পাহাড়িরা মানুষ না এলিয়েন?
ফরিদ সুমনপ্রকাশিত : মে ২৪, ২০১৯
প্রথমেই নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি নিজেকে সভ্য মানুষ মনে করেন কীনা। সভ্য বলতে যুক্তিবোধসম্পন্ন সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষ কীনা। উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে পরের প্রশ্ন। আর উত্তর যদি ‘না’ হয় তাহলে এই লেখাটি আপনার আর না পড়লেও চলবে। আপনার জন্যে পরে হয়তো কোনো সময় লিখবো।
সভ্যতা যদি বোঝেন, তাহলে আপনি সার্বজনীনতাও বুঝবেন। বহু জাতির, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের, বহু সংস্কৃতির সহাবস্থানেই এই পৃথিবী— এটাও বুঝবেন।
আজকে সন্ধ্যায় আপনি যে আরবের খেজুর, ব্রাজিল বা ভারতের আপেল, মিয়ানমারের ছোলা, পাকিস্তানের আঙ্গুর দিয়ে ইফতার করলেন, এসব খাবারে কতো জাতির, কতো ধর্মের মানুষের ছোঁয়া আছে, কল্পনা করুন। অর্থাৎ আপনার বেঁচে থাকার পেছনে নানা জাতের মানুষের পরিশ্রম আছে, অবদান আছে, ভালোবাসা আছে, যত্ন আছে। সৃষ্টিকর্তা এভাবেই পুরো পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই তৈরি করেছেন। কাউকে ছাড়া কেউ বাঁচার সুযোগ নেই।
ঠিক এই কারণেই অন্য জাতির, অন্য ধর্মের, অন্য সংস্কৃতির, অন্য ভৌগোলিক কাঠামোর মানুষকে আপনার শ্রদ্ধা করতে হবে। যাকে তার মতো থাকতে দিতে হবে। যার যার বিশ্বাস তাকে তাকে লালন করতে দিতে হবে।
ঠিক একই কারণে মোগল আমল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চল ‘বিশেষ অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃত। (এখানে ইতিহাসের একাডেমিক আলাপটা উহ্য রাখছি)। পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের আইনেও এখনো ‘বিশেষ অঞ্চল’। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্য ৬১ জেলা থেকে একেবারেই আলাদা এই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা অনেক আদিকাল থেকে বসবাস করলেও মোটাদাগে এটা বাঙালিদের বহুল-বসবাসের অঞ্চল কখনোই ছিলোনা। প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাছাকাছি অঞ্চলগুলো থেকে জীবিকার তাগিদে ধীরে ধীরে বাঙালিরা এসেছেন। পাহাড়িরাও আশেপাশের অঞ্চলে গেছেন। দুয়ের মিথষ্ক্রিয়ায় এখানকার জনজীবন ধীরে ধীরে খুব প্রাকৃতিক নিয়মে এগিয়েছে এবং সমৃদ্ধ হয়ে হয়েই এগিয়েছে।
পাহাড়িদের সমতলে যাওয়া অথবা বাঙালিদের পাহাড়ে আসাতে কেউ কখনোই আপত্তি করেনি। যতক্ষণ না রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ট্রাকভর্তি করে করে লোক এনে পাহাড়ে নামিয়ে না দিয়েছে। দেশের নদীভাঙ্গন এলাকাসহ অন্যান্য এলাকার হতদরিদ্র মানুষকে পূণর্বাসন করার পেছনে তখনকার রাজনৈতিক অভিসন্ধি কী ছিলো, সে প্রশ্ন না তুললেও বাস্তবে এইটুকু বোঝা গেছে, সেই পূণর্বাসিত লোকজন (প্রচলিত ভাষায় সেটেলার), আমি বলি পরিবেশ-উদ্বাস্তু, তারা পাহাড়েও ভালো নেই। কখনোই ভালো ছিলোনা। সমতলের নদী অববাহিকার মানুষ পাহাড়ের প্রকৃতিতে ভালো থাকতে পারেনা। তারা বংশগতভাবেই এই জীবনে অভ্যস্ত নয়।
এই ভালো-না-থাকা, অসুখী, অভাবী মানুষগুলোকে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের টুল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই অস্থিরতা ও অশান্তির সুযোগ নিয়েছে অনেকগুলো দেশি-বিদেশি মহল। বারেবারে রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পাহাড়। বাঙালিরও রক্ত ঝরেছে, পাহাড়িরও রক্ত ঝরেছে। তাতে পৃথিবীতে ভালোবাসা বাড়েনি, ঘৃণা বেড়েছে।
যখন রাস্তা ছিলোনা, পায়ে হেঁটে সমতল থেকে পাহাড়ে আসতে আপনার বাবার, দাদার বা পরদাদার অনেক কষ্ট হয়েছে। যারা অনেক কষ্ট করে পাহাড়ে এসেছে, তারা পাহাড়ের হৃদয়ের স্পন্দনও বুঝেছে। পাকা রাস্তা হওয়াতে এখন আর পাহাড়ে আসতে কষ্ট হয়না, তাই পাহাড়ের দুর্গমতা, পাহাড়ের একাকীত্ব, পাহাড়ের জীবনসংগ্রাম, পাহাড়ের কান্নাও আপনি বুঝতে পারেন কম।
আপনাদের অনেকের কাছে এখন পাহাড় হয়তো বিত্তশালী হবার উর্বর ভূমি, বিলাসিতার লাসভেগাস বা নিতান্তই নিরীহ ঠিকানা। কিন্তু সেই আদি আমল থেকে আপনার বাবা, দাদা বা পরদাদার মতো কোর্ট-কাচারি না চেনা, দলিল-দস্তাবেজ না বোঝা মানুষগুলো, যাদের আপনি সাপ্তাহিক বাজারের দিনে কলার মোচা, কচু শাকের আঁটি বা বাঁশকরুল নিয়ে বসে থাকতে দেখেন, তাদের কাছে এই পাহাড়ই বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়। তাদের অনেকেই এখনো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাষা পড়তে শেখেনি, লিখতে শেখেনি, দলিল-দস্তাবেজ বানাতে শেখেনি। ভাষার সীমাবদ্ধতা, উন্নয়নবিমুখ নিভৃতচারী আদিম জীবনসহ নানা কারণে তারা সমতলের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মেলাতে পারেনি। এছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃত্বশূণ্যতাসহ বিবিধ কারণে পাহাড়িদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো বাংলাদেশের সামগ্রিক চরিত্রের সাথে যায়না।
বাংলাদেশে বাঙালিরাই বৃহৎ জনগোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই একজন বাঙালি হিসেবে আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়িত্বই হলো দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া বা সংখ্যায় কম যে, তাকে স্থান করে দেওয়া বা নিদেনপক্ষে তার স্থানটুকু তার জন্যে রেখে দেয়া।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কী?
৫/৬ টা মুসলিম পরিবার, বছর চার-পাঁচেক হয় পাহাড়িদের এলাকার আশেপাশে জমিজমা করেছে। পথচারীসহ ১০-১২জন মুসল্লীও হয় না, এমন জায়গায় একটা মসজিদ বানিয়ে ফেললেন। সেই মসজিদের মাইকে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয়। আজানের ধ্বনি খারাপ নয়, কিন্তু ১০-১২ জন মুসল্লীকে নামাজের বার্তা দেবার জন্যে মাইকে আজান দেওয়াটা ওই এলাকায় আরো অনেক আগে থেকে বসবাস করা বেশি সংখ্যক পাহাড়িদের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক এবং অশান্তিময়। আপনার উপযোগিতা না-বুঝে, বা কারো বুদ্ধি-পরামর্শে তৈরি করা মসজিদটি আপনাকে এবং আপনার ধর্মকেই অন্যের কাছে ছোট করে দিচ্ছে। সংবেদনশীল হৃদয়কে প্রশ্ন করুন, হ্যাঁ বা না।
এই যে, অন্যের সংস্কৃতি বা অন্যের জীবনাচরন না বুঝে হুট করে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা, এটা কিন্তু আখেরে আপনার ক্ষতিই করেছে। তাতে যেটা হয়েছে দেখেন, পাহাড়িরা, অন্ততঃ বান্দরবানে, কোনো বাঙালি মুসলিমকে জমিজমা বিক্রি করার চেয়ে বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি বড়ুয়াকে জমিজমা বিক্রি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আপনি বাঙালি, আপনি মুসলিম, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু আপনি বড় আসনে বসে থাকতে পারেননি। নীচে নেমে গেছেন।
সমতলের যে কর্মকর্তারা পাহাড়ে চাকরি করতে এসেছেন, তাদেরকে নামে-বেনামে পাহাড়ের জমিজমার মালিক হবার বুদ্ধি আপনি বা আপনার কোনো বন্ধু সহকর্মীইতো দিয়েছিলেন, তাইনা? সেই কাজে সহযোগিতা করেছে পাহাড়ের প্রথাগত নেতৃত্ব, সুবিধাভোগী নব্য পাহাড়ি এলিট এবং আরো অনেকে।
শত শত একর পাহাড়ি জমি বড় বড় কর্পোরেটদেরকে লীজ দিতে সহযোগিতা করেছে কারা? সেই দলে আপনি বা আপনার বন্ধু, ভাই বা আত্মীয়-স্বজন নেইতো? ওই কর্পোরেটরা কতোটুকু জমি লীজ নিয়ে কতোটুকু দখল করেছে খোঁজ নিয়েছেন? সেই দখলের মাঝখানে কোনো এক খালের পাড়ে বা কোনো পাহাড়ের কিনারায় খুব নিভৃতে বসবাস করতো যে দু’দশটি পাহাড়ি পরিবার, তারা এখন কোথায় গেছে খোঁজ নিয়েছেন? সমতলের দিকে নিশ্চয়ই যায়নি।
খ্রিস্টান মিশনারীরা পাহাড়ের বম, লুসাই, পাংখোয়াদের প্রকৃতি পূজা থেকে একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারী বানালো কীভাবে? ত্রিপুরাদের হিন্দু থেকে খ্রিস্টান বানালো কীভাবে? আর যেভাবেই হোক, অন্ততঃ আপনার মতো করে ‘নকুল ত্রিপুরাকে’ রাতারাতি ‘নুরুল ইসলাম’ বানানোর মাধ্যমেতো নয়ই।
লেখক: কবি ও সংবাদকর্মী