প্রচলিত ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয়
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০১৮
ফেসবুকে এক হুজুরের ওয়াজ পেলাম। কী মনে করে যেন ক্লিক করলাম। হুজুর সাহেব কইতেছেন, `মা আয়েশাকে নবি বিয়ে করেছেন ছয় বছরে। নয় বছরে তুলে আনেন সংসার করার জন্য।` হুজুর আরও অনেক কথাই বললেন। কিন্তু আর এগোলাম না। সামনে হাজার হাজার মুসলমান। মাথায় টুপি পরে মনোযোগ দিয়ে হুজুরের ইসলামি কথন শুনছে।
হে পাঠক, ইসলামের মহান জীবন-দর্শনের প্রতি এইভাবে হুজুরেরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ দেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান তাদের আধ্যাত্মিক আবেগ অনুভূতি দিয়ে বিশ্বাস করছে এসব হুজুরদের বাণী ও কিস্সা। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের সমাজে ইসলামের নামে আবর্জনা স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। কোরআন-হাদিস না-পড়া দেশের শিক্ষিত সমাজও এসব হুজুরদের কথা আর কিস্সাকেই ইসলাম মনে করে ইসলামের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে।
আমাদের এই ভূমণ্ডলে নারী ও ধর্ম নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি ও বিভ্রান্তি আছে। হুজুর সাহেবরা যেভাবে ইসলামে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করে তা ভুল। কোরআন-হাদিসের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা খুবই কম। দেশের জনগণ যেহেতু একদল মূর্খ জনগোষ্ঠি, ফলে তারা হা করে টুপ করে গিলে ফ্যালে হুজুরের বয়ান। আর এদিকে, দেশের শিক্ষিত মণ্ডলী ইসলামকে পশ্চাৎপদ অকেজো একটি মতবাদ হিসেবে প্রচার করতে বেশ সুবিধে পায়।
মোহতারাম পাঠক, অবস্থা মোটেও তা নয়। এদেশে ইসলামি ফাউন্ডেশন নামে একটি অসাধারণ প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে ইসলাম বিষয়ে হাজার হাজার বই পাওয়া যায়। সবগুলোই ইসলামি দর্শনের। আমরা ক’জন সেখানে ঢুঁ মেরেছি? আমরা ক’জন কোরআনের বাংলা অনুবাদ পড়েছি? ক’জন পড়েছি দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস? জ্ঞানের এ পর্যটন নিজেকে ও মহাবিশ্বকে জানার পর্যটন। কিন্তু আমরা সে পথে না গিয়ে খোলা চোখে সমাজের দিকে চেয়ে যা দেখি, তারই নিরিখে কোনো বিষয়কে ব্যাখ্যা করে বসি। এ রকম হওয়াটা কি ঠিক?
ফেসবুকে হুজুরের যে বয়ান দেখলাম, তার ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। সে ব্যাখ্যা না জেনে নবিজি যে বাল্যবিবাহ করেছিলেন, এ কথা বলার মানে কি? আর যারা এ কথাটা গ্রহণ করছে তাদের অবস্থা হচ্ছে কি? এসব ভেবে দেখারও যেন এদেশে কেউ নেই।
চৌদ্দশো শতকের শেষদিক থেকে শুরু হয় বিশ্বে মুসলমান রাজত্বের ভাঙন। এর পেছনে কারণ ছিল, মুসলিম নৃপতিদের ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। ফলে ইসলামের যথার্থ পঠনপাঠন ও গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে পড়ল সংকুচিত। মাদরাসা ও মসজিদের আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব মওলানাগোষ্ঠি হলো ইসলামের শিক্ষক। সমাজে তাদের প্রভাব গেল বেড়ে। মধ্যযুগে যেরকম হয়েছিল ইউরোপীয় দেশগুলোতে। সেখানে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করত গির্জা। এর ফলাফল কী, তা ইতিহাসপাঠক মাত্রেই জানি।
১৪০০ বছর আগের ইসলামই নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কোরআন ও হাদিসের অনুসরণ থেকে দূরে সরে যায় মুসলমান জাতি। ইসলামি জীবনব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে নানা বেদআত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ আজকে বিভ্রান্ত। আমাদের মাদ্রাসার হুজুররা শুধু ইসলামের আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডকেই ইসলাম বলে জনগণের কাছে প্রচার ও প্রসার করে চলেছে। ফলে কমে গেছে কোরআন ও হাদিসের পঠনপাঠন ও গবেষণা। যা অনুসরণ করলে মানুষ পৌঁছতে পারত সুখি সমাজব্যবস্থায়।
মসজিদকেন্দ্রিক হুজুরদের ধর্মীয় শিক্ষক মেনে এদেশে এখন ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে, এবং ঘটছে। এই শিক্ষকেরা পড়াশোনা করে না। শর্টকাটে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতা শিখে (যা তারা একাডেমিকভাবে শিখে আসে) জনগণের ঈমামতি করে। অন্যান্য ধর্মের বিষয়ে তাদের জ্ঞান শূন্য। তারা বিজ্ঞান কিম্বা দর্শনের কোনও জ্ঞান রাখে না। এসব কারণে নিজস্ব কোনো চিন্তার ক্ষমতাও তাদের থাকে না। তারা যেন দম দেয়া কল। অথচ এদেরই ভাবনাচিন্তা গ্রাম-শহর ছাপিয়ে গেছে। রাজনীতিবিদের পরেই তারা অবস্থান করছে সমাজের জীবনযাত্রা ঠিক করে দিতে।
তাদের বিপক্ষে বলতে গেলে জীবন হুমকির মাঝে পড়ে যায়। হুজুররা ধর্মের নামে যা চাপিয়ে দেয়, অনেক সময় সেটা অপরাধের পর্যায়েও পড়ে। কিন্তু সেসব দেখার কেউ নেই।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক