নিপীড়িত মানুষের পাশে এখনো কার্ল মার্ক্স
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : মে ০৫, ২০১৯
দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো নিপীড়িত মানুষের পাশে এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কার্ল মার্ক্স। শ্রম শোষণের এই দুনিয়ায় মার্ক্সই নিপীড়িতদের নেতা। আজ ৫ মে, মার্ক্সের জন্মদিন। পুঁজিবাদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র মাত্রই শোষণের যন্ত্র। তাই রাষ্ট্রহীন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্ক্স। কাকতালীয় হলেও, ১৮৮৩ সালে তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন তখন তার কোনো জাতীয়তা তথা রাষ্ট্র ছিল না!
মার্ক্সের দর্শন ইউরোপীয় দর্শনের ধারাবাহিকতা। ইউরোপীয় দর্শনে তিনি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। তবে সেই ধারাবাহিকতার ভেতরে ছিল নতুন দৃষ্টি যা তাকে শুধু দর্শনের ভেতরেই আটকে রাখেনি। তিনি একই সাথে ইতিহাসবিদ, বিপ্লবী, সমাজবিজ্ঞানী এবং সবশেষে বলা যায়, মহান অর্থনীতিবিদ। যে অর্থনীতি মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে। যারা মার্ক্স বিরোধী, তাদের জন্যও মার্ক্স ইনসাফের আওয়াজ তুলেছেন।
মার্ক্সকে কান্ট, এপিকুরোস, হেগেল, ফয়েরবাক, স্টির্নার, স্মিথ, রিকার্ডো, রুসো, গোটে, ফুরিয়ে, কোঁত পর্যন্ত দার্শনিকদের চিন্তার ফসল বলা যায়। ফলে খুব সহজে তার চিন্তাভাবনা ধরা কঠিন, অন্তত আমাদের মতো তরুণদের ক্ষেত্রে। কারণ, বাংলায় মার্ক্স বা তার কাজ নিয়ে গবেষণাধর্মী বইয়ের অভাব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও সোভিয়েত বিপ্লবের আগে পর্যন্ত খোদ ইউরোপেও মার্ক্সের দর্শন বা তত্ত্ব নিয়ে তেমন কোনো চর্চা-আলোচনা ছিল না, ইতিহাস তাই বলে।
আমাদের এই অঞ্চলে এখনো মার্ক্স পাঠ হয় না। সেভাবে পাঠ হয়না বলেই মার্ক্সবাদী সংগঠনগুলোতে লেখার চর্চা নাই। আমাদের মার্ক্স বুঝতে এখনো এদিক-ওদিক ছুটতে হয়। ছাত্র সংগঠনগুলো এখনো ব্যক্তিগত বর্ণবাদী চিন্তা ধারণ করে বসে আছে। আমাদের নতুন চিন্তক প্রায় নাই, যারা আছে তারা স্রেফ তথ্য ভাণ্ডার গোছের। সিদ্ধান্ত নেয়ার লোক নাই। কেন নাই? সে আলাপ বারবার হোক।
কার্ল মার্ক্সের সমাধি পার্শ্বে ছোট একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন (১৭ মার্চ, ১৮৮৩) আরেক দর্শনিক, সর্বহারাদের আরেক বন্ধু ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। সেটাই পাঠ হোক আজ। লাল সংবাদ তারই একটা অনুবাদ প্রকাশ করেছিল, সেটাই দিলাম—
১৪ মার্চ, (পুরাতন পঞ্জিকা অনুসারে) বেলা পৌনে তিনটায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন। মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য তাঁকে একা রেখে যাওয়া হয়েছিল। আমরা ফিরে এসে দেখলাম যে তিনি তাঁর আরামকেদারায় শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন- কিন্তু ঘুমিয়েছেন চিরকালের জন্য।
এই মানুষটির মৃত্যুতে ইউরোপ ও আমেরিকার জঙ্গী প্রলেতারিয়েত (সর্বহারা) এবং ইতিহাস-বিজ্ঞান উভয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হল। এই মহান প্রাণের তিরোভাবে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা অচিরেই অনুভূত হবে।
ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম, মতাদর্শের অতি নিচে এতদিন লুকিয়ে রাখা এই সহজ সত্য যে, রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়-পরিচ্ছদ, সুতরাং প্রাণধারণের আশু বাস্তব উপকরণের উৎপাদন এবং সেইহেতু কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এ গুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয়।
