অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার
নীলতিমি
ফারুক ইমনপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০১৮
চারতলা ফ্ল্যাট বাড়িটার তৃতীয় ফ্ল্যাটের পুরোটা একটা মেসবাড়ি, বাকি তিন ফ্ল্যাটে বাড়ির মালিক ও কয়েকটা পরিবার থাকে। রাজধানী ঢাকায় এরকম ফ্ল্যাটবাড়ি আছে অনেক। যে গল্পটা লিখছি সেটা মেসবাড়িটার বোর্ডারদের গল্প। শীতের শুরু নভেম্বরের শেষের সকালগুলো খুব শান্ত এই এলাকায়। ভোর ছয়টা ত্রিশ বাজে ঘড়িতে, নিচের কলাপ্সিবাল গেট খোলার শব্দ তিন তলা থেকেও শোনা যায় স্পষ্ট। মেসবাড়ির বুয়া এ সময় গেট খুলে প্রতিদিন, তিনতলায় উঠে এসে সকালের নাস্তার আয়োজন করে। ২৫ জন মানুষের খাবার রোজ তাঁর হাত দিয়েই তৈরি হয়। খাবার নিয়ে শত অভিযোগ থাকে রোজ মেসের বোর্ডারদের তবুও তাঁর হাতে তৈরী খাবার গলধকরণ করেই প্রাণগুলো তাঁদের জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যায় এই নগরযজ্ঞে।
মেসের বোর্ডারের নাম নেই এই গল্পে, তাঁকে সবাই বুয়া বলে ডাকে। বুয়ার শরীরটা আজ ভাল নেই, গা বেশ গরম, গতরাতে ভালো ঘুম হয় নি, জ্বর শরীর নিয়েই গতরাতের এঁটো থালাবাটি ধোঁয়ার জন্য পানির কল চালু করল। কল দিয়ে পানির বদলে বেড়িয়ে এলো কালো কাদার মত একধরণের তরল, ঢাকা শহরের পানি সাপ্লাইয়ে এটা স্বাভাবিক ঘটনা, বুয়া কল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো ভালো পানির জন্য, এই রান্না ঘরটায় বসার কোন জায়গা নেই, মেঝেতেও মালপত্রের কারণে শুধু দাঁড়ানোর জায়গাটুকু আছে। পানি এলো প্রায় তিরিশ মিনিট পর, সকালের রান্না শুরু হতেও দেড়ি হলো আজ।
সাড়ে সাতটা নাগাদ খাবার প্রস্তুত করে বুয়া নিজের বাসায় যায়, কিন্তু আজ সঠিক সময়ে রান্না শুরু না হওয়াতে মেসের অনেকেই খাবারের জন্য অপেক্ষা না করে বাইরে খেয়ে নেওয়াটাই সহজ মনে করল, কারণ ঠিক সময়ে বের না হলে সময়মতঅফিসে পৌছানো সম্ভবপর হয় না। রাস্তায় অনির্ধারিত জ্যামের কারণে প্রায়ই ভূগান্তি পোহাতে নয় এই নগরের বাসিন্দাদের।
ইমরান পড়ে এখানকার একটা কলেজে, তিন মাস হল উঠেছে এই মেসবাড়িটায়। ওর বয়সের আর কেউই থাকে না এই মেসে, বাকীরা অফিসে চাকুরে। কলেজ কাছে হওয়ায় আর মেসের ম্যানেজার নিজ এলাকার হওয়ায় সে এখানে থাকে। প্রায়ই ক্লাস শেষে বাড়িটায় যখন সে আসে, তখন চারদিক শুনশান-নিরব, সন্ধ্যা নাগাদ সবাই ফিরে, কারো কারো আরো দেড়ি হয়, দু একজন আবার বিকেলেই ফেরে, যাঁদের অফিসের দূরত্ব অপেক্ষাকৃত অল্প। আজ দুইটা ক্লাস হয়েছে, বাসায় এসে দেখে প্রতিদিনের মতই বাসা ফাঁকা, শুধু বুয়া রান্নাঘরে রাতের খাবারের আয়োজন করছে।মেসবাড়িটার পেছনের বারান্দার রেলিঙের কাছাকছি দাড়িয়ে ইমরান ফস করে একটা সিগারেট জ্বালালো। আরেক হাতে পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বের করে ওয়াইফাই কানেক্ট করে গতরাতের দেওয়া স্ট্যাটাসের আপডেট দেখতে ফেসবুক লগ ইন করল।
ছয় মাস পরের কথা, লোকজন যারযার কর্মে ব্যাস্ত, শহুরে কোলাহলের মধ্যেও, অনেক উঁচু থেকে বস্তা পড়ার মত চাপা একটা আওয়াজ লোকজনকে সচকিত করল। চারতলা মেসবাড়িটার নিচে ধীরে ধীরে জড়ো হলো একটা জটালা। ইমারানের থেঁতলানো মাথা থেকে রক্তের ধারা পিচের কালো রস্তায় একেবেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢালুর দিকে। তাঁর ফর্সা হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে আঁকানো একটা নীল তিমির ছবি।