পাপিয়া জেরীনের গল্প ‘লেদার ব্যাগ’

প্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৯

উর্মি, তুমি ভয় পাও, তাই না?
উর্মির খুব বিরক্ত লাগতেছে, সেই বিয়ের রাত থিকা মুকুল তারে উদ্ভট হরর ফিল্মের কাহিনি শুনায়ে আসতেছে। মুকুল প্রতিবারই বলতেছে ঘটনাগুলি সত্য। গল্পের মাঝখানে মুকুলকে থামায়ে দেয় সে... তোমার এগুলা সব গল্প। সারারাত হরর ফিল্ম দেখার পর এসব শুনাবা না আমারে। আমি রাতে হসপিটালে গেলে তুমি বেসমেন্টে গিয়া এইসব হাবিজাবি দেখো আর আমারে...
উর্মি, তুমি আসলেই ভয় পাইতেছ।
মোটেই না। আজকে আমি শোনাবো তোমারে সত্য ঘটনা। শুনলে সারাজীবন আমারে জড়ায়া ধইরা ঘুমাবা হি হি।
আর ইউ আউট অব ইওর মাইন্ড! ভয় পাব আমি? তুমি জানো, জীবনের অর্ধেক রাত আমি কবরস্থান আর শ্মশানে কাটাইছি!
আহারে, চাপাবাজ। রাখো তুমি এইসব, আমার সত্য কাহিনি শোনো। দুইমাস আগের ঘটনা। কুলসুম নামের এক পেশেন্ট। বয়স বিশ বা একুশ। মাত্রই বিয়ে হইছে। কিন্তু বরের সাথে কো-অপারেট করে না। বিয়ের পর সে দশ-পনেরো দিন একদম স্বাভাবিক ছিল। পরে মাঝে মইধ্যে হ্যালুসিনেশন। এই হ্যালুসিনেশনের ধরনটাও শোনো কেমন অদ্ভুত, ওর জামাই ধরো রাত্রে বাথরুমে যায়, তারপর রুমে ঢুইকা ছিটকিনি লাগায়া ওর গা ঘেঁইষা শোয়। ঘুম ঘুম অবস্থাতেও ও বুঝে সেইটা। তারপর একমিনিটের মাথায় আবারও ওর জামাই ছিটকিনি লাগায়ে ওর পাশে শোয়। মেয়েটা চিৎকার করতে থাকে, তুমি একটু আগে আইসা শুইলা, আবার কখন গেছিলা... একমিনিট না যাইতেই আইসা আবার কেমনে শুইলা?

কুলসুমের জামাই প্রথম ভাবে যে, স্বপ্নেটপ্নে দেখছে। কিন্তু না! প্রতিরাত্রেই সেইম কাহিনি। আরেকদিন কুলসুম আর তার জামাই যাবে বাইরে, সে রেডি হইতেছে। দরজার বাইরে প্যাসেজে ওর জামাই দাঁড়ায়ে আছে, কুলসুম আবার নাকি তারে বলছে একটু দাঁড়াইতে। এমন সময় বাথরুমে কল ছাড়ার শব্দ। কুলসুম সব বুঝতে পারার পর চিৎকার দিতে থাকে। পরে ওর জামাই বাথরুম থিকা দৌড়ায়ে আইসা সামলায়। সমস্যা আরো বাড়তে থাকে, একটা সময় মেয়েটার মনে হইতে থাকে ওদের মাঝখানে একজন শুয়া থাকে। লোকটা বামনাকৃতি, মাথাটা ডিফর্মড্।

মুকুল, তুমি হাইসো না। ঘটনা সিম্পল ডিলিউশ্যন না।
তো কি! এমন হাজার ঘটনা ঘটে। সিম্পল মানসিক রোগ।
না, নরমালি দেখলে তাই। কিন্তু সমস্যা যখন গুরুতর তখন কুলসুমের জামাই খুব অসুস্থ হয়া পড়ে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট আর পেটব্যথা নিয়া সোহরাওয়ার্দীতে এডমিটেড... ওই যে কলীম সারের আন্ডারে। পেটে নাকি টিউমার। পরে ডায়াগনোসিস কমপ্লিট হইলে দেখা যায়, ফিটাস ইন ফিটু। বলতে পারো প্যারাসাইটিক টুইন।
বুঝলাম না। তোমার এইসব ডাক্তারি টার্ম বুঝি না। বুঝায়া বলো।
মুকুল, এটা একটা রেয়ার কেইস। আইডেন্টিকেল টুইনের মইধ্যে এইরকম হয়, তাও পাঁচ লাখে একটা ধরো। ধরো যমজের একটা ধরন, যেইখানে মায়ের একটা ফার্টিলাইজ এগ্ ভাইঙ্গা দুইটা হয় আর আলাদা শিশুর মতো পেটে বাড়ে। কিন্তু ফিটাস ইন ফিটুতে একটা ভাগের ভিতর আরেকটা ট্র্যপ্ড হয়া যায়।
আরে ধুর, এত কঠিন ক্যান। সহজ কইরা বলো।
আরে বোকা! যমজ বাচ্চা দুইটা পেটে আলাদা ভাবে না বড় হয়া, একটার ভেতরে আরেকটা থাকে। কুলসুমের জামাইর পেটে যে টিউমার, তা আসলে একটা প্যারাসাইটিক টুইন, ওর নিজেরই যমজ ভাই। নরমালি মায়ের এমবিলিক্যাল কর্ড থিকা আলাদা হইলেই শিশুর ভিতরের শিশুটা মইরা যায়। কিন্তু খুব রেয়ার কেইসে এইটা নিজের ভাই বা বোনের খাবার ভাগ করে খাইয়া বাঁইচা থাকে বুঝলা? আমি কিন্তু অপারেশনের পর সেইটারে দেইখা আসছি। পূর্ণাঙ্গ বামন মানব। মাথাটা পূর্ণাঙ্গ না, কিন্তু দাড়ি আর অক্সিলারি হেয়ার আছে। যৌনাঙ্গও প্রাপ্তবয়স্কের মতো। খুবই ভয়ঙ্কর দৃশ্য, মুকুল!
তার চাইতেও রহস্যময় কুলসুমের মানসিক অবস্থা। সে কেমন কইরা জানলো একজন না... দুইজন! আইমিন ওর জামাইয়ের পেটে, ওহ! আই কান্ট এক্সপ্লেইন। জামাইয়ের অপারেশনের পর দেখলাম সে খুব হাসিখুশি। একহাতে জামাইর সেবা করতেছে। আমি বললাম তারে, কী কুলসুম, এখনও দেখো তারে? সে লাজুক ভঙ্গিতে জিভে কামড় দিয়া মাথা নাড়ে আর বলে, না না।
ইন্ট্রিস্টিং কেইস। আজকে রাইতে তো ঘুম হারাম। এইবার আমি শোনাই?
ওহ্ নো, মুকুল। কালকে সকালে ডিউটি আমার!
জ্বী না। কালকে ছুটি। পয়লা বৈশাখ। তোমার জন্য গিফ্ট আছে। ম্যাকাও পাখির পালক আর মাটির পুঁতির কম্বিনেশনে এই দুল। এই নেও। আর এইটা একটা অদ্ভুত লেদার ব্যাগ। আমি এটা স্পেশালি তোমার জন্য বানাইছি।
এইসব লম্বা দুল পরি না আমি। আর এইটা কেমন ব্যাগ। টুকরা টুকরা চামড়া সেলাই করা। মনে হয় পোস্টমর্টেম করা লাশের সেলাই করা বুকের চামড়া।
কী বললা!
হিহিহি, মুকুল। ভয় পাইছো বাবু? আরে দুষ্টামি করলাম। আমি জানি এখন এইরকমই ট্রেন্ড চলতেছে। সুন্দর হইছে, সুন্দর!
উর্মি, মানুষের চামড়া নিয়া যখন বললা তো একটা সত্য কাহিনি তোমারে শুনতেই হবে। আমি তখন ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্সে থার্ড সেমিস্টারে। আমাদের কোর্স শিক্ষক স্যামুয়েল হার্ট। উনি উনার এক সাইকো ছাত্রের হিস্ট্রি বললেন। ছাত্রটার নাম মনে নাই, কী জানি নাম। থাক বাদ দেও। সেই পোলা ছিল খুব লাজুক, মা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথাই কইতো না। ঘটনা শুরু হইলো তার মা মারা যাওয়ার পর। গ্রেভিয়ার্ড থেইকা নাকি মায়ের লাশ চুরি কইরা...
মুকুল, জাস্ট আ মিনিট। গল্পটা তোমার না তো? আমি ছোটমামার কাছে শুনছি, তোমার নানী মারা যাওয়ার পর তুমি নাকি গভীর রাইতে গিয়া তার কবর খুঁড়তেছিলা?
উর্মি! কী আজেবাজে কথা বলো! কবর খুঁড়ছে আমাদের এলাকার এক পাগল। আমি তো গিয়া ওরে হাতনাতে ধইরা মাইর দিছি। হাতও ভাইঙ্গা ফেলছিলাম।
ইশ্! তুমি এতো সিরিয়াস হও কেন বাচ্চা! আমি তো জানি সেই কাহিনি। আমি তো চেতাই তোমারে। বুঝো না?
ধুর! কাহিনি শুনো। সেই সাইকো ডিজাইনার তার ঘরের চব্বিশটা আইটেম বানাইছে লাশের চামড়া দিয়া। কোমরের চামড়া দিয়া জুতা, মুখের চামড়া দিয়া ল্যম্পশেড, মাথার খুলি দিয়া ক্যন্ডেল স্ট্যান্ড, নিপল্ দিয়া কোমরের বেল্ট, নানান রকমের সোফা, দেয়ালে ঝুলানো শোপিছ, জিভের নেকলেস, পার্স। পরে এসাইনমেন্টে জমা দেওয়ার পরে নাকি এইসব নিয়া কথাবার্তা শুরু হয়। পরে পুলিশ তদন্ত কইরা বাইর করে যে, সেই সাইকো গ্রেভিয়ার্ড থিকা লাশ চুরি কইরা আনে। পরে চামড়া, খুলি, জিভ রাইখা বাকিটা রাইখা আসে কবরে। অবশ্য গ্রেভিয়ার্ডের কেয়ারটেকাররে নাকি মোটা অংকের টাকা দিয়া হাত কইরা নিছিলো সে, পরে আরো জানা যায়।
হাহাহা। মুকুল, এইরকম মুভি দেখছি একটা। কী জানি নাম, সাইলেন্স অব দা ল্যাম্ব।
শোনো এই ঘটনার মতো অনেক মুভি আছে, গানের ব্যান্ড দলও আছে, লেখকের লেখাও আছে। কিন্তু সেই ছাত্রের কাহিনি সত্য।
ওকে বাবা সত্য! মানলাম। এইবার ঘুমাই আমরা। চলো।