কিন্তু শুধু এই নয়। বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির এবং এই পদ্ধতি যে বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতির বিশেষ নিয়মটিও মার্কস আবিষ্কার করেন। যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত সব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রী সমালোচক উভয়েরই অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর সহসা আলোকপাত হল বাড়তি মূল্য আবিষ্কারের ফলে।
একজনের জীবদ্দশার পক্ষে এরকম দুটো আবিষ্কারই যথেষ্ট। এমনকি এরকম একটা আবিষ্কার করতে পারার সৌভাগ্য যাঁর হয়েছে তিনিও ধন্য। কিন্তু মার্কস চর্চা করেছিলেন বহু বিষয় নিয়ে এবং কোনোটাই ওপর ওপর নয়- তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই, এমনকি গণিতশাস্ত্রেও তিনি স্বাধীন অবিষ্কার করে গেছেন।
এই হল বিজ্ঞানী মানুষটির রূপ। কিন্তু এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের অর্ধেকও নয়। মার্কসের কাছে বিজ্ঞান ছিল এক ঐতিহাসিকভাবে গতিষ্ণু বিপ্লবী শক্তি। কোনো একটা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের নতুন যে আবিষ্কার কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের কল্পনা করাও হয়ত তখনো পর্যন্ত অসম্ভব, তেমন আবিষ্কারকে মার্কস যত আনন্দেই স্বাগত জানান না কেন, তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের আনন্দ পেতেন যখন কোনো আবিষ্কার শিল্প এবং সাধারণভাবে ঐতিহাসিক বিকাশে একটা আশু বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎশক্তির ক্ষেত্রে যেসব আবিষ্কার হয়েছে তার বিকাশ এবং সম্প্রতি মার্সেল দেপ্রে-র আবিষ্কারগুলি তিনি খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করতেন।
কারণ মার্কস সবার আগে ছিলেন বিপ্লবী। তাঁর জীবনের আসল ব্রত ছিল পুঁজিবাদী সমাজ এবং এই সমাজ যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে তার উচ্ছেদে কোনো না কোনো উপায়ে অংশ নেওয়া, আধুনিক প্রলেতারিয়েতের মুক্তিসাধনের কাজে অংশ নেওয়া, একে তিনিই প্রথম তার নিজের অবস্থা ও প্রয়োজন সম্বন্ধে, তার মুক্তির শর্তাবলি সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছিলেন। তাঁর ধাতটাই ছিল সংগ্রাম। এবং যে আবেগ, যে অধ্যবসায় ও যতখানি সাফল্যের সঙ্গে তিনি সংগ্রাম করতেন তার তুলনা মেলা ভার। … …
এবং তাই, তাঁর কালের লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ও কুৎসার পাত্র হয়েছেন মার্কস। স্বেচ্ছাতন্ত্রী এবং প্রজাতন্ত্রী- দুধরনের সরকারই নিজ নিজ এলাকা থেকে তাঁকে নির্বাসিত করেছে। রক্ষণশীল বা উগ্র-গণতান্ত্রিক সব বুর্জোয়ারাই পাল্লা দিয়ে তাঁর দুর্নাম রটনা করেছে। এসব কিছুই তিনি ঠিক মাকড়শার ঝুলের মতোই ঝেঁটিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন, উপেক্ষা করেছেন এবং যখন একান্ত প্রয়োজনবশে বাধ্য হয়েছেন একমাত্র তখনই এর জবাব দিয়েছেন। আর আজ সাইবেরিয়ার খনি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত, ইউরোপ ও আমেরিকার সব অংশে লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী সহকর্মীদের প্রীতির মধ্যে, শ্রদ্ধার মধ্যে, শোকের মধ্যে তাঁর মৃত্যু। আমি সাহস করে বলতে পারি যে মার্কসের বহু বিরোধী থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রু তাঁর মেলা ভার। যুগে যুগে অক্ষয় হয়ে থাকবে তাঁর নাম, অক্ষয় থাকবে তাঁর কাজ।