অলঙ্করণ: রিফাত। ২০১৫ সালের চীন-বিপ্লবের পোস্টারে নজরুল। নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মিছিলে নজরুল নেতৃত্ব দিচ্ছেন কিন্তু তার পোশাক ও হাতের টমি-গান ‘মাফিয়া’ মার্কা।
নিষিদ্ধ নজরুল
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : মে ২৫, ২০১৯
কাজী নজরুল ইসলাম কেন বাংলার অন্য কবি-লেখক থেকে আলাদা? সেটা আগে প্রমাণ করা জরুরি, তাছাড়া কিভাবে নজরুলকে গ্রহণ করবো সেটা নিয়ে আমরা চিরকালই বিভ্রান্ত থাকবো। যদিও অনেকেই আজও নজরুলকে কবি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না! অথচ রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ঠিকই বলেছিলেন, তুই আমাকে খুন করেছিস!
১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে নিপীড়িত কবি ছিলেন নজরুল। আর কোনো সাহিত্যকের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে নাই। এতোটা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আর কেউ ভোগ করে নাই। কিন্তু এই নিপীড়ন আসলে জনতার উপর চলার নিপীড়নেরই অংশ, আর কোনো কবি এমন করে নিপীড়নের ভাগ নিজের পিঠে নেন নাই, একমাত্র নজরুলই নিয়েছিলেন। জনতার বন্ধু। জনতার নেতা। যদিও জনতা তাকে নির্বাচিত করে নাই একবার। কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন নজরুল।
অরগানিক ইন্টেলেকচুয়াল বলে একটা শব্দ আছে। গ্রামসি সাহেব এই শব্দটার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ যে বা যারা কোনো একটা সমস্যার সমাধানের জন্য দর্শন চর্চা করে, সমাধান খুঁজতে মাঠে নামে তারাই অরগানিক ইন্টেলেকচুয়াল। নজরুল ছিলেন সেই কবি। যার কবি হওয়ার কারণ কাব্য চর্চা না, বরং মানুষের মুক্তির জন্যই যার হাতিয়ার ছিল কবিতা। যে কবি মানুষের ভাত-কাপড়-আইনের মুক্তির জন্য কবিতা চর্চা করে, সেই আমাদের নিকট বন্ধু।
এমনকি নজরুল যখন গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, তার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত নজরুলকে ঠিক চিনেছিলেন। তাই তাকে বসন্ত হিসেবেই দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্যের বসন্তকাল মানেই কাজী নজরুল ইসলাম। আজও নজরুল বসন্ত হয়েই আছেন। আজও নজরুলের সাহিত্য জালিমের বুকে ধাক্কা দেয়।
এই ক্ষেত্রে শিশির করের ‘নিষিদ্ধ নজরুল’ অসাধারণ এক বই। নজরুলকে নিয়ে এমন বই আর দ্বিতীয়টি নাই। সেই বইয়ের তথ্যই আমাদের আলো দিচ্ছে এখনো—
নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’কে একটি ভয়ংকর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতার’ ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধনের সংকলন ‘যুগবাণী’।
এর ঠিক দুই বছর পর ১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমে ‘বিষের বাঁশি’; তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক বিষের বাঁশির মাধ্যমে তার বিপ্লবী অনুভূতির প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন…।’ অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে প্রকাশনাটির দিকে দৃষ্টি দিতে সুপারিশ করেন তিনি। দত্তগুপ্তের সুপারিশ বিফলে যায়নি। ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়।
‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর।
নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। কবিতার বই দুটি সংগ্রহে যুবকদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গানে’র সুরে তরুণেরা তখন মাতোয়ারা।
‘প্রবাসী’র মতো অভিজাত পত্রিকা বিষের বাঁশির প্রশংসা করে লিখেছিল, “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মুত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।”
এরপর সরকারি রোষের কোপে পড়ে কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গেছে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের পুরোধা কবি কেঁদে কেঁদে আকুল। চোখে জল কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রলয় শিখা’র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুৎ গতিতে ‘প্রলয় শিখা’ ছুটলো পুরো বাংলায়। পুলিশ গোয়েন্দাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তড়িৎ গোপন বার্তা চালাচালি হতে লাগেলো। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩ এ ও ১২৪এ ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি। এর ভিত্তিতে সেই সময়কার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বইটকে অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ১৯৩০ সালের ১৫ সেপ্টম্বর মুখ্য সচিবকে জরুরি চিঠি দেন। ‘প্রলয় শিখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।
‘প্রলয় শিখা’র রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খড়্গ নেমে আসে চন্দ্রবিন্দুর ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ বিদ্রূপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। এর দুটি কবিতা…
“মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিলো চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’’
“কাফ্রি চেহারা ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।”
চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় ‘প্রলয় শিখা’ নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯এ ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়। উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও ‘অগ্নিবীণা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’ প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলো বাজেয়াপ্ত হয়নি।
শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষের যে অবস্থা, তাতে নজরুলের মতো কবি-চিন্তকদের আকড়ে ধরতে হবে। যারা আমাদের রাস্তায় নামার সাহস দেবে। আবার নিজেও রাস্তায় নামবে। নজরুলও নেমেছিলেন রাস্তায়, নজরুলের ইতিহাস বারবার পাঠ করা জরুরি এখন।