পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের দুটি গল্প
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২০
পল্লীকবি জসীমউদদীনের আজ ১১৬তম জন্মদিন। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি পল্লীকবি হিসেবে পরিচিত। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত দুটি গল্প পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
রহিমুদ্দির ভাইয়ের বেটা
চাচা আর ভাস্তে সন্ধ্যাবেলায় আলাপ সংলাপ করিতেছে।
ভাস্তে: চাচা,আজ বাজারে গিয়াছিলাম।
চাচা: যাবি না! তবে কি বাড়ি বসিয়া থাকবি নাকি?
ভাস্তে: একটা কুমড়া লইয়া গিয়াছিলাম।
চাচা: নিবি না? খালি হাতে যাইবি নাকি?
ভাস্তে: একটা লোক আসিয়া কুমড়াটার দাম জিজ্ঞাসা করিল।
চাচা: দাম জিজ্ঞাসা করিবে না তো কুমড়াটা মাগনা লইবে নাকি?
ভাস্তে: আমি আট আনা চাহিলাম।
চাচা: আট আনা চাহিবি না? তবে কি মাগনা দাবি অত বড় কুমড়াটা?
ভাস্তে: সে লোকটা দুই আনা বলিল।
চাচা: বলিবে না? অতটুকু কুমড়া তুমি আট আনা চাহিলেই সে নিবে কেন?
ভাস্তে: আমি বলিলাম, বাপের পুষ্যি কুমড়া খাইছ কোনো দিন?
চাচা: বেশ বলিয়াছিস। এত বড় কুমড়াটা ব্যাটা কিনা দুই আনা মাত্র দর করিল!
ভাস্তে: এমন সময় এক পুলিশ আসিল।
চাচা: আসিবে না? তুমি ভদ্রলোকের ছেলেকে বলিয়াছ, বাপের পুষ্যি কোনো দিন কুমড়া খাইছ? দেখ না কী হয়!
ভাস্তে: পুলিশ আসিয়া কুমড়াটার দাম জিজ্ঞাসা করিল।
চাচা: করিবে না? পুলিস বলিয়া কুমড়াটা মাগনা লইবে নাকি?
ভাস্তে: আমি কুমড়ার দাম আট আনা চাহিলাম।
চাচা: বেশ! বেশ! আমার ভাস্তে! দাম চাহিবি না? পুলিশ দেখিয়া ডরাইবি নাকি?
ভাস্তে: পুলিস দুই আনা দাম করিল।
চাচা: করিবে না? পুলিশ বলিয়া কি তাহারা জিনিসের দাম-দস্তর জানে না? বলি অতটুকু কুমড়া, তার দাম দুই আনার বেশি আর কত হইবে?
ভাস্তে: আমি বলিলাম, বাপের পুষ্যি কুমড়া খাইছ কোনো দিন?
চাচা: বেশ বলিয়াছিস। বেটা আট আনার কুমড়াটা কিনা না দুই আনায় লইতে চায়!
ভাস্তে: তখন পুলিশ আমাকে ধরিয়া খুব মাইর দিল।
চাচা: দিবে না? যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা?
ভাস্তে: মারিতে মারিতে আমাকে থানায় লইয়া গেল।
চাচা: থানায় লইয়া যাইবে না? পুলিশকে তুমি অপমান করিয়াছ।
ভাস্তে: সেখানে গেলে বড় দারোগা আসিল।
চাচা: আসিবে না? দেখ না, তোমার ওপর আরও কি দুর্গতি হয়!
ভাস্তে: বড় দারোগা আসিয়া আমাকে ছাড়িয়া দিল।
চাচা: দিবে না? তুমি যে রহিমুদ্দির ভাইয়ের বেটা!
হেনতেন
অল্প বয়সেই আজিজের বাপ-মা মরিয়া গেল। বুড়ো নানা আজিজকে আনিয়া তাহার বাড়িতে রাখিলেন। কিন্তু তাহার মতো দুষ্ট ছেলেকে সামাল দিবেন কতদিন? আজ এটা নষ্ট করে, কাল ওটা বাজারে বিক্রি করিয়া মেঠাই খায়। অনেক ধকম-ধামক মারপিট করিয়াও আজিজকে ভালো করা গেল না। পরিশেষে নানা তাহাকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিলেন।
দশ বারো বৎসর পরে একদিন অনেক টাকা-পয়সা লইয়া আজিজ দেশে ফিরিয়া আসিল। আসিয়া শহরে একটি বাড়ি কিনিয়া ফেলিল। তারপর নানা-নানির সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। তাহার হাতে আঙটি, ঘড়ি, পরনে দামি কাপড়। নানা-নানি তো দেখিয়া অবাক! নানা জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যারে আজিজ! বিদেশে যাইয়া তুই এত টাকা-পয়সা কামাই করিলি কি করিয়া?
আজিজ উত্তর করিল, নানা। ওসব জিজ্ঞাসা করিবেন না। টাকা-পয়সা উপার্জন করিয়াছি হেনতেন করিয়া।
নানা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, আরে নাতি, বল না হেনতেন কাকে বলে?
আজিজ বলিল, সে কথা আর একদিন বলিব নানা। আজ থাক।
আজিজ চলিয়া গেল। কিন্তু নানার মনে কেবলই জাগে, হেনতেন কাকে বলে? আচ্ছা, নাতির মতো হেনতেন করিয়া নানা নিজের অবস্থা আরও ভালো করিতে পারে না? ভাবিয়া ভাবিয়া নানার আর ঘুম হয় না। সেদিন আজিজকে নানা ডাকিয়া আনিলেন। বড়লোক নাতির জন্য নানি অনেক পিঠা-পায়েস করিয়াছেন। নানা নাতি দুজনে বসিয়া খাইতেছে, নানা তখন কথাটা পাড়িলেন, হ্যারে আজিজ, সেদিন না বলিয়াছিলি হেনতেন কাকে বলে অন্য সময় বলবি? আজ তোকে কিছুতেই ছাড়িব না। হেনতেন কাকে বলে তোকে বলিতেই হইবে।
একটা পিঠা চিবাইতে চিবাইতে আজিজ বলিল, নানা, আজ ওকথা থাক। পরে একদিন বলিব। নানি বলিলেন, আর একদিন কেন নাতি? তোমার নানা যখন জানিতে চান, আজই বল না কেন ভাই? হেনতেন কাকে বলে আমারও জানিবার ইচ্ছা। আজিজ বলিল, আচ্ছা নানি, হেনতেন কাকে বলে আমি শুধু মুখেই বলিব না। আপনাদিগকে দেখাইয়া দিব। আমাকে শুধু এক মাসের সময় দিন।
একট কী ভাবিয়া আজিজ আবার বলিল, নানা, একটা কথা। নানি তো সারা জীবন আপনার সংসারে খাটিয়া খাটিয়া শরীর ক্ষয় করিয়া ফেলিলেন। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে নানিকে আমার শহরের বাড়িতে কিছুদিন রাখিয়া সবকিছু দেখাইয়া আনি। এ কথা শুনিয়া নানি নাতির উপর খুব খুশি হইলেন। নানার মুখের দিকে তিনি চাহিয়া রহিলেন, নানা কি জবাব দেন।
নানা বলিলেন, সে তো ভালো কথা ভাই। আমার তো আর কোনো আত্মীয়-স্বজন নাই, যেখানে যাইয়া তোমার নানি দুইদিন বিশ্রাম করিয়া আসিবে। তুমি বড়লোক নাতি, লইয়া যাও তোমার নানিকে। কয়েক দিন শহরের যা কিছু দেখিয়া আসুক।
নানিকে সঙ্গে লইয়া আজিজ তাহার শহরের বাসায় আসিল। নানার বাড়ি হইতে শহর পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে। কিছুদিন পরে শহর হইতে আসিয়া আজিজ কাঁদো কাঁদো হইয়া নানাকে বলিল, নানা, দুঃখের কথা আর বলিব কি! একদিনের কলেরা হইয়াই নানি মরিয়া গিয়াছেন। আপনাকে যে খবর দিব তাহারও সময় পাইলাম না। ডাক্তার-কবিরাজের বাড়ি ঘুরিয়াই শরীর কাহিল করিয়া ফেলিলাম।
নানা কিছুদিন বউয়ের জন্য খুব কাঁদিলেন। তারপর ঘর-সংসারের কাজে মন দিলেন। আজিজ শহরের বাড়িতে যাইয়া তার নানিকে বলিল, নানি, দুঃখের কথা কি বলিব! বসন্ত রোগ হইয়া একদিনেই নানা মরিয়া গিয়াছেন।
শুনিয়া নানি ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, ওরে আজিজ, শীগগীর আমাকে বাড়িতে রাখিয়া আয়।
আজিজ আরও কাঁদো কাঁদো হইয়া বলিল, নানি, আপনাদের গ্রামে আরও দুই তিনজনের বসন্ত হইয়াছে। সেখানে গেলেই আপনাকে বসন্ত রোগে ধরিবে। কিছুতেই আমি আপনাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারিব না।
চার-পাঁচদিন কাঁদিয়া কাটিয়া নানি আবার আগের মতোই খাওয়া-দাওয়া করিতে লাগিলেন। কিছুদিন পরে আজিজ আসিয়া তাহার নানার সঙ্গে দেখা করিয়া বলিল, নানা, আর কতদিন একলা সংসার সামলাইবেন? এই বুড়ো বয়সে কে দেয় আপনার ভাত-পানি, আর কে লয় আপনার খবরাখবর!
