পাপিয়া জেরীন

পাপিয়া জেরীন

পাপিয়া জেরীনের কবিতার বই ‘দ্বৈপ’ যেন শ্মশানের সুগন্ধি কাঠ

মাহফুজুর রহমান সজীব

প্রকাশিত : জুন ১৮, ২০২০

দারুণ প্রচ্ছদে মুড়ে থাকা পাপিয়া জেরীনের কবিতার বই ‘দ্বৈপ’ ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত। প্রথমেই বই থেকে ভালো লাগার দুর্দান্ত কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।

এক.
আমি তোমাকে ভুলে যেতে চাই
ছেড়ে যেতে চাই
অথচ আমার বন্দরে লেগে আছে তোমার সবুজ জলযান
কয়েক শো নোঙরসমেত

আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছি কতবার!
উড়ে গেছি বিষণ্ণ ড্রোনের মতো মেঘ কেটে কেটে,
শেষে জান্তব ডানা জেনে গেছে—
তুমিই অনতিক্রম্য, তুমি আকাশ।

ছেড়ে যাওয়াটা কী অসম্ভব! অতঃপর কতটা লীন হয়ে থাকা ছেড়ে যেতে চাইলেও মিশে যাওয়া মানুষটার সাথে!

দুই.
মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে গার্মেন্টস—
হাতে টিফিন ক্যারিয়ার
চুল চুয়ে নেমে গেল রাতের গলদঘর্ম।

রাতে সারাদিনের একঘেঁয়ে কাজ শেষে এই ফিরে যাওয়া যেন বিশুদ্ধ হয়ে ওঠা অক্সিজেন। তাদের ভেতরটা অনুভব করে তুলে আনা। চোখের সামনে দেখা হয়ে যায় তাদের এই মোমেন্টের হেঁটে যাওয়া।

তিন.
এই যে অন্ধকারে অস্পষ্ট গাছেরা দীর্ঘায়িত ছায়া নিয়ে চুপ করে বসে আছে,
পথও চিহ্নহীন, তুমি রেখার মতো নিঃশব্দে বেঁকে গেলে যেদিকে—
আধভাঙা পিরিচের মতো রয়ে গেল চাঁদ;

ইমেজগুলো মিশে যায় চোখে এখানে হালকা অন্ধকার কালারে মুড়ে থেকে।

চার.
এই স্থানকালপাত্রের কোনো মাহাত্ম্য নাই,
হাটের মানুষের ভ্রু তুলে দেখা মেঘ
কোঁচড় মুঠ করে ধরে রাখা হাত
কিংবা বগলের জট-লাগা চুল
কাছিমের মতো বাঁক দেওয়া পিঠ, মহিমাহীন।

কেমন বৈকালিক নিঃসঙ্গতার সুরে প্রতিদিনই একই গতানুগতিক দৃশ্য, একই ফ্রেমে একটু আলাদা করে দেখা যেন। জীবনতো এমনই, খুব বর্ণিল বা রঙিনও না, এই হাটের মানুষগুলোর মতোই।

পাঁচ.
বউঠাপানো বিকেলে
নড়ে উঠছে লোহার খুঁটি
ঢেঁকিঘরে খুলে যাচ্ছে শস্যের হলুদ পিরান।

ঢেঁকির চাপে শস্যগুলো যখন ফেটে ফেটে মিলিয়ে যাচ্ছে নিজেদের ভেতর তখন কবির চোখ আপাত নিরীহ এই দৃশ্যে খুঁজে পায় যেন শস্যের বাহারি কালারের জামা খুলে উন্মুক্ত হওয়া। ‘বউ ঠাপানো বিকেল’র মতো সাহসী শব্দের ব্যবহার আরও আছে এই বইতে। যেই শব্দগুলো অশ্লীল মনে হওয়াতো দূরের কথা বরং মনে হয় এই শব্দগুলোই জরুরি ছিল সেখানে পূর্ণ মিনিং দিতে।

ছয়.
ধরো আমাদের কোনও কথা নেই
পড়ে আছে কিছু খড়বিচালি, গৃহস্থালি
আমি শুয়ে, তুমি নুয়ে
অভ্যাসবশত।

এই অংশ সঙ সার চার নম্বর কবিতা থেকে নেয়া। কবি সংসারকে শ্লেষ করে বলছেম সঙ সার। সংসার মানেইতো সেলাই করে বুনে রাখা বোধ, দায়িত্বের বেড়াজাল। এগুলোর ভেতরে থাকতে তো হবেই তবুও কখনও সখনও বেজার হয়ে গেলে মন, সংসারের চাপে মনে হয় সংসার এক সঙ সার ছাড়া আর কী?

সাত.
পড়ে আছি চৌচির এইখানে
দ্বিধার মতন
একটা ভাঙাচোরা ক্যারাভ্যান
দূরে হরিণীর সংশয়
আরো দূরে রক্তের ঘ্রাণ
শাবকের বিচ্ছিন্ন শরীর
কাঁপা কাঁপা।

বইয়ের অসম্ভব শক্তিশালী জায়গাটা এখানেই। দারুণ লাগলো! এই অংশটি `দ্বৈপ` কবিতা থেকে নেয়া। বইয়ের নামটাও যেই কবিতা থেকে নেয়া।

আট.
ভেতরে রুদ্ধ আকাশ হেলে আছে
পাখিদের ডানার ভার
বাতাসে
ফিকে রং প্রজাপতি
বিহবল রোদে করমচা ধরে আছে একবিন্দু স্বেদ
পড়ে আছি এইখানে চৌচির দ্বিধার মতন...

এই অংশটাও `দ্বৈপ` কবিতা থেকে নেয়া। কী দারুণ ইমাজিনারি এখানে!

নয়.
তুমি জায়নামাজের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলে
গোলাপের মতো ফুটেছিল আরক্ত আঙুল

আনত চোখ, ঠোঁটে অজস্র আয়াত;
তুমি জানো না—
তোমার প্রার্থনার পাশে একটা বাসনাবিদ্ধ বকুল ঝরে আছে!

নিবিঢ় প্রার্থনার পাশে মনোযোগ হেলিয়ে দিয়ে কবি দেখিয়ে দিলেন ঝরে যাওয়া বাসনাবিদ্ধ বকুল। এই বকুলকে বাসনাবিদ্ধ বলা কেন? অন্য কারও হাতে শোভা হওয়ার ইচ্ছে ছিল খুব এই বকুলের বলে?

দশ.
সুগন্ধি কাঠ ভিজে আছে শ্মশানের মাঠে
কাটাখালী থেকে শ্যামতলীবাজার—
কবন্ধ ধোঁয়াশায় ঘেমে আছে মড়ার অদগ্ব চিবুক
রসায়নের যৌগপদ্যে
আজ পুড়বে না কেউ;

শ্মশানের সুগন্ধি কাঠের নিয়তিইতো মানুষের শব পোড়ানোতে সহযোগী হওয়া। একলা একলা অপেক্ষা করা কাঠগুলো কোন লাশের অপেক্ষায় থাকে যেন নিয়ত। কিন্তু আজ আর লাশ আসবে না। কেউ মরেনি আজ। রিলিফ যেন বাতাসে একটু। সেই জায়গার সবাই জীবিত তাহলে আজ।

কবিতার বইটি মূলত প্রেমের। যে জায়গাগুলো কোট করলাম সেগুলো আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে বলে। এই বইয়ের প্রেমানুভূতি বিচ্ছেদের নয়, আলিঙ্গন করে নেয়া প্রেম। কখনও কিছুটা কমে যাওয়া প্রেম। কখনও প্রেমের প্রলেপ বাড়ানো। হাহাকার নাই কোথাও।

প্রেমের রূপ সবসময়তো একই নদীর একই বহতা জলের মত নয়। সেখানো মনোটোনাস মুহূর্ত আসে, উদগ্রীব মুহূর্ত আসে, নিঃসঙ্গতার মুহূর্তও আসে, আসে হারায় ফেলার ভয়, আসে প্রেমের পূর্ণতা মানসিক ও শারীরিকভাবে, চলে যাওয়ার ইচ্ছেও আসে প্রেমের বলয় ছেড়ে। এই বইতে প্রেমের আকারটা মনে হয়ছে নিয়তিসিদ্ধ। দৈনন্দিন জীবনে প্রেমও যেন একটা পার্ট মাত্র, খুব মহিমান্বিত কিছু নয় আবার অতীব ভারাক্রান্তও কিছু নয়।

কবিতাগুলোয় কিছুটা মিসিং পেয়েছি কবিতাগুলোর পূর্ণ হয়ে ওঠাটা। বেশিরভাগ কবিতারই একটা পার্ট যতটা উজ্বল আরেকটা পার্ট কিছুটা ডাউন। সম্পূর্ণ আকাশে ছড়িয়ে দেয়া সবগুলো জোনাকপোকা না যেন, কিছুটা জোনাকপোকা রেখে, কিছুটা ছড়িয়ে দেয়া। তবে কবিতাগুলোতে গতি ছিল। শুরু করলেই এই কালারফুল গতিতে ঢুকে পড়ে গিয়ে একেবারে শেষে চলে যাওয়া যায়।

সবকিছু মিলিয়ে দারুণ ভালো লাগার মতো একটি কবিতার বই ‘দ্বৈপ’। আরোপিত নয় কবিতাগুলো, এটা এক বড় বৈশষ্ট্য বইটির। ৪৮ পৃষ্ঠার এ বইটির প্রকাশক বৈভব। দাম ২৫০ টাকা। পাওয়া যাবে https://www.rokomari.com/book/198054/doipo

একুশে বইমেলা ২০১৮