প্রণব আচার্য্যের গল্প ‘নতুন গান’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০

ধরা যাক, কয়েকটি পুরুষ একটি বালিকাকে ধাওয়া করছিল। মেয়েটির গ্রীবা থেকে আমাদের কবিদের চিত্রকল্পসমূহ একে একে বিদায় নিচ্ছে। ফলে ক্রমেই মেয়েটির `মেয়েটি’ থেকে মেয়েসূচক অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছিল। এরকম একটি দৃশ্যকল্প মাথায় রেখে এবার আমরা একটি গ্রাম্য বাজারে প্রবেশ করি। বাজারটির একটি নাম দেওয়া যাক। ধরলাম বাজারটির নাম কালীবাজার। বেশ পুরোনো, দেশান্তরী হওয়ার আগে হিন্দুরা এখানে রক্ষাকালীর পূজা করতো বিধায় এই নাম দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে অবশ্য বাজারটির নাম পরিবর্তন করে কাশেম বাজার রাখা যায় কিনা এরকম একটা আলোচনা আলোচ্য বাজারের মধ্যবর্তী কালী গাছটির ডালপালায় ওড়াওড়ি করছিল। ইতিমধ্যেই অশ্বত্থ পেঁচানো কালী গাছটির কয়েকটি শাখায় বটের পাতাও গজাতে শুরু করেছে।

এবার চোখ ফেরানো যাক বাজার সংলগ্ন গেইটঅলা বাড়িটির দিকে। গেইটের লালাটে স্পষ্ট আরবি হরফে ’আল্লাহু’র জ্বলজ্বলে ক্যালিওগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এই ক্যালিওগ্রাফি থেকে আধামাইল উত্তর পশ্চিমে ধাবমান বালিকার অবস্থান— এটা মাথায় রেখে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করবো। তার আগে বাড়ির গেরস্থের একটা পরিচয় দেওয়া যাক। বাড়িটির বর্তমান মালিক যথাযথ প্রক্রিয়ায় নামের আগে হাজী শব্দটি যুক্ত করেছেন সতের বছর হয়। অভিজ্ঞ পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে আজ থেকে আঠাশ বছর আগের সেই বিশেষ বছরটির কথা? সে বছর আমাদের ভারতীয় পড়শিরা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর তার সুবাতাস এসে লেগেছিল আমাদের এই কালীবাজারেও। ধীমান পাঠক, এটিকেও মাথায় রাখবেন।

হাজী সাহেব পড়াশোনা করেছেন অবশ্য প্রবাসের মাদ্রাসায়। পাঠক, এখানে প্রবাস মানে কালীবাজারের বাইরের এলাকা। যেদিন তিনি প্রবাস থেকে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন তার দুই দিন পর গনেশের দোকানে পরোটা খেতে খেতে আমরা জানতে পারি, `‘ছোবান মিয়া বৈদেশ থিকা হাফেজ হইয়া আইছে।`’ এখানে একটি কথা বলে রাখি, বেশি নয়, তিন পুরুষ আগে হাজি সাহেবের বাপের দিকের কোনো এক মহিলা সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ ঘরের কনিষ্ঠা কন্যা ছিলেন।

এখন আসি যে বছর রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পড়শিরা উন্মাদ হলো, সে বছর এ গ্রামের এক দুপুরের ঘটনায়। শিবু ধরা পড়েছে। বেঁধে রাখতে হয়নি, সুযোগ থাকলেও সে পালায় না। শ্রীমান শিবুর পরিচয় হচ্ছে, সে এ গ্রামের সবচেয়ে বর্ষিয়ান চোর। এটা উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্ত। পাকা হাত। যাক সে কথা। বিচার বসেছে। শান্তি বাবুসহ অন্যান্য সালিসদাররা এখনো এসে পৌঁছাননি। এরই মধ্য শিবুকে তৃতীয় বারে মতো উত্তমমধ্যম হজম করতে হয়েছে। চতুর্থ বারের সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সে। উৎসাহীরা কিঞ্চিত ভয় পেয়ে নিরস্ত হয়। ভিড় থেকে সহমর্মী একজন শিবুকে একটি শেখ সিগারেট ধরিয়ে দেয়। সিগারেট টানতে টানতে শিবু এবং উৎসাহীরা সালিসদারদের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রিয় পাঠক, দয়া করে ঐ বালিকাটির কথা ভুলে যাবেন না।

অনেক তো ধান ভানলাম, এবার নিজের পরিচয়টা দিই। আমি গান লিখি। প্রচলিত আছে ব্যর্থ কবিরাই নাকি গান লেখে। আমিও কবিতায় বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে কিছু দিন হলো গান লিখতে শুরু করেছি। নিজে লিখি, নিজেই সুর করি। আমি অবশ্য কালীবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা নই। থাকি ভিন্ন গাঁয়ে। এমনকি গল্পের প্রথম থেকে যিনি রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন আমি তার কেউ নই। অথবা যারা তাকে ধাওয়া করছে তাদের সাথেও আমার কোনো পরিচয় নেই। আমি শুধু একটি গান লেখার অপেক্ষায় আছি। একটি নতুন গান। যে গানে কোনো উপমা থাকবে না। রাগ রাগীনির শৃঙ্খল থাকবে না। সুর লয় তাল কিছুই থাকবে না। কিন্তু সেটা গান হবে এবং সমবেত ভাবে গাওয়া যাবে। গানটি হবে সহজ কথার। আমার নিবাস আমার এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে।

সেদিন সালিসদাররা আর আসেনি— রাতেই তারা রেডিওতে খবর পেয়েছিল বিজেপি-শিবসেনার হনুমানেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে, ফলে সারা ভারতে এবং বাংলাদেশে অনুমেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। সঙ্গত কারণেই সেদিন সালিসি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আর তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে সালিশের জন্য অপেক্ষারত শিবু চোরা এবং অন্যান্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাজী বাড়ির ভেতর থেকে কালীবাজারের উপরে নরক নেমে এসেছিল। নায়ারে তকবির শব্দে রক্ষাকালীর আস্তানায় শেষবার রক্তের হলি খেলা চলেছিল ঠিক পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী। আর হাজী বাড়ির গেইট থেকে আধা মাইল উত্তর পশ্চিমে যে মুসলিম বালিকাটি ধর্ষিত হচ্ছিল তার কিছু দূরেই দাউদাউ জ্বলছিল একটি সম্ভ্রান্ত কায়েস্থ বাড়ি।

প্রিয় পাঠক, ধরে নিন বালিকাটি এখন তিন সন্তানের জননী। সব অতীত এখন, কালীবাজারও। আমি কাশেম বাজারের বাসিন্দা নই বলে আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি— না রক্তে, না ধর্মে। এমনকি তার সাথে আমার কোনোদিন দেখাও হয়নি। কিম্বা সে আমার প্রণয়িনীও ছিল না কোনোকালে। কিন্তু সতেরটি বছর ধরে আমি ওই ধাবমান বালিকাটির জন্য একটি নতুন গান লেখার অপেক্ষায় আছি। কারণ এখনো আমি তার চোখে ভয় কাতর হরিণের খুরের শব্দ শুনতে পাই।