পিরিয়ডের আগে মুড সুইং সামলাবেন কীভাবে

ডা. শাফেয়ী আলম তুলতুল

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২০

প্রজনন বয়সী নারীদের একটি উচ্চ শতাংশ মুড সুইংয়ে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রে পিরিয়ড বা মাসিকের আগে আগে বেশ কিছু নেতিবাচক মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট এই সময়ে অস্বস্তি, ক্রোধ, খিটখিটে মেজাজ থেকে শুরু করে মানসিকভাবে একদমই ভেঙে পড়তে পারে মেয়েরা। এই লক্ষণগুলোকে একসাথে বলা হয় প্রিমিন্সট্রুয়াল সিনড্রোম বা পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগের সিন্ড্রোম। যা সংক্ষেপে পিএমএস নামে বেশি পরিচিত। আশার কথা হচ্ছে, লাইফস্টাইল পরিবর্তন ও মেডিকেশনের মাধ্যমে এই মানসিক পরিবর্তন অনেকটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ইমোশনের রোলার কোস্টার
পিএমএস নারীকে প্রতিমাসে এক দুর্বোধ্য মানসিক যাতনার সম্মুখীন করে। কারণে অকারণে সহজেই চোখ অশ্রুসিক্ত হওয়া থেকে ক্রোধে অন্ধ পর্যন্ত হতে পারে। এরপর হয়তো আপনি একটি স্থিতিশীল মানসিক পর্যায়ে ফিরে আসবেন। এর সবকিছু একইদিনের ভেতরও ঘটে যাওয়া সম্ভব। আপনার মানসিক অবস্থার এই তারতম্যকে আপনি তখনই পিএমএস হিসেবে ধরে নিতে পারেন, যখন দেখবেন প্রতি পিরিয়ডের ঠিক এক থেকে দু’সপ্তাহ আগে থেকে এই উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে এবং পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর এক থেকে দু’দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।

নারীদের শারীরবৃত্তীয় মাসিক চক্রকে কার্যক্রম অনুসারে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যার মধ্যে শেষ পর্যায়টিতে নারী পিএমএসে আক্রান্ত হয়। যার পর শুরু হয় পিরিয়ড অর্থাৎ নতুন সাইকেল বা চক্র। আমরা জানি, নারীদেহে প্রতি মাসে ডিম্বাশয়ে একটি করে ডিম্বানু পরিণত হয়। আর এই পরিণত ডিম্বানুটি ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হওয়াকে বলে ওভুলেশন। পিএমএসের উপসর্গগুলো সাধারণত এই ওভুলেশনের দিন থেকে শুরু হয় এবং পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।

পিএমএস’র সাধারণ লক্ষণগুলো হলো, অস্থিরতা, ক্রোধ, হতাশা, কান্নাভাব, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা, উদ্বিগ্নতা এবং অবসাদ ও বিষণ্ণতা।

পিএমএস মুড সুইংয়ের গোড়ার কথা
যদিও গবেষকরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন ঠিক কী কী কারণে পিএমএস এভাবে আঘাত হানে, তবু পুরো মাসিক চক্র জুড়ে হরমোন মাত্রার ওঠা নামাকেই মানসিক এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যায়। বিশেষ করে হরমোন ইস্ট্রোজেন। পিরিয়ড শুরু হওয়া মানেই নতুন একটি মাসিক চক্র শুরু হওয়া। এ সময় থেকে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং ওভুলেশন না হওয়া পর্যন্ত বাড়তে থাকে। ওভুলেশনের সময় এটির মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। এরপর ওভুলেশনের পর থেকে পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত এর মাত্রা কমতে থাকে। পিরিয়ড শুরু হওয়ার প্রাক্কালে এর মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

এরপর পিরিয়ড শুরু হলে আবার আগের মতো এর মাত্রা বাড়তে শুরু করে। প্রতিমাসে হরমোনের এই কমা-বাড়ার সাথে বাড়ে-কমে নারীদের মুড সুইংসহ পিএমএসের অন্যান্য উপসর্গ। দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা বা স্ট্রেস, যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ, বেকারত্ব, একাকিত্ব ইত্যাদি পিএমএস হওয়ার জন্য দায়ী নয়। তবে নিঃসন্দেহে এটি পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। কিছু গবেষণায় বলা হয়, নারীবিশেষ হরমোনগুলো কিছু ব্রেইন কেমিক্যালকে কমিয়ে মুডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন, সেরেটোনিন। এ বিষয়ে আরও বেশি গবেষণার অবকাশ আছে বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। উল্লেখ্য, সেরেটোনিনের মাত্রা কমে গেলে হতাশা, বিষণণতা, অস্থিরতা এবং শর্করা খাবারের প্রতি তীব্র আসক্তি তৈরি হয়।

সিভিয়ার পিএমএস: বাঁধভাঙা মুড সুইং
তিন থেকে আট শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনেক বেশি গুরুতর আকার ধারণ করে। এই কন্ডিশনটির নামকরণ করা হয়েছে প্রিমিন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার বা পিএমডিডি। পিএমডিডির ভুক্তভোগীরা পিরিয়ড শুরু হবার আগের এই এক দু সপ্তাহে গভীর হতাশায় ডুবে যান এবং প্রচণ্ড অশান্তি অস্থিরতা বোধ করেন। পরিবারে ডিপ্রেশন রোগটির ইতিহাস থাকলে, বা রোগীর নিজের যদি প্রসবপরবর্তী ডিপ্রেশনের (পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন) ইতিহাস থাকে, তাদের পিএমডিডি হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি।

