নিস্তরণ
পাপিয়া জেরীনপ্রকাশিত : মে ২৯, ২০১৮
৩/৬, ব্লক বি, হুমায়ূন রোড। এইটা ডা. আরিফুল হকের বাসার ঠিকানা। সাজ্জাদ উনার সাথে একান্তে আলাপ করতে আসছে। সাজ্জাদের বাল্যবন্ধু হাবীবের আপন খালু এই মনোচিকিৎসক। উনার বাসার ঠিকানায় এসে সাজ্জাদের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। তিনতলা বাড়িটার উপরে এক বিশাল সাইনবোর্ড— `ঠিকানা`। এটা একটা সাইক্রিয়াটিক ক্লিনিক। সে বাসার ঠিক অপজিটে বিশাল গাছের নিচে দাঁড়ায়ে ঘামতেছে। এ গাছটা সম্ভবত নাগেশ্বর চাঁপা। কিন্তু তার জানা মতে, জাহাঙ্গীরনগর আর কার্জনহল ছাড়া অন্য কোথাও এগাছ থাকার কথা না। মাখন রঙের পেলব পাপড়িতে মৌমাছি ঘুরতেছে, এইরকম একটা দৃশ্য ঢাকার ব্যস্ততম এলাকায় সে দেখবে, ভাবাই যায় না! নাগেশ্বর চাঁপা গাছ সে প্রথম দেখে, পার্বতীপুরে। রেলওয়ে কলোনির সামনে তিনটা গাছ, সারাক্ষণ সেই গাছের নিচে খেলতো সে। আসলে রান্নাবাড়া খেলতো রেবু আপা, শিল্পী আর সাজ্জাদের ছোটবোন কণা। সাজ্জাদকে রাখা হতো দুধভাতে, ওর কাজ ছিল বাজার করে আনা। বাজার বলতে গাছের পাতা, কদম ফুল, বালি, গাছের গোটা।
`ঠিকানা`র গেইটের দারোয়ান সাজ্জাদের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকায়ে আছে। স্যার, আপনি কি কোনো প্যাশেন্টের আত্মীয়? ভেতরে যাবেন?
না, আত্মীয় না। ডা. আরিফের সাথে দেখা করবো পারসোনালি।
স্যার, আপনি রিসিপশনে গিয়ে ম্যাডামের সাথে কথা বলেন। আসেন।
রিসিপশনে নার্সের ড্রেসে বসে আছে এক স্বাস্থবতী মহিলা। ব্যাজে তার নাম দেখা যাচ্ছে, এমিলি। এমিলি ফোনে অনবরত মিষ্টি আলাপ চালায়ে যাচ্ছে কারো সাথে, পাশাপাশি নখে নেইলপলিশ লাগাচ্ছে। নেইল পলিশের রং বেগুনি। সে সাজ্জাদকে সোফায় বসার ইশারা করছে বারবার।
সিস্টার, আমি ডা. আরিফুল হকের সাথে দেখা করতে এসেছি।
আপনি কি পেশেন্ট?
জ্বী না! আপনি কাইন্ডলি উনাকে একটু বলেন, আমি ডা. হাবীবুরের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার সাজ্জাদ।
স্যার, আপনি বসেন। এখনই কন্টাক করছি আমি।
ডা. আরিফের সাদামাটা একটা ড্রইংরুম। একটা শ্যামলা মতো বাচ্চা ট্যাবে গেমস্ এ ডুবে আছে। রুমের দেয়ালে বিশাল ফ্ল্যাট স্ক্রিন, সেখানে নানা রুমের ভিডিও ফুটেজ। সবগুলিই মানসিক রোগীদের রুমের দৃশ্য। অধিকাংশ রোগীই বিছানায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শোয়া, কিন্তু একটা রুমে এক পেশেন্ট হনহন করে এদিক ওদিক হাঁটতেছে। তার ভাবভঙ্গি ভীষণ ডেসপারেট, উদভ্রান্ত দৃষ্টি সি.সি. ক্যামেরায় স্থির। ভয়াবহ দৃশ্য—
আপনি সাজ্জাদ? হাবীবের বন্ধু?
জ্বী, কেমন আছেন স্যার!
জ্বী ভালো, ভালো। আপনি কোথায় আছেন?
আমি এল. জি. ই. ডি তে। আগার গাঁ।
জ্বী জ্বী। আমি অবশ্য আপনার সমস্যার কথা শুনেছি হাবীবের কাছে। তবুও আপনার মুখে শোনাটা জরুরি। স্বপ্নবিষয়ক সমস্যা, তাই তো?
জ্বী। সমস্যাটা শৈশব কালের। এ পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছি। অস্বস্তিকর অবস্থা। আমার স্ত্রী পূর্বপরিচিত, সে বিয়ের আগে থেকেই বিষয়টা জানে। প্রথমদিকে সে বিষয়টা নিয়ে হাস্যরস করতো, কিন্তু গত দু’মাসজুড়ে দাম্পত্য সমস্যা ভয়াবহ। আমাদের ঝগড়াঝাটির কারণে একমাত্র সন্তানও ডিপ্রেশনে ভুগছে। নিজের বাসায় যেতে আমার প্রচণ্ড অনীহা জাগে। বাসায় গেলে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আতংক। দুজন মনোচিকিৎসক দেখিয়েছি। তারা শুধুমাত্র ঘুমের ওষুধ দেয়। এখন এতেও কাজ হয় না। ভয়ংকর জীবন আমার। মনে হয়, সব ছেড়ে একদিকে হাঁটা দেই।
আচ্ছা, আপনার বয়স, স্ত্রী ও বাচ্চার বয়স কত? আপনাদের কয় বছরের দাম্পত্য?
আমার বয়স ৪৬, স্ত্রীর বয়স ৩৫ আর বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর। আমাদেরর বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর।
আচ্ছা এবার আপনি স্বপ্নের কথা বলুন। আসলে আপনি শুরু করুন স্বপ্নের শুরুটা থেকে। একটি মেয়েকে স্বপ্নে দেখেন শুনেছি। তার সম্পর্কে বলুন।
বাবার রেলওয়ে চাকরি সূত্রে আমরা তখন ছিলাম সেতাবগঞ্জে। আমি তখন সেতাবগঞ্জ পাইলট স্কুলে ক্লাস এইটের ছাত্র। আমাদের কো এডুকেশন ক্লাসের একটা মেয়ে লিজি... সে শুধু শুধু আমার কাছে এসে কথা বলার সুযোগ খুঁজতো। আমি পড়াশুনা ও খেলাধূলায় দুর্দান্ত ছিলাম। লিজি আমার কাছে আসতো অংকের নানা সমস্যা নিয়ে। সে পাশে বসে খালি হু হু করতো, কিন্তু শেষে দেখা যেত, কিছুই বুঝে নাই। আমার বিরক্ত লাগতো, আবার ভালোও লাগতো। একবার ঠিক হলো, গ্রীষ্মের ছুটির পর আমরা সবাই মিলে পিকনিক করবো। দুশো টাকা করে চাঁদা। আমি ক্লাস ক্যপ্টেন, লিজি ছাড়া সবাই টাকা জমা দিয়েছে। সেদিন ছিল ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন। ক্লাস শেষে বের হয়েছি, তখন দেখি স্কুলের সামনে আমগাছের নিচে দাঁড়ায়ে আছে লিজি। আমাকে ইশারা করতেই কাছে গেলাম। কপ করে আমার হাত ধরে বললো, এই নেও পিকনিকের টাকা। আমি বললাম, আমি টাকা সব কালাম স্যারের কাছে জমা দিয়ে দিয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি স্যারকে টাকা দিয়ে আসো। একথা বলেই বাসার দিকে রওনা দেই। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে লিজি আমার বাসায় উপস্থিত। জানালা দিয়ে অনবরত ডাকছে। আমি বের হলাম। সে বললো যে, স্যারকে পায়নি তাই টাকাটা আমার কাছেই জমা রাখবে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, সামার ভ্যাকেশনে আমি নানিবাড়ি জামালপুর যাব। এই টাকা নিয়ে ঘুরতে পারবো না। তারপরও লিজি মুঠ করে টাকা আমার হাতের ভিতর দিয়ে যায়।
হুমম, তারপর?
