নয়ন মাহমুদের কবিতা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২০

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ

শোনো মানবিকা, আমাদের নিয়তি বড্ড খারাপ।
নইলে বন্যায় এভাবে ভেস্তে যেত না শস্য;
অথবা, জন্মান্ধ চাঁদের নেশায় উন্মাদ হয়ে
তোমার বাবা কখনো হতো না পাগল!
কিংবা— থাক,
নিয়তির দোহাই দিয়ে কী হবে!

নদী ভাঙনের স্মৃতি
আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিতে-মগজে।
এসো, আজ ভরা পূর্ণিমায়
সমুদ্রের নোনা জলকে স্বাগত জানাই।

মানবিকা, সবকিছুর জন্য ভুলেও
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলো না।

স্তন

ও মেয়ে, তোমার শরীরের মিঠে ঘ্রাণ
ভুলিয়ে দ্যায় সবকিছু।
আর আমি আনমনা হয়ে কেবল
বিনিদ্র রাত কাটাই। এবং ভাবি,
স্তনের অমন অপূর্ব উষ্ণতা ছেড়ে
কিভাবে নিজেকে নিঃসঙ্গ রেখেছি
এতকাল—বুঝি চাঁদ ডুবে গেল মেঘে!

স্বরচিত কারাগার থেকে বেরোতে চাই
তুমি কি আমার সঙ্গী হবে?
চলো, চালতা ফুলের মতো
নগ্ন হয়ে যাই— তখন চারপাশে
ঝরুক কুয়াশা—রটাক দুর্নাম।

মৃত্যু, বিনাশ এবং শিল্প

জন্ম-মৃত্যু। মাঝখানে শৈশব, কৈশোর, ভাষা শেখা,
বইপাঠ, ঘুম, স্বপ্ন, মিথস্ক্রিয়া। ভাঙা আর গড়া
চলে অবিরাম। নগ্ন চাঁদ, রাত, ট্রেনে কাটা মড়া,
অলৌকিক উপাখ্যান শুনে শুনে, এ পৃথিবী দেখা
অব্যাহত থাকে। কিন্তু একদিন সাঙ্গ হয় সব
কবর খোড়ার ছন্দে। মহামারি আসে, যুদ্ধ বাধে,
দুর্ভিক্ষ নামে। তখন ক্রমান্বয়ে যীশু ক্রুশ কাঁধে
ফিরে যায়। অকস্মাৎ পারমাণবিক, যে তাজ্জব!
স্বপ্নালু রবীন্দ্রনাথ আৎকে ওঠেন। আহ, মোনালিসা
শিল্পের অব্যর্থ শক্তি, অবৈধ সঙ্গম—বিবমিষা।

মৃত্যু ধ্রুব তীব্রতর অনুভূতি। বিনাশ বিগত
ডাইনোসর আখ্যান। শৈল্পিক বিধাতা সময়ের
চিরন্তনী সুর। স্বপ্ন সুবাসিত কবিতা অক্ষত,
অজর, অমর; ভাষা ফুরায় হারায় গাম্ভীর্যের
হিম। বোদলেয়ারের জগতে স্থিতধী কারুকার্য,
মদ্যপ বলয়। লাশ পোড়ে একা শ্মশানে, জীবন
ক্রান্তিলগ্নে সমাধান এই। অস্তিত্ব নিয়ে রাবণ
পুড়ে ছাই। কিন্তু বেঁচে থাকে রস, শিল্পের আচার্য।
এভাবে মৃত্যু, বিনাশ এবং শিল্পের চলাচলে
মানুষ লাট্টু পৃথিবী নিয়ে পাতে সংসার, জলে?

মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

বিকৃত চন্দ্রিমা ছাপ রাখে
পতিতার বুকে, উদাম পাছায়।
ঈষদুষ্ণ স্তনে রাত্রি ফেলে দীর্ঘশ্বাস হাহাকার।
স্বরচিত কোনো আত্মহত্যা হাঁটে
পুকুরের শান বাঁধা ইটে।
নিহত ঘুম গহ্বরে
ফরাসি শৈল্পিক চোখ নৈরাজ্যের সাক্ষী।
গিলোটিন—গিলোটিন।
রক্তের নেশা অম্লান।

এথেন্স মঞ্চে দাঁড়িয়ে
দার্শনিক উপাখ্যানে বার্চ, লাইলাক।
নিজেদের বিকশিত স্নায়ু, শিশ্ন, শিরা, উপশিরা।
নিঃসঙ্গ দাঁড় বায় টেমসের স্রোত, রাতের বিশুদ্ধ শ্বাস।
অজস্র কবিতা ঠাঁই পায় মস্তিষ্কে, হৃদয়ে, মন্থর সময়ে।
এভারেস্ট অস্থি, তন্ত্রী: যেন এক সাহসী যুবতী।

দুঃস্বপ্নে নেকড়ের পাল

দুঃস্বপ্নে নেকড়ের পাল তাড়া দিচ্ছে ঘুমের গহ্বরে
কিন্তু কোথায় পালাবো?
শরীরে গাঁজার গন্ধ, ভবিষ্যৎহীন বর্তমান,
সড়কে পথচারীর লাশ, যুদ্ধ ছাড়া কোনো ইতিহাস
যেন নরকে অগ্নি জ্বালানো।
বন্ধ ঘরের কপাট, অজানা বৃক্ষের ছাল,
আর নগ্ন কিছু দৃশ্য দেখে ক্রুশবিদ্ধ আমি,
মাতালকে বন্ধু জেনে,
বেশ্যার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে ফুল,
মানুষের ভিড় ঠেলে
ঠিকঠাক খুঁজে নেব নির্জন আশ্রয়।

ফুলঝরা ভোরে শোনা যায়,
নামহীন পাগলের কুজ্ঝটিকা।
উন্মাদের কথার শৃঙ্খলে
দর্শন পাঠের তীব্র অনুভব।
নেশাখোর চাঁদের মুলুকে
বৃষ্টি ছোঁয় নিবিড় সভ্যতা।
শরীর প্রকোষ্ঠে বাসা বাঁধে মহামারি,
দূর্ভিক্ষ বোঝাই স্তূপ কাঁধে নিয়ে
থেকে থেকে চিক্কুর দ্যায় জননী,
কে কোথায়, কে কোথায়?

হো হো হেসে অকস্মাৎ
আমার অন্তিম ক্ষণে
ঈশ্বরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে  
মূদ্রার ওপিঠ

মৃৎপাত্র
লাজুক কবিতা
অন্ধকার
সক্রেটিস
ইডিপাস
নাকি প্রেয়সীর কালো চুল, মুখ
কোন স্মৃতি জাগবে হৃদয়ে?
সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক।

পৃথিবীতে এখনো তো শিশু হাসে সেটিই বিবেচ্য।
অন্তত আকাশে আজও লুব্ধক দ্যাখে
কোনো কৌতূহলী সত্তা।
আবার কবিতা পড়ে কেউ কেউ
শিল্পের অব্যর্থ মোহে।
তরুণীর চোখে গেঁথে যায়
হঠাৎ কখনো যুবকের অমূল্য হৃদয়।  
এই ভালো, আর কিছু নয়
নীলিমায় উড়ুক চিল, কোকিলের দল।
ঘরে ফিরে চাষা কৃষাণীর শাড়ির আঁচলে
মুছে নিক তাবত দুঃখের পাঠ।
অবিকল আমার মতো যমজ
কোথায় ঘাপটি মেরে আছে—অন্তত
করতে দাও অনুমান।
হিরোশিমা নাগাসাকি পুড়ে খাঁক হয়ে গেছে,
অনুরোধ বলো না কস্মিনকালে কখনো ভুলেও।
তারচেয়ে চলো খাসা মদের নেশায়
মুগ্ধতার স্পর্শে বলি, বিশাল অ্যালব্যাট্রস।