পুঁজির পক্ষে পৃথিবীকে সুস্থ রাখা সম্ভব না

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২০

অক্টোবর বিপ্লবের পর মানুষ বুঝতে পেরেছিল, আগামী সভ্যতার ভিত্তি হবে সমাজতন্ত্র। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, সবাই সবার পাশে দাঁড়াবে, একসাথে আনন্দের গান গাইবে অথবা দুঃস্বপ্নের বিরুদ্ধে লড়বে। সেইমতো জাগরণও শুরু হয়েছিল দেশে দেশে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ায় লেগেছিল স্বাধীনতার ঢেউ এবং মানুষ হয়েছিল যুক্তিসঙ্গত। যা তার কাছ থেকে আশা করা হয়। সেই মহত্বের জাগরণে আমরা বাঙালিরাও বুঝতে শুরু করেছিলাম, শোষণের জটিল গণিত, পরাধীনতার কালো রঙ এবং নিজেদের আকাশকে উন্মুক্ত করার বিজ্ঞান।

যুদ্ধ করেছিলাম নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং সমষ্টির শক্তি দিয়ে বহুগুণ শক্তিশালী দানবকে পরাজিত করবার বিশ্বাসটাও পেয়েছিলাম। হয়েছিলাম স্বাধীন।

বিশ্বের এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন পুঁজির ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। তারা মানুষকে ভয় দেখাতে শুরু করেছিল অস্ত্র এবং বিলাস দিয়ে। তাতে জাগরণের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত বিশ্বের কেন্দ্রটিকে নড়বড়ে করে দিতে পেরেছিল তারা। সেইসাথে রপ্তানি করতে শুরু করেছিল হতাশা, গ্লানি আর মিথ্যা সব দর্শনের গাঁটরি। পিছনে পিছনে পাঠিয়েছিল এনজিও নামের সেইসব সংস্থাকে, যাদেরকে প্রচারের বন্যায় রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকল্প বলে দাঁড় করচ্ছিল তারা। এরাই আমাদের জাগরণ জীবনের প্রথম ঘুণ।

এই ঘুণ কেটে দিচ্ছিল আমাদের সম্পর্কের সূতাগুলিকে। অবিশ্বাসের সাপ ছেড়ে দিচ্ছিল আমাদের আলিঙ্গনের মধ্যে এবং শেষপর্যন্ত আমাদের একা করে দিয়ে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের প্রথম উদাহরণ তৈরি করে তারা। সেসময়ের করোনা ছিল সমাজতন্ত্র।

সেই যে অবিশ্বাস, সেই যে হতাশা, গ্লানি— তার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য টাকাকেই সর্বস্ব করে তুলেছিল পুঁজি। টাকা থাকলে সবকিছুই সম্ভব, ফলে যেকোনভাবে টাকা কামাও, নীতি নৈতিকতা সম্পর্ক তোমাকে বাঁচাবে না— এই আপ্তবাক্যে মুখর হয়ে উঠেছিল পুঁজির দুনিয়া। সাথে নিয়েছিল নিয়তিবাদের ধ্বজা ধর্মকে। পাশাপাশি বন্ধ করে দিয়েছিল শিক্ষার স্ফূরণ। ফলে কোনদিকেই হাতপা ছুঁড়তে না পেরে আমরা হাঁটু গেড়ে বসলাম করজোড়ে এবং বিক্রি করে দিলাম আমাদের জাগরণ, যুক্তিবোধ আর স্বাধীনতা।

পুঁজি এই সুযোগটাকে কাজে লাগালো নিজের পেট ভরাতে এবং সবকিছু বেসরকারিকরণের নামে সমাজটাকে এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলিকে তুলে দিল উচ্ছন্নের হাতে। এখন আমাকে সবকিছুই টাকা দিয়ে কিনতে হয় এবং ঠিক জিনিস পেলাম কিনা— সেই দাবি করতে পারি না। কারণ বেসরকারি দুনিয়া আমার হাতের বাইরে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উর্দিপড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। ফলে আমরা এখন ভিখারি-সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নামের মহাজনেরা যদি দয়া করে আমাদের কিছু দেয়, তাহলেই আমরা ধন্য হই।

এইরকম সময়ে করোনা মহামারি থেকে বাঁচতে আমরা কার কাছে যাব? ভিক্ষুকের কি বাড়ির মালিকের বাসায় জোর করে ঢুকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে, নাকি জবাবদিহি চাইবার জোর গলা আছে?

তবে এখন একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পুঁজির পক্ষে এই পৃথিবীকে যে সুস্থ এবং ভালো রাখা সম্ভব না, সেটা আমরা বুঝে গেছি। গেছি তো, নাকি?


লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী