পরকীয়া তো ডরনা কিয়া

শামীমা জামান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৯

পরকীয়া ভালো না খারাপ, এই আলাপে সরগরম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা পোর্টালের পাতাগুলো। জন্ম থেকে অন্ধকারকে কালোই জেনে এসেছেন। হঠাৎ করে কেউ একজন বলল, অন্ধকার কালো নয় আসলে ওটা সাদা। এই আলাপটা অনেকটা সেরকমই।

জীবনের যে কোনো বয়সে প্রেমে পড়াকে মানবিকতার চোখ দিয়ে দেখে অনেক বিদগ্ধ জনই বললেন, পরকীয়া হতেই পারে, সেক্ষেত্রে সঙ্গীকে ছেড়ে আসাই মঙ্গল প্রতারণা না করে। কিম্বা নতুন সঙ্গীটি যেন বিবাহিত না হন সেটা দেখে নেয়া ভালো। বলি, তাহলে কি আর পরকীয়া হলো? আর দেখেশুনে কি পরকীয়া হয়?

পরকীয়াকে নারীবাদের প্যাকেজে যুক্ত করতে নারীদের উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলা হলো, যদি কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যাও জীবনের যে কোনো প্রান্তে সে সম্পর্ক স্বীকার করে নেয়ার সাহস অর্জন করো মেয়ে। ঘুরে দাঁড়াও। চিৎকার করে বলো, আমি স্বকীয়া করি, কোনো সমস্যা?

এই কথাগুলো নারী নয়, পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য। নারী তার ভালোবাসার সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠাই করতে চায়। আর এ ধরনের সম্পর্কে পুরুষ আসলে আম খেয়ে আঁটিটি ছুড়ে ফেলার মতোই নারীকে ছুড়ে ফেলে। দিনশেষে নারী ওই মন্দের ভালো হিসেবে তার অপছন্দের স্বামীতেই ফিরে আসতে বাধ্য হয় পরকীয়া প্রেমিক থেকে প্রতারিত হয়ে।

এমন কাহিনি ভুরি ভুরি। বলা হচ্ছে, প্রতিটা প্রেম, প্রতিটা সম্পর্কই বাস্তবতা। তাই পরকীয়া দোষের নয়। ঠিক তাই। প্রতিটা নিপীড়ন, প্রতিটা খুনই তো বাস্তবতা। তাই মানুষ হত্যাও দোষের নয়। আমি মানুষ হত্যা করি, কোনো সমস্যা?

নারী দর্শনে পুরুষের কাম জাগে। এটাও তো বাস্তবতা। তাই ধর্ষণ কোনো দোষের নয়। বাংলার দামাল ছেলেরা ধর্ষণ করে। কোনো সমস্যা? কেউ কেউ বললেন, বিয়ে থাকলে পরকীয়া থাকবে। তাই পরকীয়াকে ঘৃণা করতে হলে আগে বিয়েকে ঘৃণা করতে হবে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানই থাকা উচিৎ নয়। বাহ! এভাবে এত স্মার্টলি চিন্তা করলে তো আর কোনো সমস্যাই থাকে না।

খুব সহজেই তবে হাঁটা যাক সভ্যতার উল্টোপথে, আদিম যাত্রায়। পশু সমাজের আদলে গড়ে তোলা যাক সমাজ ব্যবস্থা। বাবা মেয়েকে, ভাই বোনকে, যার যেমন খুশি ইচ্ছা বাঁচুক। শুধু নিজের খুশি মতো বাঁচুক। পরকীয়া করুক, পরকীয়ার পথে বাধা আসলে খুন করুক। কি, খুব অস্বাভাবিক লাগছে শুনতে? পরকীয়ার অশুভ পরিণতির উদাহরণ কি কম রয়েছে আমাদের সমাজে?

সেই মনির-খুকুর পরকীয়া প্রেমের কথা মনে আছে? যে কারণে জীবন দিতে হয়েছিল নিরপরাধ শারমীন রীমাকে? পরকীয়ার নেশায় মত্ত হয়ে নিজের সন্তানকে টুকরো টুকরো কেটে পাঁচতলা থেকে ফেলে দিলেন এক মা, এইতো বছর কয়েক আগের কথা। সেই মায়ের মানসিক রোগ ছিল, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যেখানে পরকীয়া নিজেই এক মনোসামাজিক ব্যাধি।

কিম্বা সাম্প্রতিক সময়ের নতুন করে আলোচিত বিষয় স্বপ্নের নায়ক সালমান শাহ্ মৃত্যুরহস্য। এসবই যে পরকীয়ার বলি। শুধুমাত্র পরকীয়ার কারণেই ঘর ভাঙে অসংখ্য মানুষের। কারণ কোনো মানুষই সঙ্গীর হাজারো অন্যায় আচরণ মেনে নিতে পারলেও পরকীয়াকে মানতে পারে না। ফলাফল বিচ্ছেদ। মিষ্টি প্রেমের জনপ্রিয় জুটি দুজন ভালো মানুষ তাহসান-মিথিলাও পারলেন না সংসারকে জয় করতে।

ভিতরে অনেকে পরকীয়ার মৃদুমন্দ উপস্থিতির গন্ধই পেয়েছেন। তারকাদের বেলায় এমন উদাহরণ অনেকই দেয়া যায়। তাই পরকীয়াকে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে মানবতার দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কোনো ভালো কথা নয়। এ ব্যাধি এমনিতেই সমাজে বিদ্যমান। বরং একে নিরুৎসাহিত করার দায়বদ্ধতা শিল্পের মানুষদের থাকা উচিত। যেমনটা দেখিয়েছেন করণ জোহর তার ‘কাভি আল বিদা না ক্যাহেনা ‘ ছবিতে।

সেখানে দেখা যায়, অভিষেক বচ্চন তার স্ত্রী রানী মুখার্জীকে দিন শেষে বিশেষ মুহূর্তে আবিষ্কার করেন ঘুমন্ত নাক ডাকা রত অবস্থায়। অথচ এই রানীই অভিষেকের ব্যস্ততায় নিজের জীবনের হতাশার গল্প শেয়ার করে বন্ধুত্ব করে প্রীতি জিনতার স্বামী শাহরুখের সঙ্গে। তাদের যত্ন নেয়া বন্ধুত্ব প্রেমে গড়িয়ে শারীরিক আবেগেও অংশ নেয় অপরাধবোধ গ্লানিকে সাথী করেও। করণ যে মেসেজটি এই ছবির মাধ্যমে দিয়েছেন তা হলো, সম্পর্কের যত্ন।

যে অযত্ন আপনাকে বা আপনার সঙ্গীকে পরকীয়ায় ঠেলে দিল সেখানে গিয়ে কিন্তু আপনি একটি সম্পর্কের যত্নই করছেন। প্রেমান্ধ বেপরোয়া হয়ে সন্তান বা সঙ্গীকে খুন না করেই হয়তো নতুন সম্পর্কে পা বাড়াতে পারলেন। কিছুদিন তুমুল বাঁচলেন। তারপর সেই সম্পর্কও কিন্তু একদিন পুরনো হয়ে যত্ন চাইবে! তখন কি তাকে যত্ন করে আগলে রাখবেন না আবারো নতুন ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন?

চিত্রনায়িকা শাবানা অভিনীত চরিত্রগুলোর মতো সব নিপীড়ন সয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে কাউকে বলি না। কিন্তু সেখান থেকে বের হতে পরকীয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। পরকীয়ার মতো নেতিবাচক বিষয়গুলোকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আমাদের রিপুগুলোই যথেষ্ট। কলমকে তাই আবেগ নয়, বিবেকের জন্যই না হয় রাখি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট