পিটার হান্ডকে

পিটার হান্ডকে

পিটার হান্ডকের কবিতা ‘শিশুবেলার গান’

বাঙ্লায়ন: জুয়েল মাজহার

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০২০

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল
হাঁটতো-চলতো নেড়েনেড়ে দুই হাত
চেয়েছিল ছোটো নদী হোক বড় নদী
আর নদী হোক খরবেগ দুদ্দার,
এঁদো ডোবাখানি বিশাল সাগর হোক

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল
সে যে শিশু, নিজে সেটাই জানতো না
সবকিছু ছিল গভীর আবেগে ভরা
বাঁধা ছিল প্রাণ সকল প্রাণের সুরে

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
ছিল না মোটেই কারোর সাতে বা পাঁচে,
ছিল না কিছুই যাকে বলে অভ্যেস

পায়ের উপর আড়াআড়ি পা’টি তুলে
বসতো, বসার পরেই লাগাতো দৌড়,

ছবি তুলবার সময় মুখটি তার
ঢাকা পড়ে যেত কপাল-গড়ানো চুলে;

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
সেটাই সময় ছিল যে জিজ্ঞাসার:
আমি কেন আমি, তুমি কেন নও আমি?
এইখানে আছি, সেইখানে কেন নই?
সময়ের শুরু কখন হয়েছে, আর,
এই আকাশের কই বলো অবসান?
জীবন কি নয় স্বপ্নের ভ্রম এই সূর্যের তলে?
আমি যা দেখছি, আমি যা শুনছি, আমি যে গন্ধ পাই
এসব কি নয় পৃথিবীর মিছে মায়া,
এসব কি নয় এর আগেকার
আর কোনো পৃথিবীর?
শুভ-অশুভের কত না কাহিনি শুনি!
অশুভ নামের আসলে কিছু কি আছে?
এই ‘আমি’, মানে, আজকের এই আমি,
জন্মের আগে ছিলাম না কেন তবে?
কেন একদিন থাকবো না আর ‘আমি’?

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
ভাতের দলা ও মটরের দানা এবং পালংশাক,
সেদ্ধ করা সামান্য ফুলকপি
খেতে গিয়ে তার গলায় আটকে যেত;
কিন্তু এখন দিব্যি সে খায় সবই
এমন তো নয়, না খেয়ে উপায় নেই!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
এক রাত্তিরে ভেঙে গেলে তার ঘুম,
দেখলো নিজেকে আর কোনো বিছানায়;
—এমন ঘটনা এখনো তো ঘটে যায়।
তখন যাদের চেহারায় ছিল জাদু,
কপালের ফেরে অনেকের সেই রূপ,
ঝরে গেছে আজ, লাবণ্য নেই কোনো

দু’চোখে ভাসতো বেহেশতি উদ্যান,
আজ ফিকে সেই স্বর্গের ছবি
আছে শুধু ভাবনায়;
—আজ কিছু নেই! ধু-ধু শূন্যতা, হৃৎকম্পন ছাড়া!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
থাকতো খেলার আহ্লাদে মশগুল,
সেই উৎসাহে যদিও পড়েনি ভাটা;
তবু তাতে আজ বাদ সাধে শুধু কর্মের উদ্বেগ!

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
ভরে যেত পেট একটা রুটিতে,
একটা আপেল খেয়ে;
—এখনো দিব্যি এটুকু হলেই চলে;

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
মুঠো ভরে যেত কয়েকটি জামফলে;
—ভরে ওঠে আজও যেমন ভরতো আগে,

কাঁচা আখরোট খেয়ে মুখ বিস্বাদ
যেমনটি হতো, এখনো তেমন হয়

উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পরে
আরও উপরে উঠতে চাইতো মন;

যেত যে-শহরে, তারও চেয়ে ঢের বড়
শহর-ভ্রমণে যাবার জাগতো সাধ,
সেই প্রিয় সাধ অবিকল আজও আছে;

লোভাতুর শিশু পাড়তে চেরির ফল
গাছ বেয়ে-বেয়ে উঠে যেত মগডালে
—সরল সে-লোভ, উচ্ছ্বাস অমলিন;

অচেনা লোকের সামনে লজ্জা পেত;
এখনো তেমন, এখনো লাজুক সে
থাকতো যেমন, এখনো অধীর থাকে
প্রথম তুষারপাতের অপেক্ষায়

শিশুটি যখন আসল শিশুটি ছিল,
গাছ তাক করে ছুড়ে দিতো তার লাঠি

বর্শার মতো সেই লাঠি পাক খেয়ে
সেইখানে আজও অবিরত কেঁপে যায়

কবি পরিচিতি: পেটার হান্ড‌কে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত জার্মানভাষী অস্ট্রীয় সাহিত্যিক। ১৯৪২ সালের ৬ ডিসেম্বর তার জন্ম। ২০১৯ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একইসঙ্গে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, কবি, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণও করেছেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করছেন।

১৯৬৫ সালে দ্য হর্নেট্‌স উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ। এ সরো বিয়ণ্ড ড্রিম, মোরেভিয়ান নাইট, দ্য গোলিস অ্যাংজাইটি অ্যাট দি পেনাল্টি কিক এবং রেপিটিশান ইত্যাদি তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ক্যাস্পার একটি যুগশ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে খ্যাত। এই নিরীক্ষামূলক নাটকে হান্ড‌কে মানুষের মুখনিঃসৃত ভাষাকে ‘নির্যাতনের মাধ্যম’ হিসাবে চিত্রায়িত করেন।

২০১৯ পর্যন্ত পেটার হান্ড‌কের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮০টিরও বেশি। তার গদ্যশৈলী কেবল অনবদ্যই নয়, তা একেবারেই মৌলিক ও তুলনারহিত। তার রচনায় ফুটে উঠেছে মানুষের অন্তর্প্রদেশ কীভাবে অসংখ্য অন্তর্লীন ঝঞ্ঝায় উদ্বেলিত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকে। এই হ্রদয়সংবেদিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পসম্মতি—তার রচনাকে করেছে অনবদ্য। তার বিশ্ববীক্ষা ১৯৭০ এর দশক থেকে মানুষকে প্রভাবান্বিত করে চলেছে; মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে।

বিস্তৃত অভিজ্ঞতার সঙ্গে হৃদয়ের অতল উপলব্ধি তার বয়ানকে করেছে অনন্যসাধারণ। তার লেখায় ফ্রান্‌ৎস কাফকা, উইলিয়াম ফকনার, রোলাঁ বার্থ ও ফ্রেইডরিখ হোল্ডার্লিন এর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ পরিলক্ষিত হয়। তার ভাষা ও লিখনশৈলী সম্পূর্ণ মৌলিক ও অনন্যসাধারণ।