ঘটনা এখানেই শেষ না। আমি তখনও জানতাম না যে, আমার আর সেতাবগঞ্জ ফেরা হবে না। ভ্যাকেশনের মাঝামাঝি এসে আমার বাবা সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা আর সেতাবগঞ্জ যাব না। স্বপ্নটা আমি সেদিন রাতেই দেখি, লিজি আর আমি একসাথে হাঁটছি, আমি তার হাত ধরে আছি। স্বপ্নে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই, কিন্তু ঘুমের মধ্যে নাকি আমি ওর নাম নিয়ে চিৎকার করি, গোঙাই।
তো, এখন সমস্য কী আপনার? আপনার স্ত্রী তো আগে থেকেই জানতো বিষয়টা। নতুন করে তার ঝামেলার কারণটা কি? ও হ্যাঁ, স্বপ্নটা কি আপনি প্রতিদিন দেখেন?
না স্যার! স্বপ্নটা মাসে দুতিনবার দেখি। স্বপ্নে যে চিৎকার করি, এতে করে আমার স্ত্রী জেগে গিয়ে আমাকে ডেকে তুলে। প্রতিবারই ডেকে তোলার পর আমি তাকে চিনতে পারি না। তাকে `পাপিয়া` নামে ডাকতে থাকি। এই রেশ প্রায় দশ মিনিটের মতো থাকে।
মনে হয় ওই বিষয়টাই সে মেনে নিতে পারে না।
পাপিয়া কি আপনার স্ত্রীর নাম?
জ্বী না স্যার! ইয়ে ইয়ে মানে, লিজির আসল নাম পাপিয়া।
আপনি কি `পাপিয়া` নামটি আগেও নিয়েছেন স্বপ্নে? নাকি রিসেন্টলি।
স্যার, আসলে আগে `লিজি` `লিজি` বলেই ডাকতাম ঘুমের ঘোরে। ইদানিং ওর আসল নামটা নিচ্ছি।
ওহ্ আচ্ছা। সাজ্জাদ, তবে এটাই আপনার স্ত্রীর রিএ্যাক্টের কারণ। সে তো জানে না যে, লিজিরই আরেক নাম পাপিয়া।
না, ইয়ে আসলে আমি তাকে বলেছি এ কথা। কিন্তু সে বিশ্বাস করে না আমাকে।
ভালো কথা! আপনার স্ত্রীর নামটি তো বললেন না।
ওর নাম পলি।
ওকে সাজ্জাদ সাহেব। আমি একটু রাউন্ডে যাব। আপনি আরেকদিন আসবেন। পলিকে সাথে নিয়ে আসবেন। আমার তার সাথে কথা বলা জরুরি। আপনি আগামী সপ্তাহে এই দিনেই আসুন।
কিন্তু ডাক্তার সাহেব, আমার স্ত্রী এখানে জীবনেও আসবে না। আমি জানি। আপনি শুধু একটাই সল্যুশন দেন যাতে আমি এই স্বপ্ন থেকে নিস্তার পাই।
সাজ্জাদ সাহেব, আপনার স্ত্রী আসবে নিশ্চয়ই। কিন্তু, আপনিই চাইছেন, সে যাতে না আসে। আমি আপনাকে খুব মন দিয়ে শুনেছি। আপনার পুরো গল্পে একটা বিশাল ফাঁক আছে, আর সেটা হলো `পাপিয়া`। লিজি একজন কিশোরী আর তার সাথে আপনার প্লেটনিক লাভের সম্পর্ক। আর পাপিয়া একজন ভিন্ন নারী। এবং আমার ধারণা পাপিয়াকে নিয়ে আপনার স্বপ্নদৃশ্য বেশ অন্তরঙ্গ। আপনি পাপিয়ার প্রসঙ্গে আসার পরই একটু কাঁপছিলেন, দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছিলেন, ব্লাশ করছিলেন আবার একটু তোতলাচ্ছিলেন। কিন্তু লিজির কোনো দৃশ্য বা স্বপ্নে আপনার এমন পরিবর্তন দেখিনি। এক্চুয়েলি আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আপনার স্ত্রী পলির সাথে কথা বলতে পারলেই পুরো জটটা খুলে যেতো।
স্যার, আমি চেষ্টা করবো ওকে আনতে।
আর শুনুন, লিজির বিষয়টার সল্যুশন একটাই। আপনি সপরিবারে সেতাবগঞ্জ যান। স্কুলটা ঘুরে আসুন। আসলে সেই স্কুলে থাকা অবস্থায় আপনি বন্ধুবান্ধব নিয়ে দারুণ একটা সময় কাটিয়েছেন। আর পড়াশুনা ও খেলাধূলায় আপনি সেরা ছিলেন। ভ্যাকেশনের পর আপনার অনেক প্ল্যান ছিলো... বয়ঃসন্ধিকালের ক্রিয়েটিভ প্ল্যান। আবার লিজির সাথে একটি অসমাপ্ত প্রেম। সব মিলিয়ে যখন দেখলেন আপনি আর সেখানে যেতে পারবেন না, তখন আপনার মনের অবচেতনে জটিলতা তৈরি হতে থাকে। অবচেতন মন বলে, আপনার সেখানে যাওয়া প্রয়োজন। তাই এই স্বপ্নের অবতারণা। স্বপ্নটা থেকে নিস্তার পাবেন তখনই, যখন আপনি আবার সেতাবগঞ্জ যাবেন। হা হা। আর দাম্পত্য সমস্যার কারণ শুধু এই স্বপ্ন না। কারণটা আপনি ও আপনার স্ত্রী জানেন। সাজ্জাদ, আপনাকে মনে হয় আর আসতে হবে না। আপনার কি হাইব্লাড প্রেশার আছে?
