চয়ন খায়রুল হাবিব (সামনে) ও পেছনে লেখক
পাহাড়ি মদ: প্রাইং
কাজল শাহনেওয়াজপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৫, ২০১৮
জলপাইর জেলি বানানোর পর সন্ধ্যায় অনেক দিন পর পাহাড়ি প্রাইং পান করা হল। সুদুর খাগড়াছড়ি থেকে কবিতা অন্তপ্রাণ নয়ন ভাই নিয়ে এসেছে। তার এক পাহাড় উন্নয়ন করা ‘মস্ত বড় অফিসার’ বন্ধু দিছে। প্রায় ১০ লিটার থেকে কিছু খেতে পারছে, অনেকটাই রেস্ট হাউসের ছাদে রেখে আসছে। আর ভয়ডর বুকে নিয়া ঢাকা আনছে দু্ই লিটার। অত্যন্ত উন্নত মানের ছিল জিনিসটা। প্রাইং এ পাহাড়ি হার্ব দিতে হয়। মনে হয় যে বানাইছে, তার মনটা খুব ভাল। তিনজনে অর্ধেকের বেশি পান করা গেল না।
গতকাল সারাটা দিন গা থেকে প্রাইংয়ের গন্ধ বেরুচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কোনো শুওর-ফার্মে ঢুকে বসে আছি। দুতিনটা ঘোৎঘোত করছে আশপাশে। একটা পাহাড়ের ঢালে খামারটা। একটা শাদা, দুটি কালো।
হঠাৎই মনে পড়ে গেল আরেকটা দিনের কথা। ২০১০এ, রাঙামাটি! সেদিনও তিনজনই ছিলাম। চাটগাঁ গেছিলাম আলম খোরশেদের ‘বিস্তার’ এ কবিতা পড়তে। তখন চয়ন খায়রুল হাবিব বলল, চলেন রাঙামাটি। সেখানে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, শহর থেকে কিছুটা দূরে– নাম মোনঘর। ওদের গেস্ট হাউসে থাকা যাবে। সাথে কফিল আহমেদ।
বাস শহরে ঢোকার আগেই নেমে গেলাম। বেবিতে বাকি পথটা যাবার পর বিরাট গেট। আমাদের হোস্ট হিসাবে যাকে ঠিক করে এসেছি, উনি নাই। তবে ওনার পরিচয় আর আমাদের বেশভুসা দেখে গেস্ট হাউসে রুম খুলে দিল। ব্যাগটা রেখে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি, সামনে টেম্পাংশালা। বালক শ্রমণরা হাঁটাহাঁটি করছে ঘাসের উপর। কিন্তু কাউকে খেলতে দেখলাম না। জিজ্ঞাসা করতে বলল, আমাদের খেলার নিয়ম নাই।
চয়ন ২০ বছর আগে এসেছিল আসছিল এখানে, সেই পরিচয়। রাতে ঝিমিত দা’র বাসায় আহারের দাওয়াত। পরের দিনগুলি হোটেলে খাবো ঠিক হল। বৌদি আমাদের বিস্মিত, মুগ্ধ ও ঈর্ষায় নিপতিত করল। খাবার আগে আড্ডায় উনি চয়নকে বললেন, কুড়ি বছর আগে আপনার এক কবিতায় একটা ফুলের নাম পেয়েছিলাম। সেটা এখনো আমার মনে আছে। আমরা তিনজনই তাৎক্ষণিক ভাবে সেই বিদূষিনীর প্রেমে পড়ে গেলাম। সবাই তার আজকের মন জয় করার তীব্র ইচ্ছা পোষণ করতে থাকলাম।
আমি সহজেই আমার কবিতা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম। হয়ত আমার তখনকার সদ্য নির্মিত স্পষ্ট কবিতাগুলির জন্য। তার পাহাড়ি ঢং কিন্তু পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে কথা বলা খুব মুগ্ধ করল, যখন বললেন, কাজল দা, আরেকটা কবিতা শোনাবে? আমি পাহাড়ের পায়ের কাছের সেই বাড়িটার সব কিছুতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তার হাতের রান্না, নিকানো উঠান, পরিষ্কার চাপকল, মাসরুম চাষ।
ঝিমিত দা হেডমাস্টার। আমরা নাম দিলাম দুষ্টুমাস্টার। পাহাড়িদের প্রাইং খাওয়া সামাজিক রীতির মধ্যেই পরে। কিন্তু উনি কিঞ্চিত বেশি ভক্ত। তাই আমাদের গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল। পরের দিন সন্ধ্যায় নিয়ে গেলেন রাঙামাটি শহরে। ওদের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। সবজি তরিতরকারির দোকান ঘাটাঘাটি করে যেতে হয়। উদ্দেশ্য সেখানে বসে কফিলের গান শোনা। যন্ত্রপাতি সহকারে। গতরাতের ঈর্ষাময় কবিতা পাঠের মত যাতে না হয়, সেজন্য চয়নকে বেশ বিদেশি কবি বলে প্রচার করা হল। তাতে কিছুটা খুশি। কফিল গান ধরল।
এইগান সেই গানের পর গাইল চর্যার সুর আশ্রিত গান। তারপর চর্যাগীতি। সবাই চুপ করে শুনছে। পাহাড়ি বন্ধুরা অবাক হয়ে গেল। এ’তো ওদের গান। কথাবার্তাও। দর্শন। চিত্রকল্প। ঠিক হল কফিল ঢাকা গিয়ে এটা নিয়ে কাজ করবে! কিন্তু তা আর হলো কই?
এই প্রসঙ্গে বলি, ইদানীং ঢাকায় একটা গ্রুপ ভাটিয়ালী সুরে চর্যার গান গাইতে চাচ্ছে। কিছু শুনেছি আমি। মোটেও ভাল লাগে নাই। মনে হয় ইতরামি করতেছে গায়ক। রোমান হরফে বাংলা লেখার মত। চর্যার একটা সুর আমাদের ধাতস্থ হয়ে গেছে। সেই সুরে পাহাড়ির মন টানে। হাওরে মাছধরা নিকারির প্রাণ কাঁদে। একটা প্রাচীন কান্নার টানাটানা সুর।
গানের সাথে সাথে আমরা প্রাইং খাচ্ছিলাম। এক সময় মত্ততা নেমে আসে সেই ঘরে। মনে আছে আমি ঝিমিত বাবুর গলা জড়িয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলাম। বলছিলাম, ঝিমিত দা, আমি তোমাকে বিয়া করব। মনে হয় গতরাতের মুগ্ধতা আমার মাথায় ছিল। ঝিমিত দা রাজি হল কিনা মনে নাই। তবে মনে আছে খুব হ্যাচর প্যাচর করে আমাদের বেবিটেক্সিতে তুলছিল চয়ন। ও খুব একটা পান করে না বলে রক্ষা।
সেই রাতেই আরেক ঘটনা হল। চয়ন কফিলকে গান দিয়ে মুদ্ধ করতে দেখে ভীষণ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওর তো কিছুই করার নাই তখন। অনেক গভীর রাতে, আমি আর কফিল যখন ভীষণ নিদ্রিত, হঠাৎ তীব্র চীৎকার করে ওঠে চয়ন। ‘আপনেরা এখনই গেস্টহাউস থেকে ঢাকা চলে যান।’ আমরা প্রথম বুঝতে পারি নাই, ঘটনা কি। মিনিট দশেক চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে একটা কথাই বুঝা গেল, ও বলতে চাইছে, আমরা ওর পরিচয়ে এখানে আসছি, আর কী না প্রতিদিন ওকে অপমান করে যাচ্ছি, এটা সহ্য করা যায় না! গায়ের জোরে আমাদেরকে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। শীতের রাতে আমরা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে জলপাই গাছের নিচে পাতা একটা বেঞ্চিতে বসলাম। রাগে আর শীতে শরীর কাঁপছে।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শুনি কারা যেন টিপটিপ পায়ে হাটছে। এত ঘন কুয়াশা, স্পষ্ট করে কিছু দেখা যায় না। পাহাড়ের উঁচু নিচু ট্যারাইনে ফাকফুক দিয়ে হালকা বাতাস বইছিল। ‘শিশিরের পায়ের শব্দ’ আসলে। নিজেরা ভিজতে থাকলাম কুয়াশায়। টের পেলাম পাকা জলপাইয়ের গায়ে শিশির জমে জমে ভারি করে তুলছে। মাঝে মাঝে জলপাই ঝরে পড়ছে টুপটুপটুপ করে। কফিল কে বললাম, দেখছেন, সমতল থেকে পাহাড় খানিকটা আলাদা।
কফিল পাগলাটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল নানা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। ও বন্ধুদের প্রশংসা খুব পছন্দ করে। কিন্তু কিছু পান না করা মানুষরে সাইজ করা কঠিন। তারপর যদি সে ঈর্ষাকাতর হয়! পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। আমরা দলবেঁধে গেটের বাইরে একটা বেড়ার ঘরের চা দোকানে নাস্তা করতে বসলাম। একদিকের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখতে দেখতে পরোটা ভাজি ডিম খেলাম। দেখি পাশে বসে এক তরুণ গেরুয়া খাতুরি কলা আর চা খাচ্ছে। পরিচয় হতে বলল উনি একজন ভান্তে । বললেন, দুপুরের পর থেকে তো আমরা কোনো খানা খাই না, তাই কলা খেয়ে বাড়তি ক্যালরি নিচ্ছি। সামনেই তার প্রতিষ্ঠান। পরিচয় সূত্রে বোঝা গেল উনি ইউরোপে থেকে এসেছেন কিছু বছর। দেখলাম চয়নের চোখ চকচক করে উঠল। ওতো ফ্রান্সে থাকে। এইবার খাপে খাপ হবে। আমি আর কফিল মুচকি হাসলাম। তবে ভান্তেকে দেখলাম ডান গালে হাসেন। দেখে মনে হল কাল বা পড়শু তার ওখানে যেতে হবে। ডান গালে হাসা লোকেরা গভীর বুদ্ধিমান হয়।
বেলা বাড়তে লাগল। ঝিমিত দা স্কুলে। তবে তার লোক এসে প্রাইং দিয়ে গেছে। আর একটা চিরকুট, হেডমাস্টার বাবুর। সেখানে লেখা, ‘কম খাবেন’। চয়ন বেশ কিছু বছর লন্ডনে মদের দোকানে ম্যানেজারি করেছে, বেশ কিছু ট্রেনিংও আছে। তবে কখনোই এক চুমুকের বেশি খেতে দেখি নাই। ওর শরীর প্রাকৃতিক ভাবেই মাদকময়।
দিনের বেলা কফিল খাবে না। ফলে আমি ছোট্ট একটা বোতলে খানিকটা নিলাম। আমরা উদ্দেশ্যহীন ভাবে পাহাড়ে চিপাচাপা দিয়া চলতে থাকছি। কিছুদূর গিয়ে স্কুল বাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর কয়েকটা টিলা। মনে হচ্ছে আধাঘন্টা হাটা হল। চয়ন তার হ্যান্ডিক্যাম বের করে ছবি টবি তুলছে। একটা শুকনা ছড়া মতন দেখা গেল। বিরল একজন লোক পাওয়া গেল, বলল ঐটা গঙ্গা! এর শেষ মাথায় আমরা গঙ্গাপূজা দেই।
গঙ্গা! মানে স্রোতস্বীনি? বাহ। কফিল গেয়ে উঠল ওর বিখ্যাত সেই গান, ‘গঙ্গা বুড়ি…’ চয়ন তো দেশে থাকে না বহুদিন। কফিলের গানের ব্যাপারটা ওর কাছে নতুন। ছড়া ধরে আধা কি.মি. যাবার পর দেখি পানি। গ্রামের শেষ প্রান্ত মনে হয়। পাহাড়ি দেবতার পূজা দেয়া হয় এখানে। সকালেই কেউ দিয়ে গেছে, কিছু উপকরণ তখনো দৃশ্যমান। একটা উঁচু পাথরখণ্ড থেকে ঝিরঝির করে পানি পড়ছে। কিন্তু নিচে বেশ গলাডোবা পানি। যেন এক প্রাকৃতিক স্পা। আমি ও চয়ন সেখানে নামলাম। কাপড় চোপড় খুলে ফেলেছি, গায়ে সুতাটাও নাই। কফিল অবশ্য আমাদের পরিকল্পনায় সায় দিতে পারল না। সে চয়নের হ্যান্ডিক্যামটা নিয়ে আনাড়ি হাতে আমাদের কর্মকাণ্ড শ্যুট করতে লাগল।
আমরা স্পা তে গা ডুবিয়ে রোদ পোহাতে থাকলাম। কাদা দিয়ে গা ঘসলাম। পানি ছিটালাম। উঠে এসে ছড়ার নালাটাকে ন্যুড ঝিরি বানিয়ে তার ট্রেইল ধরে হাটাহাটি করলাম জন্মদিনের পোষাকে। কফিল বেশ নিপুণ ভাবে সেই সব দৃশ্য তুলে নিল। তবে পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপা, যান্ত্রিক গোলযোগে হ্যান্ডিক্যামে কোন কিছু রেকর্ড হল না। কফিলের অদক্ষতা সে যাত্রায় পাবলিক নগ্নতার হাত থেকে আমরা বেঁচে গেলাম। থাকলে, চয়ন নিশ্চয়ই কোনো প্রতিহিংসাপরায়ণ রাতে তা প্রকাশ করে দিত! বিদেশে থেকে থেকে ও তো যথেষ্ঠ নিঃসঙ্গতায় ভোগে!
ফেরার সময় দেখি, একটা পাহাড়ে ঢালের দিকে শুয়োরের খামার। সেখানে দুটি পোয়াতি শুয়োর। একটা শাদা, একটা কালো। পৃথিবীর নির্জনতম পাহাড়ে প্রাণি দুটি আমাদের দেখে ঘোৎঘোৎ করে উঠল। কী করুণ নিরিবিলি কাতর চোখ ওদের। গর্বিনী মা দুজনকে আমাদের কাছে মনে হলো দুটি কবি। কিছুদিন আগে মরে যাওয়া আমাদের দুজন ভীষণ প্রিয় কবি। এই পাহাড়ে আবার প্রাণ নিয়েছে। সাদাজন আবিদ আজাদ আর কালোজন মুস্তফা আনোয়ার। আমরা ওখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।
টেম্পাংশালার কাছের নৈর্ব্যক্তিক ঘরটায় আর ফিরতে ইচ্ছা করল না। মোনঘর হল বর্তমানের ডাকঘর। বালক বালিকাদের মনের মধ্যে চিঠি বিলি করা তার কাজ। কিন্তু আমরা আরো গভীর বেদনার মধ্যে ডুবে গেছি। নিজের দেশের মধ্যে অভিবাসী মানুষগুলির সাথে। প্রাইং দুদণ্ড অন্যমনষ্ক করে দিতে তো পারেই!
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক