাবিদ হতে হবে না। শুধু মৌলিক যে জিনিসের প্রয়োজন তা হলো, সলিমুল্লাহ খান সম্পর্কে দু’কলম বিদ্যা থাকতে হবে। আগেই বলেছি, সলিমুল্লাহ খান নিজে সমালোচক।
১৯৮০ সালে সলিমুল্লাহ খান জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাককে সমালোচনা করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। স্বয়ং আহমদ ছফাও এ ঘটনায় সলিমুল্লাহ খানের ওপর নাখোশ হয়েছিলেন কিন্তু জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, ছেলেটার তো ট্যালেন্ট আছে। কী লিখছে না-লিখছে হেইডা মনে কইর্যা কী লাভ। হের তো কিছু করার ক্ষমতা আছে।
সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। উনাকে দেখি টেলিভিশনের পর্দায় সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিতে। সাধারণত টকশোতে উপস্থাপক আলোচকদের জটিল ও কটিন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে চান। উপস্থিত আলোচকেরা সেই সকল প্রশ্নের যথাযথ ব্যাখ্যা দেন বা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানেই সলিমুল্লাহ খানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ধরন ভিন্ন।
তিনি সাংবাদিক বা উপস্থাপকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ইতিহাস আশ্রিত সম্পূরক আলোচনা করেন। অথবা প্রাসঙ্গিক বিষয়ের যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাগ্মীপ্রবর সলিমুল্লাহ খানের সেই সকল আলোচনা আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান, কোনো সরকারি বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠান বা সমজাতীয় অনুষ্ঠানে সলিমুল্লাহ খান যেখানে উপস্থিত থাকেন সিংহভাগ ক্ষেত্রে তিনি প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকেন।
মজার ব্যাপার হলো, কার্ল মার্ক্স, জাঁক লাকা, মিশেল ফুঁকো ও শার্ল বোদলেয়ার থেকে শুরু করে উপমহাদেশের রাজনীতি, বৈশ্বিক মন্দা, মুসলমানদের বাংলা বিজয়, পাশ্চাত্য সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তসহ সকল ধরনের আলোচনায় সলিমুল্লাহ খান সিদ্ধহস্ত। তিনি জটিল ও কঠিন বিষয়ের অবতারণা করেন অত্যন্ত সহজ সুন্দর ও সাবলীলভাবে। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন একদা সলিমুল্লাহ খান সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি যখন সলিমুল্লাহ খানের সাথে কথা বলেন তখন মনে করেন তিনি কোনো লাইব্রেরির সামনে বসে আছেন।
DW খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায় অনুষ্ঠানের দর্শক মাত্রই জানবেন, খালেদ মুহিউদ্দীনের প্রশ্নজাল কতটা বিস্তৃত। এখন পর্যন্ত দুবার সলিমুল্লাহ খান ওই অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই খালেদের প্রশ্নবাণ দুমড়ে-মুচড়ে স্বগৌরবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। প্রতিউত্তরে খালেদ শুধু সন্তুষ্টির মৃদু হাসি হেসেছেন।
শিক্ষক হিসেবে সলিমুল্লাহ খান অনবদ্য। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। কিন্তু শিক্ষকতা করছেন ব্যবসা প্রশাসন ও অর্থনীতির মতো ভারিক্কি বিষয়ে। শিক্ষক হিসেবে উনার কর্মজীবন শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে পিএইচডির উদ্দেশ্যে মার্কিন দেশে যাওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আইনের ছাত্র হয়ে তিনি পিএইচডি করেছেন অর্থনীতিতে। পিএইচডির বিষয় ছিল A theroy of money: Central banking in England 1793-1877.
এর বাইরে তিনি একজন লেখকও বটে। রচনা করেছেন কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু গ্রন্থ। অনুবাদও করেছেন কিছু গ্রন্থের। ফিনল্যান্ডের লেখক পেন্টি সারিকস্কির মতো লেখকদের রচনাও তিনি অনুবাদ করেছেন। উনার লেখনি ও বক্তৃতার সমালোচনা করার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। যুক্তিনির্ভর সমালোচনা করা অবশ্যই কর্তৃব্যও বটে। কিন্তু সলিমুল্লাহ খানকে সমালোচনা করার জন্য স্বপ্নে দেখা অবাস্তব বিষয় বা মনগড়া যুক্তি ভিত্তি হতে পারে না।
যুক্তিবাদী সলিমুল্লাহ খানকে সমালোচনা করার জন্য তার লেখনি, বক্তৃতা বা ব্যক্তিজীবন নিয়েও সমালোচনা করতে পারেন, অনেকেই বলতে পারেন, ব্যক্তিজীবন নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়, এক্ষেত্রে যেসকল ব্যক্তি অবগত নয় তাদের জন্য বলি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিজীবন নিয়ে সমালোচক মহলে ব্যাপক সমালোচিত। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ব্যক্তিজীবন নিয়ে সমালোচনা উচিত কিনা, এটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। অন্যদিন এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাবে।
অনেকেই গঠনমূলক যুক্তিনির্ভর সমালোচনা করেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী সলিমুল্লাহ খানকে সমালোচনা করার জন্য যখন উপযুক্ত কারণ না থাকলে নি:সন্দেহে তা দুঃখজনক। সমালোচকদের উচিত উপযুক্ত বিষয়ে সমালোচনা করা। আমি সমালোচকদের সমালোচনার গণ্ডি নির্ধারণ করে দিচ্ছি না। সেই অধিকারও আমার নেই। শুধু স্বপ্নের মতো অবাস্তব বিষয় বা মনগড়া যুক্তি বা সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা, এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে অনুরোধ করছি।
আমিও ব্যক্তিগতভাবে চাই, উপযুক্ত বিষয়ে সলিমুল্লাহ খান শতভাগ গঠনমূলক সমালোচিত হোক, কোনো আকাশকুসুম বিষয়ে নয়। সমালোচিত হওয়ার জন্য যোগ্য হতে হয় এবং গঠনমূলক সমালোচনা করতেও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।