জ্বি আছে।
আপনি ওটার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন মেডিসিনে।
থ্যাংক ইউ স্যার! আসি।
রাস্তায় নেমেই সাজ্জাদ মোবাইল সুইচড্ অন করলো। এর মধ্যে পাপিয়া হয়তো একশো বার কল দিয়ে ফেলছে। হ্যালো পাপিয়া, সোনা!
তোমার ফোন বন্ধ ছিল ক্যানো? এক ঘণ্টা ধরে ট্রাই করছি।
আমি একটা বন্ধুর বাসায় এসেছিলাম। তাই...
বন্ধুর বাসায় ছিলা নাকি বউয়ের গলা জড়ায়ে ছিলা?
কী বলো এসব সোনা! ও গড পলি ফোন দিচ্ছে। আমি কলব্যাক করছি পরে।
তোমাকে আর কল ব্যাক করতে হবেনা সাজ্জাদ। আমি বুঝে ফেলছি তুমি তোমার বউ থেকে জীবনেও সেপারেটেড হতে পারবা না। তাই আমার আশা ছেড়ে দাও।
পাপিয়া! কী সব বলছো? শুরুতেই আমি বলেছি, আমি পলিকে ছাড়তে পারবো না। সে যেমনই হোক, আমার সন্তানের মা।
পাপিয়া চিৎকার করেই যাচ্ছে। সাজ্জাদের মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। তারপরও মোবাইল কানে নিয়ে নাগেশ্বর চাঁপা ফুলের দিকে তাকায়। মৌমাছি ফুলে জেঁকে বসে আছে। আসলে এগুলা মনে হয় মৌমাছিও না, কালো পেটমোটা ভোমরা। সাজ্জাদের কাঁধ আর হাত দুটা অবশ হয়ে আসে। মনে হয়, ঘাড় ছিঁড়ে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
সাজ্জাদের জ্ঞান ফিরে সন্ধ্যায়। সে তার নিজের বিছানায় শোয়া। পলির কান্না কান্না চোখ।
বউ, আমি বাসায় কেমনে আসলাম?
তুমি তো মোহম্মদপুর রাস্তায় মাথা ঘুরায়ে পড়ে গেছিলা। কেন মানসিক চিকিৎসা ক্লিনিকে গেছিলা? আমারে বলো নাই ক্যান? পরে ওইখানেই ট্রিটমেন্ট দেয়ার পর তোমারে হাবীব ভাই অ্যাম্বুলেন্সে করে দিয়া গেছে।
আমার কী হইছিল?
কিছু না। হাইপারটেনশন। ভয় পাইও না। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়া যাবে।
বউ, আমি একটু সুস্থ হইলে একবার সেতাবগঞ্জ যাবো। তুমি যাবা? আমার সাথে?
অবশ্যই যাবো। তুমি ঘুমাও তো।
সাজ্জাদ গভীর ঘুমে তলায়ে যায়। স্বপ্নে লিজি তার হাত ধরে। তারা মাঠের পর মাঠ হাঁটতে থাকে। সাজ্জাদ একসময় বলে, লিজি, আমি আসতেছি।
একথা শুনে লিজির চোখমুখ শুকায়ে যায়। লিজি সাদা ওড়না দুলায়ে দৌড়ায়ে হাওয়ার মতো মিশে যাইতে থাকে... যেমন বাতাসে শিমুল তুলা ধীরে নিরুদ্দেশ হয়।