আজকে পয়লা বৈশাখ। উর্মি লাল শাড়ি পরছে। যত্ন করে চুল সেট করছে। কানে মুকুলের ডিজাইন করা দুল। হাতে তালিঅলা উদ্ভট লেদার ব্যাগ। গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় রাত্রে দেখা স্বপ্ন মনে পড়লো। এমন ভয়ঙ্কার স্বপ্ন! হাত পা ঠান্ডা হয়া আসতেছে ঊর্মির। স্বপ্নে দেখছে, মুকুল একটা চাকু দিয়া ওর বুকের চামড়া তুইলা চর্বি চাচতেছে। পুরাটা স্বপ্ন বেইজমেন্ট নিয়া। লম্বা লম্বা মানুষের চামড়া পলিথিনের কোণে লবণ আর ক্যামিকেল দিয়া ঝুলানো।

উর্মি ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরায়া বাসায় নিতে ইশারা দেয়। আজকে বেইজমেন্ট খুইলা দেখার উপযুক্ত সময়। মুকুল ওর ছোটবেলার বন্ধুর সাথে টিএসসি গেছে। ঊর্মি বাসায় ঢোকার পর ওর গা ঘিনঘিন করতে থাকে। কানের দুল আর ব্যাগ ছুইড়া দিয়া আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়া নামতে থাকে। কিন্তু সেইখানে আলো জ্বলতেছে, কথাও শোনা যাইতেছে... হায়দর, এইটা কী বডি আনছো? একসপ্তাহ আগের লাশ। এই চামড়া তোলা কঠিন। টাকাতো কম দেই না। তাই না?
ভুল হয়া গেছে বস্। পুলিশ কেইস। পোস্টমর্টেম করা বডি। আগে বুঝি নাই।
আগে বুঝতে লাগবে, এদের হিস্ট্রি জাইনা পরে বডি তুলবা। কী করছে দেখো তো। এইটা দিয়া কি করুম আমি? হ্যাঁ!

উর্মির মাথা কাজ করতেছে না। সে কী করবে এখন! শরীর পাথরের মতো ভারী লাগতেছে। কেমন কইরা সে এই চৌদ্দটা সিঁড়ি ভাইঙ্গা উপরে উঠবে। উপরে উইঠা আগে কি ভাইয়ারে কল দিবে, না বাইর হওয়া দরকার আগে! সারাটা শরীর ঘামে ভিজা চুপচুপ করতেছে। অতি দ্রুত পুলিশে খবর দিতে হবে। সে কার সাথে ঘর করছে এতদিন। মুকুল কি মানুষ... না পিশাচ! বেডরুমে ধপ কইরা বইসা পড়ে সে।

উর্মি! তুমি না বাইর হয়া গেলা?
ও! মুকুল! আমি তো ফোনটা রাইখা গেছিলাম।
কানের দুলটা খুলছো ক্যান?
তুমিও তো বের হয়া গেলা দেখলাম। আবার আসলা ক্যান বাসায়? ও বেইজমেন্টে ছিলা?
হু। আচ্ছা যাও তুমি।
উর্মি কিছু না বইলা ঝড়ের মতো গেইট দিয়া বাইরে ছুইটা যায়। হাতে লেদারের ব্যাগটা। ফড়িঙের মতো হাত নাইড়া সে ট্যক্সি ডাকতেছে। কোনোভাবেই সে মুকুলের গাড়িতে যাবে না, এই ড্রাইভারও সন্দেহজনক। লেদার ব্যাগটা ছুড়তে গিয়াও ছুড়লো না সে... এভিডেন্স হিসাবে এইটা পুলিশরে জমা দেয়া লাগবে। উর্মি বুঝতে পারতেছে না, সে ক্যমনে এতো গোছায়া চিন্তা করতেছে।আর গত রাত্রের স্বপ্নটাও তো অদ্ভুত!

ট্যক্সি ঝড়ের গতিতে যাইতেছে। তার চাইতেও বড় ঝড় উর্মির নিউরোনে।