পিএমডিডি নিশ্চিত করতে, পিরিয়ডের প্রাক্কালে নিচের উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্তত পাঁচটি উপসর্গ থাকতে হবে:
গভীর হতাশা ও দুঃখবোধ, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা।
দীর্ঘক্ষণের ক্রোধ ও অস্থিরতা, প্রিয়জনের উপর ক্রোধে ফেটে পড়ার নজির।
দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা।
আতংকগ্রস্ততা।
মুড সুইং।
কান্না।
দৈনন্দিন কাজ ও মানুষের সাথে সম্পর্কগুলোতে অনীহা।
মনোযোগহীনতা।
নিজের নিয়ন্ত্রনের বাইরে হতবিহ্বল বোধ।
অবসাদ।
ক্লান্তি।
অহেতুক অতিরিক্ত ক্ষুধা।

এই লক্ষণগুলো পিএমএসের মতোই পিরিয়ড শুরু হওয়ার সাথে সাথে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। যদি তা না হয়ে এটি সারা মাসব্যাপী স্থায়ী হয়, তবে এটি পিএমডিডি নয়। এর পেছনে আপনাকে খুঁজতে হবে অন্য কোনও মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা।

পিএমএসের চিকিৎসা
অনেকে কেবল মাত্র লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে পিএমএস প্রতিরোধে সফল হন। অনেকের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। কিছু টেকনিক ও কিছু ট্রিটমেন্ট মাসের এই বিড়ম্বিত সপ্তাহগুলোতে আপনার জন্য অনেকটা সুফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। যেমন:

ব্যায়াম
কায়িক শ্রম আমাদের ডিপ্রেশন কমাতে ও মন প্রফুল্ল রাখতে ভূমিকা রাখে। বলা হয়ে থাকে, এক্সারসাইজের সময় ব্রেইন থেকে এন্ডোরফিন নামের একটি কেমিক্যাল বের হয়, যেটি আমাদের মাঝে একধরনের সুখানুভূতি তৈরি করে, এবং পিএমএসের জন্য দায়ী ক্ষতিকর হরমোনগুলোকে প্রতিহত করে।

এক্সাইসাইজ আমাদের এনার্জি লেভেলকে বুস্ট করে আমাদেরকে কর্মোদ্যম করে তোলে। অ্যারোবিক এক্সারসাইজ যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো ও সাঁতারকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে।

পরিমানে কম, কিন্তু বারেবারে খাবার
দিনে দুটি বা তিনটি বড় মিলের পরিবর্তে, সারাদিন ধরে ছোট ছোট মিল নিতে হবে। কারণ অনেকখানি খাবার একসাথে, বিশেষ করে শর্করা খাবার খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাবে, যাকে ব্লাড সুগার সুইং বলা হয়, যার ফলে পিএমএস প্রচণ্ড আকার ধারণ করবে। আবার দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গেলে, অস্থিরতা বোধ হবে, এমনকি কান্না আসতে পারে। তাই সারাদিনের খাবারকে ছয়টি ছোট ছোট মিলে ভাগ করে নিয়ে খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা স্থিতিশীল থাকবে।

ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট
ক্লিনিক্যান ট্রায়ালে দেখা গেছে, যেসব নারী ৫০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুবেলা ক্যালসিয়াম গ্রহণ করেছেন, তারা অন্যান্যদের চেয়ে হতাশা ও অবসাদের শিকার কম হয়েছেন। অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার পিএমএস ও তৎসংক্রান্ত মুড সুইং এর উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যদিও কীভাবে এটি কাজ করে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ক্যাফেইন, অ্যালকোহল ও মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার
পিরিয়ডের দুই সপ্তাহ আগে থেকে যদি কফি ও ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় গ্রহণ না করে থাকা যায়, তবে মুডের উপর এর ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। কারণ ক্যাফেইন আমাদের অস্থিরতা বৃদ্ধি করে এবং ইনসোমনিয়াতে ভোগায়। অ্যালকোহল পরিহার করার সুফলও পাওয়া যাবে। কারণ অ্যালকোহল আমাদের বিষণ্ণ করে। এছাড়া ক্যান্ডি, সোডাযুক্ত কোমল পানীয়, মিষ্টি খাবার পরিহার করে রক্তে শর্করার পরিমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যেহেতু রক্তে শর্করার তারতম্য মুডের তারতম্য তৈরি করে।

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
স্ট্রেস পিএমএসকে সবচেয়ে গুরুতর করে তোলে। সুতরাং, স্ট্রেসের কারণ উদঘাটন ও প্রতিকার জরুরি। ধ্যান, যোগাসন, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মত কিছু শিথিলায়ন চর্চা করা ভালো। প্রয়োজনে, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য কাউনসেলিং ও সাইকোথেরাপী নিতে হবে।

কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট যেমন সেলেক্টিভ সেরেটোনিন রিআপটেইক ইনহিবিটর রক্তে সেরেটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে পিএমএস ও পিএমডিডি উপশমে সাহায্য করে। ডাক্তারকে আপনার পিএমএসের লক্ষণগুলো বলুন এবং তার কাছ থেকে আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো অ্যাপ্রোচটি জেনে নিন। তারও আগে পিএমএস সম্পর্কে জানুন ও জানান। এই সচেতনতা একদিকে যেমন আপনাকে আপনার শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলাতে সাহায্য করবে, তেমনি আপনার পরিবার পরিবেশকে, বিশেষ করে আপনার সঙ্গীকে, আপনার প্রতি সহমর্মী করে তুলবে।

লেখক: প্রভাষক, মাইক্রোবায়োলজী, ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা