নীল বিদ্রোহ এবং নীলদর্পণ নাটক: ভিন্ন দৃষ্টিতে

পর্ব ৪

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০২১

সাধুচরণের একমাত্র কন্যা ক্ষেত্রমণি, সে বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা। ক্ষেত্রমণি নীলকুঠির আমিনের নজরে পরে। এই আমিন নিজের বোনকে নীলকরদের হাতে তুলে দিয়ে আমিনের চাকরি পেয়েছে। সে ভাবে ক্ষেত্রমণিকে যদি নীলকর রোগ সাহেবের হাতে তুলে দেয়া যায় তার আরো উন্নতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। নীলকুঠির রোগ সাহেব লম্পট হলেও উড সাহেবের চরিত্রটা লম্পটের নয়, সে চায় মুনাফা। শুধু নীল ব্যবসায় তার আগ্রহ। সেজন্য রোগের লাম্পট্য তার পছন্দ নয়। কিন্তু আমিন রোগ সাহেবের দুর্বলতা নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে চায়। পদী ময়রাণীকে পাঠানো হয় ক্ষেত্রমণিকে রাজী করানো জন্য। ক্ষেত্রমণি এই কুপ্রস্তাবে রাজী না হলে তাকে জোর করে নীলকর সাহেবের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। ক্ষেত্রমণি রোগ সাহেবের কথায় রাজী না হয়ে তাকে ভর্ৎসনা করলে রোগ ক্ষেত্রমণির পেটে ঘুষি মেরে তার চুল টেনে ধরে। ঠিক তখনি, ক্ষেত্রমণির সতীত্ব হরণের সামান্য আগে নবীন ও তোরাপ সেখানে পৌঁছে তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে। নীলদর্পণ নাটকে নীলকরদের দ্বারা নারীহরণ ও নারীর উপর নীলকরের যে অত্যাচারের কাহিনী সন্নিবেশিত করা হয়েছে তা একটি সত্য ঘটনা।

যশোরের কাচিকাটা কুঠির ব্যবস্থাপক অর্চিবল্ড হিলের দ্বারা এটা ঘটেছিল। এই ঘটনা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেজন্য হিল হরিশচন্দ্রে বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে। ম্যাজিস্ট্রেট এই মামলায় হিলের পক্ষ নেয়। এই মামলা চলাকালে হরিশচন্দ্র হঠাৎ মারা গেলে তার স্ত্রীর নামে মোকদ্দমা চলেছিল। হরিশচন্দ্রের অসহায় স্ত্রী অনন্যোপায় হয়ে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে এই মামলা নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হন। নীলদর্পণ নাটকে ক্ষেত্রমণির উপর উডের আক্রমণাত্মক ভূমিকা দেখানো হলেও শেষপর্যন্ত নাট্যকার ক্ষেত্রমণির সতীত্ব রক্ষা করেন। নাট্যকার এখানে বাস্তববাদী না হয়ে নারীর সতীত্বের সংস্কারকে গুরুত্ব দেন এবং অকস্মাৎ তোরাপের আগমনে ক্ষেত্রমনির সতীত্ব রক্ষা পায়।

দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ নাটকের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে সোমনাথ পত্রিকার একজন গ্রাহক বারোশো উনসত্তর সালের চব্বিশে ভাদ্র সংখ্যায় লিখছেন, ‘নীলদর্পণের বর্ণনায় যদি কোন মহাত্মার সন্দেহ থাকে, তবে বারেক এ প্রদেশে আগমন করিয়া নীলকরের অত্যাচার ও বিচার প্রণালী ও অস্মদের অবস্থা ক্ষণকাল অবলোকন করলেই বর্ণিত পুস্তকের একটি কথার প্রতিও অবিশ্বাস করিবার অনুমাত্র কারণ থাকিবে না।’ দীনবন্ধু সত্যিই তাঁর বর্ণনায় কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। নীলকরদের দ্বারা যে-সব অন্যায় হয়েছে তিনি তাই সততার সাথে নাটকে চিত্রিত করেছেন। তিনিই ইংরেজদের বিচারের প্রহসন বাংলা সাহিত্যে প্রথম তুলে ধরেন। ইংরেজ শ্বেতাঙ্গরা কিভাবে বিচারকে নিজেদের পক্ষে প্রভাবিত করে তার বর্ণনা দেন নাট্যকার। নাটকে উড সাহেব খুব তৃপ্তির সাথেই বলেন কৃষকরা আদালতে গেলে সুবিচার পাবে না।

নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলা করে রাইয়তদের কোনো লাভ হবে না। মামলা পাঁচ বছর ধরে ঝুলতে থাকবে। নাটকে উডের সংলাপ, ‘মোকদ্দমা কিছু হইবে না, এ ম্যাজিষ্ট্রেট বড় ভাল লোক আছে। দেওয়ানী করলে পাঁচ বছরে মোকদ্দমা শেষ হোবে না। ম্যাজিষ্ট্রেট আমার বড় দোস্ত।’  

নীলকরদের পক্ষ থেকে গোলক বসুর বিরুদ্ধে সত্যি সত্যি মিথ্যা মামলা করা হয়। ইন্দ্রবাদের আদালতে বিচারক শুনানীতে বসেছেন। নাটকের আদালতের দৃশ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের শাসন ব্যবস্থা এবং দেশীয় শিক্ষিতদের তোষামদকারীদের চরিত্রটি খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা নাটকে আদালতের দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। খুব বাস্তবসম্মতভাবে নাট্যকার আদালতের দৃশ্যটি তুলে ধরেছেন যার সাথে তৎকালীন সংবাদপত্র বা বিভিন্ন দলিলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে মোক্তারের সংলাপে ব্রিটিশ শাসনে ভদ্রলোকদের মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট। মোক্তার বলছে, ‘ধর্মাবতার মোক্তারগণের বৃত্তিই প্রতারণা। কিন্তু নীলকরের মোক্তারদিগের দ্বারা কোনরূপ কোন প্রতারণা হইতে পারে না। নীলকর সাহেবরা খ্রীষ্টিয়ান.; খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে মিথ্যা অতি উৎকট পাপ বলিয়া গণ্য হইয়াছে, পরদ্রব্য অপহরণ, পরনারীগমন, নরহত্যা প্রভৃতি জঘন্য কার্য খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে অতিশয় ঘৃণিত, খ্রীষ্টিয়ান ধর্মে অসৎ কর্ম নিষ্পন্ন করা দূরে থাক্ মনের ভিতরে অসৎ অভিসন্ধিকে স্থান দিলেই নরকানলে দগ্ধ হইতে হয়। করুণা, মার্জনা, বিনয়, পরোপকার খ্রীষ্টিয়ান ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, এমন সত্য সনাতন ধর্মপরায়ণ নীলকরগণ কর্তৃক মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কখনই সম্ভব না।’  

যখন নীলকররা গোলকচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে এনেছে, ঠিক তখনই বাঙালী শিক্ষিত মোক্তার আদালতকে খ্রীষ্টান ধর্মের ন্যায়পরায়ণার কথা শোনাচ্ছে। চোখ-কান-নাক দিয়ে সে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। বাংলার শিক্ষিত সমাজের এই হয়েছে হাল। ইন্দ্রাবাদের আদালতের দৃশ্যে দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেট ও উড পাশাপাশি বসে হাসি মস্করা করছে এবং পাশাপাশি গোলক বসুর প্রহসনমূলক মামলার বিচার চলছে। কিন্তু এর পরেই দেখা যাবে নাটক মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করে।

নাটকের ঘটনাগুলো এরপর খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। নীলচাষ বা নীলবিদ্রোহ আর আলোচনায় থাকে না। দুটো পরিবারের দুঃখ বেদনা নাটকের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হয়ে কারারুদ্ধ হয় গোলক বসু। ভিন্ন জাতের হাতে কিছু খাবে না বলে সে তিনদিন উপোষ থাকে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পাচক ব্রাহ্মণকে রান্নার জন্য জেলে ঢুকবার অনুমতি দিচ্ছে না। এর মধ্যে খবর আসে গোলকচন্দ্র গলায় দড়ি দিয়ে জেলখানার ভিতর আত্মহত্যা করেছে। পিতার সৎকারের পর পিতার শ্রাদ্ধ শেষ করে নবীন গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার সংকল্প করে। কিন্তু তার আগে পুকুরপাড়ে নীল বুনলে নারীদের সম্ভ্রম থাকে না। সেজন্য নীলকুঠির সাহেবদের হাতে পায়ে ধরে নবীনমাধব পিতৃশ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত পুকুরপাড়ে নীলচাষ বন্ধ রাখতে বলে। এতে সাহেবরা তাকে উল্টো অপমান করে। নবীন অপমান সহ্য করতে না পেরে সাহেবের বুকে পদাঘাত করলে সাহেবের লোকরা ইচ্ছামতো নবীনকে মারধর করে। নবীনকে তলোয়ারের কোপে হত্যাই করা হতো কিন্তু তোরাপ মাঝখানে গিয়ে বাধা দিলে তোরাপের বাম হাত কেটে গিয়ে নবীনের বুকে শুধু তরবারির খোঁচা লাগে। তোরাপের সাহায্যে নবীনকে অজ্ঞান অবস্থায় গৃহে আনা হয় এবং সে প্রাণ হারায়। বিদ্রোহ করতে গিয়ে নয়, বরং নীলকুঠি সাহেবের দয়া চাইতে গিয়ে আকস্মিক উত্তেজনাই নবীনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে সাধুচরণের বাড়িতে ভিন্ন ঘটনা ঘটে। নীলকর রোগ সাহেবের ঘুষির আঘাতে ক্ষেত্রমণির পেটের সন্তান নষ্ট হয় এবং ক্ষেত্রমণিও এই ঘটনায় মারা যায়।

নাটকের ঘটনা এরপর আরো দ্রুত এবং অস্বাভাবিক গতিতে ঘটতে থাকে। নবীনের মৃত্যুতে তার মা সাবিত্রী উন্মাদ হয়ে প্রথমে মৃত নবীনের মুখে নিজের স্তন তুলে দিয়ে দুগ্ধ পান করতে বলে। সাবিত্রীর এরপরের সংলাপ নাটককে পাগলামীর পর্যায় নিয়ে যায়। সাবিত্রী উন্মাদ অবস্থায় তারপর যা করে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিজ কনিষ্ঠ পুত্রবধূ সরলতার গলায় পা দিয়ে তাকে হত্যা করে। সরলতার মৃত্যুর ব্যাপারটা খুবই অবাস্তব লাগে। উন্মাদিনী সাবিত্রী দুই হাতে সরলতার গলা টিপে ধরে ভূমিতে ফেলে দেয়, তারপর গলায় পা দিয়ে দণ্ডায়মাণ হয়। তারপর গলার উপর নৃত্য করতে করতে সরলতার মৃত্যু ঘটায়। সরলতাও শাশুরীর ইচ্ছায় কোনো বাধা দেয় না, মৃত্যু বরণ করে। খুবই হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য। সহসা সাবিত্রীর জ্ঞান ফিরলে যখন বুঝতে পারে সে আপন পুত্রবধূকে হত্যা করেছে তখন আকস্মিক মানসিক আঘাতে তারও মৃত্যু ঘটে। সাবিত্রীর মৃত্যুও যেমন আকস্মিক তেমনি অস্বাভাবিক। সরলতার এবং সাবিত্রীর মৃত্যু খুবই কৃত্রিমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নাটকের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা এই শেষ অংশটুকু। খুবই অতিনাটকীয়তায় ভরা। গোলকচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র বিন্দুমাধব ফিরে এসে নিজের স্ত্রী এবং মায়ের মৃত্যুর কারণ জেনে মায়ের মৃত্যুতেই যেন অধিক কষ্ট পায়। সব ঘটনা দেখে নবীনমাধবের স্ত্রী স্বামীর সাথে সহমরণে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বিন্দুমাধবের বিলাপের মধ্য দিয়ে নাটকটির এভাবেই সমাপ্তি হয়। সতীদাহ যখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তখন নাট্যকারের এ বক্তব্য সতীদাহর পক্ষে য়ায়। নারীরা স্বামীর সঙ্গে সহমরণ পছন্দ করে, নাট্যকার যেন তাই বোঝাতে চান।

নাট্যকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনা আরম্ভ করেছিলেন, রচনার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই তিনি সে লক্ষ্য হতে সরে দাঁড়ালেন। কিংবা বলা যায় লক্ষ্য পথ ভ্রষ্ট হলেন। দীনবন্ধু কৃষকদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে নাটক রচনা আরম্ভ করলেও নাটকের পরিণতি পর্যন্ত সে লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেননি। নাটকের ঘটনা নীলবিদ্রোহ থেকে সরে গিয়ে দুটি পরিবারের দুঃখকষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল এবং একটি পরিবারের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে নাট্যঘটনা অতিনাটকীয়তার আশ্রয় নিল। নাটকের কাহিনী যখন বৃহত্তর সমাজকে পরিত্যাগ করে পারিবারিক করুণ রসে পরিণত হলো দীনবন্ধু তখন আর উদ্দেশ্যমূলক রচনার লক্ষ্যে স্থির রইলেন না। নাটকের পরিণতিতে মৃত্যুর যে ঘনঘটা দেখা যায় তা খুবই অবাস্তবভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। ক্ষেত্রমণি ছাড়া আর কোনো মৃত্যুই কাহিনীর সুদীর্ঘধারার অনিবার্য পরিণতিরূপে সংঘটিত হয়নি, যা নীলকরদের অত্যাচারের ফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শেষ কয়েকটি দৃশ্যে নাট্যকার নীল বিদ্রোহকে গুরুত্ব দেয়ার চেয়ে নাটককে করুণ রসে সিক্ত করতে অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। নাটকের বলিষ্ঠ চরিত্র ছিল তোরাপ কিন্তু সেই চরিত্রটি কোনো পূর্ণ রূপ পায়নি। নীলদর্পণ নাটকে মৃত্যুর আধিক্য নহে, মৃত্যুর যে কারণ দেখানো হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বিশেষ করে শেষ দুটি মৃত্যু।

বিভিন্ন চরিত্রের আকস্মিক মৃত্যু নাটককে পূর্ণ পরিণতি না দিয়ে নাটকের রসকে বিক্ষিপ্ত করেছে। নাটকটি জীবন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি। প্রথমে গোলক বসু পরে নবীনমাধব, ক্ষেত্রমণি, সরলতা ও সাবিত্রীর মৃত্যু নাটককে কোনোভাবেই পূর্ণতা দিতে পারেনি। আশুতোষ ভট্টাচার্যের ভাষায়, নাটকে কোনো কৃষকের মৃত্যু সংঘটিত হয়নি, তাতে করে কোনো কৃষকচরিত্র প্রাধান্য লাভ করতে পারেনি। বরং তার পরিবর্তে নিরীহ কায়স্থ পরিবারের লোকজনের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। ক্ষেত্রমণির মৃত্যুও যেভাবে হয়েছে তার সাথে কৃষিকমের্র কোনো সম্পর্ক নেই। নীলদর্পণ নাটকে ব্যাষ্টিক সমস্যা অপেক্ষা সমষ্টির সমস্যা ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে নাটকের যাত্রা শুরু হয়। নাটক শেষপর্যন্ত আর সেখানে থাকতে পারেনি। নাটকের ঘটনা প্রধানত দুটি পরিবারের ভিতরেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ মূল্যবোধ দীনবন্ধুকে বহুভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সতীত্বের মোহ, গ্রামীণ সামন্ত সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস তার নাটকের পরতে পরতে তাই পাখা মেলতে দেখি। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য এই সকল মূল্যবোধকে তিনি নাটকে খুব যত্নের সাথে স্থান দেন এবং তা করতে গিয়ে নাটকের সর্বনাশ ডেকে আনেন।

উৎপল দত্ত লিখছেন, নীলদর্পণে বসুদের নায়কের স্থানে মেনে নিতে আমাদের প্রাথমিক কোনও আপত্তিই থাকত না; যদি গোলক, নবীন ও বিন্দুমাধবে আস্ত নীলবিদ্রোহ প্রতিফলিত হতো।  তিনি আরো লিখছেন, ‘নীলকর সাহেবদ্বয় এবং তাদের কর্মচারীবৃন্দ; গোপী, আমিন ইত্যাদি; এঁরা হচ্ছে নাটকের নেতিবাচক শক্তি। এঁরা নীল-উৎপাদন ও ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। তার জন্যে যে কোনও জুলুম-জবরদস্তি তারা করতে প্রস্তুত। কিন্তু নেতির শক্তি কোথায় দেখছি? বসু পরিবারের মধ্যে কি নীলের ব্যবস্থাকে ওলট-পালট করে দেওয়ার তেজ ও উদ্যম মুহূর্তের জন্যও পরিলক্ষিত হয়? সেই তেজ দেখি তোরাপের মধ্যে।’ তিনি আরো লিখছেন, নাট্য কাঠামো তবু ভারসাম্য পেতে পারত যদি নীলবিদ্রোহের আগুনে পুড়ে বসু-পরিবার পরিবর্তিত হতো, নাটকটা যদি হতো তাদের মানসিক বিকাশের ইতিবৃত্ত। দীনবন্ধু তাঁর নির্বাচিত চরিত্রদের বাস্তব ক্ষুদ্রতা দ্বারা সীমিত হয়ে রয়েছেন। তাদের অকিঞ্চিতকর জীবনধারায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে নাটককে পঙ্গু করে ফেলেছেন। নীলদর্পণের শেষ দুই অঙ্ক জুড়ে শুধু নারী চরিত্রদের আহা! আহা! প্রাণনাথ এবং আহা! এইসব আর্তনাদে মুখর। সেই সঙ্গে মূর্ছা এবং পতন ও মৃত্যু। অথচ দর্শকদের হৃদয় দ্রবীভূত হয় না, কেননা যে গোলক ও নবীনমাধবের জন্যে এই রোদন, তাঁরা মৃত্যুর পূর্বে নাটকে বীরের ভূমিকা পালন করেননি; বস্তুত এমন কিছু করেননি যার জন্য দর্শকদের সমবেদনার জমি প্রস্তুত হবে। উৎপল দত্ত সঠিক কথাই বলেছেন। চলবে