কয়েকদিন হাত পুড়াইয়া রান্না করিয়া খাইয়া নানা অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছেন। নাতির কথায় একেবারে গলিয়া গেলেন, তাই তো রে ভাই! এই বুড়ো বয়সে ঘর সংসারের কাজ করিতে করিতে একেবারে নাজেহাল হইয়া পড়িয়াছি।
সুযোগ বুঝিয়া আজিজ বলিল, নানা, আমার বাসার ধারে একেবারে নানির মতো দেখিতে একটি বিধবা মেয়ে আছে। নানির মতো বয়সী। বলেন তো তার সঙ্গে আপনার বিবাহের জোগাড় করিতে পারি।
নানা বলিলেন, নারে ভাই, এই বুড়ো বয়সে কাকে আনিয়া দিবি, জানি না, চিনি না, আমার ঘর-সংসার নাস্তানাবুদ করিয়া ফেলিবে।
আজিজ বলিল, নানা, ওসব চিন্তা করিবেন না। আমার বাসার কাছে বলিয়া সর্বদা মেয়েটিকে দেখিতে পাই। তার চাল-চলন একেবারে নানির মতো। আপনি দেখিলে বুঝিতে পারিবেন না মেয়েটি নানি ছাড়া অপর কেহ।
নানা তখন বলিলেন, আচ্ছা তোর যদি ইচ্ছা হয় তবে বিবাহের বন্দোবস্ত কর।
আজিজ বলিল, নানা, খালি হাতে তো বিবাহ হয় না। কনে পক্ষ আবার শরীফ ঘর। অন্তত হাজার টাকা না হইলে এই বিবাহের কাজে নামা যায় না।
নানা গণিয়া গণিয়া নাতির হাতে হাজার টাকার নোট দিলেন। বাসায় আসিয়া আজিজ তাহার নানিকে বলিল, নানি, এইভাবে বিধবা হইয়া আপনি আর কতদিন থাকিবেন? আমাকে তো জানেনই। আমার মতিগতির কোনো ঠিক নাই। যা টাকা-পয়সা আছে ফুরাইলে আবার বিদেশ চলিয়া যাইব। তখন আপনার কি উপায় হইবে?
নানি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, তাই তো রে ভাই! আমার ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কূল-কিনারা পাই না। আজিজ বলিল, অমুক গ্রামে একজন বুড়ো লোক দেখিয়াছি। একেবারে নানার মতো দেখিতে। অবস্থা বেশ ভালো। অল্পদিন হইল তাহার বউ মরিয়াছে। আপনি যদি বলেন, তাহার সঙ্গে আপনার বিবাহের বন্দোবস্ত করিতে পারি।
শুনিয়া নানি ক্ষেপিয়া উঠিলেন, আরে হতভাগা! আমার কি এখন বিয়ার বয়স আছে? আজিজ বলিল, সেই বুড়ো লোকটারও কি বিয়ার বয়স আছে? তবে দিনে দিনে আপনি যখন আরও কমজোর হইয়া পড়িবেন তখন আপনার দেখাশুনা করিবে কে নানি! আপনি তো আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন না, সেই লোকটার চলন-বলন, হাবভাব, গায়ের রং একেবারে নানার মতো। প্রথমে দেখিলে তাহাকে অপর লোক বলিয়া চিনিতেই পারিবেন না।
নানি বলিলেন, তোর নানার মতো যদি দেখিতে হয়, তবে কর বিয়ার জোগাড়।
শুভদিনে শুভক্ষণে নানা বিবাহের পোশাক পরিয়া পালকিতে চড়িয়া কয়েকজন বরযাত্রী সঙ্গে লইয়া নাতির বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাজি-বন্দুক ফুটাইয়া নাতি বুড়ো নওসাকে ঘরে আনিয়া বসাইল। শা-নজরের সময় নানা নানিকে চিনিতে পারিলেন। নানিও নানাকে চিনিতে পারিলেন। দুজনে দুজনকে পাইয়া ভারি খুশি। তবুও নানা আজিজকে ডাকিয়া ধমকাইয়া বলিলেন, ওরে লক্ষ্মীছাড়া, এই তোর কীর্তি!
হাসিতে হাসিতে আজিজ আসিয়া নানাকে বলিল, নানা, হেনতেন কাকে বলে জানিতে চাহিয়াছিলেন। তাই হেনতেন কাকে বলে আপনাদিগকে হাতে-কলমে দেখাইয়া দিলাম।
পল্লীকবি বিরচিত ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ থেকে গৃহীত