নীহার লিখনের দীর্ঘকবিতা ‘বাবা ও কাকতাড়ুয়ার ছায়া’
প্রকাশিত : মে ০১, ২০২১
বিকেল আমার প্রিয়তা হারায় না তবু, রজ্জুরূপের রশ্মিগুলো তার খুব করে একবার দেখেছি কভু
হেয়ালি দিনে, মুদির দোকান থেকে হাজিবাজি সুখ কিনে, জেনেছি চিনেছি তাকে আজীবনই বাবার পিছন-ধরা খিলখিল কাল, টিয়া-ভরা উঠানের কাচামিঠা আমটার ডাল
যদি বলে কেউ অঘোষিত সন্যাসী সে; সময়চক্রে কোনো পান্থ ঘোড়াটারই নাম; দূরে যার ধাম, ফেলে গেছে দল, এক এলিয়েন, ভীতু শতদল, অনিশ্চিতের পানে যায়; আমি তার কথাকে ফানুস বা ধূর্ত মানুষ ধরে চুপই থাকবো সব সর্বোপরে, বলবো না তেমন কিছুই, প্রতুত্তরে; একটা মে মাসে সে ছিল হন্তারক রোদ্রের চরে, পাখিরা মাঠে ছিল ঠোঁটের উপরে, বাবার আত্মাটা সবুজ ফলের চকচক, ঝরেছিল রাস্তার ঝরে
কিছুই থামেনি, এমনকি রিক্সার বেলও, বাহির বাড়িতে থাকা শিশুদের মেলও, মাঝে তাকে দেখেছি কী উৎকট শিংয়ের মহিষ, দুমড়ে ভেঙেছে মন কপট সহিস
যদি ধরি সাদা ঘুড়ি, মেঘ যার ছদ্মের বেশ, বোঝার আগেই মুছে জল, চোখের কিনার থেকে গড়াবার আগেই উবিয়ে নিয়েছে হৃদভূমি, সমস্ত নীল রঙ, মরা পায়রা-খোপের ক্রন্দন, আকুল হাপিত্যেশ
তারপরও সেগুনের ঝুমকা ফুলের দিকে চেয়ে তারে দেখি, বাদলার তলে, উম্মুল কোনো যার সন্তের ছবি, সশ্রদ্ধ সুন্দরে নিভৃতে রয়েছে ভীষণ, সেই তপোবন, পরিতাপ শুষছে অপার, সামান্য আয়ুর কোনো বেনামের ফুল, যেন নদীর দু`বাহু, গর্তে রয়েছে এক নিরাল নিবাস কোনো চখি ও চখার
বহুবার ঘুরে এসে থিতু হই আপন উজান ভাঙা নিজেরই মায়ায়; জগতের কোলাহল মুখরতা দু`হাতে সরিয়ে এক করুণ কায়ায়, তাকে ধরতে যায়নি পারা কোনো দন্ডেই, সামান্য আলোর নরোমে যেন শনের শিরায় নড়া সামান্য বায়ু, ঢেউ, অচ্ছুৎ মীনে; বিকাল বুঝেছি আরও কঠোর কাঠের গুড়ি, মে`মাসের দিনে, কুন্ডুলিত কোনো বিষ-ধোঁয়া সন্তর্পণে, ছেয়েছে আকাশে কালো দাঁতাল প্রেতটা যেন পাতাভ্রমণে, তার মুখ নাই, কালা যে বুকটি পাতে শীতল পাটির, অর্জুন দেখেছে যা চিরদিন বিশ্বরূপে, তা রাই দেখে নাই
মানুষ মাটির মোম, জলে গলে যায়,
উত্তাপে জ্বলে
প্রেম এক কল্পনাপ্রসূন, স্বর্গ ভেবেছে তারে সুধা-অমৃত, খেলাচ্ছলে; ম্লেচ্ছর রীতির উদ্ভাসে ঈশ্বরে প্রাণ সপে দিলে, প্রণতির স্বর-গান, সে ক্লান্ত করেছে কত আকণ্ঠ ঘোলা জল, মুক্তি-পাহাড়, উগড়ে দিয়েছে তার পুঁচ-পুতি ঢল
সত্যি করেই যদি নিস্পৃহে বলি, সোনার পাখিটি কেউ জেনেছে কেবল কোনো বিকালের ডানায়,
তাকে অবিরাম পুড়েছে আগুন, অতলে যে সাগর তার বিভ্রম অনন্তকালে ডুবিয়েছে শব-জলযান সূর্যের মতন, চোখের পলকে সব জলের ফেনায়
তারপরও মোহন রোদনে, কোনো করুণ তারের যন্ত্র ঘোর-সুরে বেজে যায় অসহ্য বিপন্নতায়,
জলার পাটেই নির্জলা আহত ব্যাঙ্গমা চুপে রাখে আকাঙ্ক্ষা সোনা, তন্নতন্ন করে খোদ পৃথিবী নিজেই খোঁজে পড়ন্ত আলোর কণা, পদ্মের বিধুরতা
আমি ছিটা-ধান আজ বৃন্তহারা, রাস্তার মাড়িতে উড়ে বিবর্ণ হই, যমজের মুখ নাই কুয়াশার খই, পয়মন্তের বুক জীর্ণ বসনে বাবা কাকতাড়ুয়াটা খুলে গেছে বলে, সোনালি গন্ধে ঝনঝন বুঝি নাই সেই সাইরেন,
যারে মুরালি বাঁশির মতো বিকাল দেখেছে পৃথিবী, হেমন্তকালে
প্রত্নের হাড়ে আজ কে বাজায় কাহারবা তালে, গরম ধুলার বিকীর্ণ রিপুর অসার খালি কাউনের খেতে; বাবার ছায়ায় বসে কতো ডুফি লাল নখে খুঁচেছে নুড়ির নীচে শস্যের ভাগ, যেন আরেকটা ছায়াপথে তারাদের রাত ছিলো বরফি ঘ্রাণে, ও মায়ার আমবনসূধা, সান্ধ্যকাঁঠালের এ ধন্য জগত, তোমারাও পেয়েছিলে তাঁরই প্রবর সে ছায়া, সুবাসিত স্থির কোনো অশোকের মতন মায়া, আমার মতনই ভারে ভাদ্রে কি মুক হও, আগুনের লালে
ছায়া পাই প্রখরের ইনকার থেকে যেন আরো দূর নভোমন্ডলে; কোনো মাধবী লতা, নুয়ানো বরিষ গড়াচ্ছে গোলাপ জলের দুখি গন্ধের ভারিক্কি মনে
ও গ্রহান্তরী কোনো চিলের বিলাপ, স্কন্ধে বইছো নিয়ে তুলার আকাশ, মাদুর আমার, নির্বান ঘুম
দামামার দিনে, দুবাহূ তোমার দেখি প্রসারিত হয় পাকুর মেদুরে, রবহীন মা পাখির মতো, নয়তো সুফির বেহালাটা, তীব্র নিশিথ ভাঙা সুরে
ও কাকতাড়ুয়া তুমি গভীর বোধের মমি, আলের প্রান্তে ও অন্তরে গিঁথেছো কালের পরিধী, ছায়া দীর্ঘ অশ্বত্থের পাতারা তোমার , যার বুলানো আঙুল আমি মাথার চুলের নীচে পাই, পুষ্পান্যের মতো মিহিন, পরম বেহাগ কালে , আজ, অবধি
বিগ্রহে নাই যে জীবন, সেখানে পাখিরা থাকে নাই, বাবাওতো পাখি, মন বলে যারে চিনে পৃথিবী অকালে, থেমে গেলে চোখ, বিচল দৃষ্টি থেকে মুখ সরে না, যাকে প্রবাহ মানি, সুপ্ত প্লাবন শিরাবাহী, পরিতাপ নদী হলে ডুবে যায় মাঝি, পাড়ে ফিরে না
বিকাল, বাবার ফেলে রাখা জুতার মতন ফালগুন, ব্যাপিত হয়েছে শেষে তোমারও হাসির দুনিয়ায়, এরপরে পাথর বা পাহাড় শুধু হলদে-মলিন হয়েছে, দূর্বার ভেতরেও শুনি মথ গুন্জন, নীরব আপেল কোনো একাকীত্বের বাগানে বাতাসে ঢালছে শুধু অস্ফুট গোমরা প্রহর, অপলক ঝুলনের তোর, দূরে জানলা খোলার শব্দে আরও বেশী হিম নেমে আসে যেন প্রস্থিত পাখির স্মৃতিরা থমকা মায়ের মুখের মতো দুপুরের পাড়ায়
সে বিকাল মে মাসে, যেন গাজীর গীতের মন ঘাড়টি ঘুরায় কোনো চিরল বিকারে, না কান্না , না আবহ না তেমন কথাটি রন্ধ্রাশ্রয়ী আজও যাকে বলা যায়, যতোটা শিউলি কোনো সকালে মোহন; ধরি যদি মনিমস্তক কোনো সাপের আলাপই যে ছিলো, রোশনি পাথর ঘাসে রেখে আর পায় নাই, প্রাণের বিথরে, দিনে দিনে সে ইতিহাস উপকথা হয়ে শেষে ভুলেছে সহায়
আমি জানি সে মনি লুকিয়ে থাকে ভরা জোত্সনায়, কাকতাড়ুয়ায়, বাবার ছায়ায়