ফাইল ছবি
পাঠকের যোগ্যতা এবং হুজুগে সাহিত্য
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০
ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। মাসজুড়ে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। শুরুর কয়েকটা দিন ঢিমেতালে চললেও এখন ভিড়ভাট্টা বাড়ছে। বাড়ছে স্টলকর্মীদের ব্যস্ততা। পাঠক তার পছন্দের বই কিনতে ঢুঁ দিচ্ছে বিভিন্ন স্টলে। গণমাধ্যমগুলোতে বইমেলা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। পাঠক-লেখকের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় কোনোই নতুনত্ব নেই। নতুনত্ব নেই প্রকাশনাশিল্পে। পাঠকও রয়ে গেছে আগের রুচির।
সত্যি বলতে কি, বইমেলায় গিয়ে যারা বই কেনে, তাদেরকে আমার পাঠক মনে হয় না। আবার এটাও সত্যি যে, বইমেলায় যাদের বই প্রকাশিত হয় তাদেরকেও আমার লেখক মনে হয় না। গত বছর বইমেলায় প্রায় চার হাজার নতুন বই এসেছিল। এই হিসেব করলে, আমার জীবদ্দশাতেই অন্তত দেড় লাখ বই বেরিয়ে গেছে। আমার জন্মের আগে বের হওয়া বইয়ের কথা বাদই দিলাম। শুধুমাত্র পাঠ্য দশটা বই পড়তে যদি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে এক বছর সময় দেয় তবে সাধারণ পাঠকের কত সময় লাগবে বইমেলায় বের হওয়া বইগুলো পড়তে?
পাঠক যে বই কিনতে চায় বা বাছাই করে, তা কোন মানদণ্ডে? বইমেলার স্টলে চিৎ করে রাখা বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে? লেখকের নাম দেখে? নাকি বইয়ের বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য রেখে পাঠক বই কেনে? এবার একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৯৪টি ইউনিট, মোট ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এত এত স্টলের ভিড়ে পাঠক কোথায় বই খুঁজবে? আমার ধারণা, কোনো স্টলেই বিষয়ভিত্তিক বইয়ের র্যাক নেই। তাহলে কীসের ভিত্তিতে পাঠক বই কিনছে? প্রতি বছর বইমেলা শেষে বাংলা একাডেমির ঘোষণা থেকে জানা যায়, কয়েক কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এ থেকে যদি কেউ ধারণা করে নেয়, বাহ, দেশে তো বেশ পড়ুয়া! জাতি তাহলে রুচিমান হচ্ছে! এক্ষেত্রে আমার কিছু কথা আছে। আপনি যাকে পাঠক বলছেন, আমি তাকে পাঠক বলছি না।
কিছু যোগ্যতা না থাকলে যেমন লেখক হওয়া যায় না, একই রকমভাবে কিছু যোগ্যতা না থাকলেও পাঠক হওয়া যায় না। প্রতি বছর বইমেলায় বিক্রির শীর্ষে থাকে উপন্যাস। যার বেশিরভাগই বাজারি, মানে সস্তা বিনোদনমূলক উপন্যাস। অবশ্যি এগুলোকে উপন্যাস বলতেও আমার আপত্তি আছে। এরপরও প্রচলিত ধারায় উপন্যাস বলাই যায়। যেহেতু উপন্যাস নাম দিয়ে এসব কাগুজে মুড়ি-মুড়কি বিক্রি হচ্ছে। এসব যারা কিনছে তারা যদি পাঠক হয়, তাহলে বঙ্গদেশে সাহিত্যচিত্র খুবই হৃদয়বিদারক।
মনে রাখতে হবে, শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস প্রতি বছর ডজন ডজন জন্ম হয় না। আর, সে মানের লেখকও এ দেশে এখন দু’চারজনের বেশি নেই। এ ধরনের উপন্যাসের পাঠক নির্দিষ্ট। কিন্তু সস্তা বিনোদনের পাঠক কারা? বেশির ভাগ পাঠকের রুচিই আসলে সস্তা বিনোদন খোঁজে। এসব পাঠকের ভেতর যারা নিজেকে একটু আপডেট মনে করে, তারা বই নির্বাচনের জন্যে গণমাধ্যমে চোখ রাখে। কিন্তু গণমাধ্যমে কী ধরনের বইয়ের প্রচার করা হয়?
আমার নাম সদরুল। আমি একটি উপন্যাস লিখেছি। বইয়ের না, পাশের বাড়ির মেয়েটি। আমার সঙ্গে কোনো একটি গণমাধ্যমের যোগাযোগ আছে। এই সূত্র ধরে বইটার একটু প্রচারের সুযোগ ওই গণমাধ্যম থেকে আমি নিয়ে নিলাম। বইলেমায় যেসব লেখকের বই বের হয়, তারা বেশিরভাগই কোনো না কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। ফলে লেখকগণ নিজ নিজ গণমাধ্যমে বই প্রচারের কিছু সুবিধে পেয়েই যান।
বই প্রচারের আরো একটি উপায় হচ্ছে লেখদের দলবাজি। গণমাধ্যমের সুনজরে পড়ে জনাব ‘ক’ লেখক হিসেবে একটু পরিচিতি পেয়েছে। তো চলো, তার সঙ্গে একটু খাতির করা যাক। উনি যদি জনাব ‘গ’ এর বইটা নিয়ে কিছু লেখেন কিম্বা বলেন, তাহলে বইটার একটু কাটতি হয়। আবার জনাব ‘ক’ তার বই নিয়ে কিছু লিখতে জনাব ‘খ’ এর সঙ্গে খাতির লাগান। এভাবে খাতিরে খাতিরে একটা হুজুগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেসব পাঠক সাহিত্যে একটু আপডেট থাকতে চায়, তারা এই খাতিরের সাহিত্য প্রচারে সবচে বেশি প্রভাবিত হয়।
শুধু উপন্যাস নয়, এভাবেই বইমেলায় বিক্রি হচ্ছে কবিতা ও ছোটগল্পের বই। মানে সাহিত্যের পাঠক বলতে আমরা এরকম হালকা শ্রেণির পাঠকই পাচ্ছি। আর এসব পাঠকের যারা লেখক, তারা এসব পাঠকের জন্যেই লিখে থাকেন। আর চেষ্টা করে যান, বোকাচোদা পাঠককে ক্যামনে আরও প্রলুব্ধ করা যায়। এ এক চক্র। এই একটি চক্রেই প্রতি বছর বইমেলা হচ্ছে। বইটই বেরুচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে। কিন্তু দেশে সাহিত্যরুচি তৈরি হচ্ছে না।
আমার কৈশোরে, যখন কবিতার মতো করে বাক্য লিখতাম, আর একে-ওকে দেখাতাম মতামতের জন্যে— সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাশের বাড়ির এক ভাই বলেছিলেন, মানুষের জীবনে কবিতার কোনো মূল্য নাই। কবিতা না পড়েও মানুষের জীবন দিব্যি ভালোভাবে কেটে যেতে পারে। সে বয়সে আমারও তা-ই মনে হতো। তবে আরেকটু বড় হয়ে বুঝতে পারি, মানুষের রুচি তৈরি করতে কবিতা, মানে সাহিত্যপাঠ অবশ্যই জরুরি। মানুষের জীবন মোটেও সুন্দর কোনো আয়োজন নয়, কিন্তু সাহিত্যের আয়নায় জীবনকে সুন্দর দ্যাখায়। আর এ কারণেই সাহিত্যপাঠ মানুষের কর্তব্য।
আদিম মানুষের বসতি স্থাপন কীভাবে হয়েছিল? প্রথমে তারা জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে এরপর ঘরবাড়ি তোলে। পরে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করে। সাহিত্য মানবাত্মার জঙ্গল পরিষ্কার করে। এটুকুই হচ্ছে সাহিত্যের কাজ। এরপর পরিষ্কার জায়গায় ঘড়বাড়ি তোলার কাজ করে জ্ঞান। জ্ঞান অর্জন হয় দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্মীয় মতবাদ দ্বারা। যে দেশের পাঠকের রুচি পাশের বাড়ির ভাবির ব্লাউজের দিকে, সেদেশের পাঠকের সাহিত্যরুচি ক্যামনে তৈরি হবে? এরা তো এখন নিজের ভেতরকার জঙ্গলই পরিষ্কার করতে পারেনি। আর সেখানে জ্ঞানস্বরূপ ঘরবাড়ি তোলা তো দূর কী বাত!
বইমেলায় দর্শন, বিজ্ঞান কিম্বা ধর্মীয় মতবাদের বই বিক্রির অবস্থা কি? খুবই খারাপ। এ দেশে হাজারে একজন পাঠক হয়তো দর্শন কিম্বা বিজ্ঞানবিষয়ক বই পাঠে আগ্রহী। ধর্মীয় বইয়ের বেচাবিক্রির খবর কি? কেউ কেউ অবশ্যি বলবেন, ইসলামি বই তো দেশে ভালোই চলে। আমি বলব, চলে না। সত্যি যে, প্রচুর ইসলামি বই বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব খুবই নিম্নমানের। কোরআন-হাদিসের দর্শন কিংবা বিজ্ঞান এসব বইতে নেই বললেই চলে। অজু ভাঙার কারণ, নারী পর্দায় থাকবে কেন, মকসুদুল মোমেনিন টাইপের তৃতীয় শ্রেণির বই ইসলামি বই হিশেবে এ দেশে প্রচলিত।
অথচ এদেশে কয়েকজন ইসলামি দার্শনিক রয়েছেন। তাদের প্রচুর লেখাও রয়েছে। এসবের খোঁজও আমরা রাখি না। খানবাহাদুর আহছানউল্লা, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ— একরকম কয়েকটি নাম উল্লেখ করাই যায়, যাদের কলমে উঠে এসেছে কোরআন-হাদিসের মর্মবাণী। কিন্তু ক’জন পাঠক তাদের বই পড়েন? ক’জন পাঠক ভূবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়েন? কত বিস্ময়কর এই মহাবিশ্ব! কিন্তু পাঠককে এসব মোটেও বিস্মিত করে না। আর তাই, বইমেলায় গিয়ে পাঠক বই কেনে। যে বইয়ের কোনো শিল্প কিম্বা জ্ঞানমূল্য নেই।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক