নিনিয়ান স্মার্ট

নিনিয়ান স্মার্ট

নিনিয়ান স্মার্টের সেভেন ডাইমেনশনস অব রিলিজিয়ন

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০২০

কোনো মত বা ব্যবস্থা ধর্ম হয়ে উঠছে কিনা বা ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করছে কিনা, সেটার জনপ্রিয় একটা টেস্ট আছে। Ninien Smart (১৯২৭--২০০১) ধর্মের সাতমাত্রিক একটা সংজ্ঞা Seven-part dimensions প্রদান করেছেন। নিনিয়েন স্মার্ট কথিত এই সাতটি মাত্রা দিয়ে ধর্ম বা ধর্মভাবাপন্নতাচেনা যায়। খোদাকেন্দ্রিক ও খোদাবিহীন—এই দুই জাতের ধর্মকেই স্মার্ট এই সাত-মাত্রা দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন। নিনিয়েন রিয়েল রিলিজিয়ন আর রিলিজিয়ন-লাইক অর্থাৎ হাছা ধর্ম ও ধর্মের মতো—এই দুই ভাগেও কিছু মতাদর্শ ও বীক্ষাকে ভাগ করেছেন। তো,স্মার্ট মিয়ার এই সাত মাত্রা দিয়া বহু কিছুর ধর্মভাবাপন্নতা নির্ণয় করতে পারবেন। পুঁজিবাদ, সেকুলারিজম বা কোনো রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শ ধর্মাকারে নিজেরে উপস্থিত করে কর্তৃত্বপরায়ণ বা সর্বজনীনতার দাবিদার হয়ে উঠছে কিনা, স্মার্টের এই সেভেন ডাইমেনশন দিয়ে তা যাচাই করতে পারবেন। নিনিয়েন স্মার্ট বিংশ শতাব্দীর রিলিজিয়াস স্টাডিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ স্কলার।

কোনো মতাদর্শ বা চিন্তাকে বা ধরেন কোনো পলিটিকাল পার্টিকেও একটা ধর্মীয় বাতাবরণ দিলে বা আধ্যাত্মিক প্রকল্পের মতো করে হাজির করলে সেটার ইহকালে টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সেজন্যে কিছু ধূপধুনো দরকার হয় আর কি! এই ধূপধুনোই হইলো নিনিয়ান স্মার্টের সেভেন ডাইমেনশনস অব রিলিজিয়ন। কোনো কিছু ধর্ম হয়ে ওঠে নিঃসংশয় আনুগত্যের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আবহ তৈরি করছে কিনা, তার সাত নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল ডাইমেনশন। এই ডাইমেনশকে নিনিয়ান স্মার্টে অবশ্য তার The World`s Religions: Old Traditions and Modern Transformations বইয়ে ১৯৮৯ সালে যুক্ত করেছেন। Material বলতে তিনি কতগুলো প্রতীককে বুঝাচ্ছেন, যেমন ক্রস বা প্রার্থনার স্থান বা কোনো ফিজিকাল সিম্বল। যেমন ধরা যাক মূর্তি বা কারো ভাস্কর্য, অফিস আদালতে কারো ছবি টানিয়ে রাখা ইত্যাদি। স্মার্ট কথিত এই ম্যাটেরিয়াল ডাইমেনশগুলো বারবার আমাদের মনের ভেতর একটা বিহ্বল ভক্তিভাব বা সমীহ জাগ্রত করবে। ফলে ওইধর্ম বা ওই মতাদর্শের সম্ভাবনা থাকবে নিজেকে জনমনে পোক্তভাবে হাজির রাখার।

ধর্মের একটা ডকট্রিনাল বা ফিলোসোফিকাল ডাইমেনশন থাকে, সেট অব বিলিফ থাকে— যাকে ইসলাম ধর্মে আমরা আকিদা বলি। খ্রিস্টানদের যেমন আছে ট্রিনিটি। কোনো পলিটিকাল প্ল্যাটফর্ম ‘বাঙালিত্ব’ নামক কোনো নির্মাণকে ফিলোসফিকাল ডক্ট্রিন হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এই ডকট্রিনাল ডাইমেনশনে নিজ ও অপর তৈরি হয়। এই এই পোশাক পরলে, এই এই কাজ করলে সে বাঙালি, আর এগুলো এগুলো করলে সে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে পরগাছা— এভাবে বিশ্বাসের একটা সেট তৈরি করা ধর্ম বা ধর্মভাবাপন্নতার একটা মাত্রা।

প্রতিটি ধর্মের একটা মিথিকাল ডাইমেনশনও থাকতে হয়। যেটাকে প্রমাণ করা যায় না, অবিসংবাদিত ফ্যাক্ট হিসেবে যাকে বিশ্বাস করতে হয়। অবিশ্বাস করলে স্বধর্মচ্যুত হয়। যেমন, বাইবেলের জেনেসিস চ্যাপ্টার বা এডাম ও ইভের ঘটনা, অথবা নূহের মহাপ্লাবনের ঘটনা। এই যে ন্যারেটিভ এস্পেক্ট বা স্টোরি টেলিং, এইটা কোনো কিছুকে ধর্মভাবে Religion-like হাজির রাখতে প্রায় অত্যাবশ্যক। বা, কোনো মতাদর্শ বা পলিটিকাল প্ল্যাটফর্ম অনেক সময় এমন স্টোরি মেইক করে নিজেকে প্রবাদতুল্য ও প্রশ্নহীন করবার জন্যে। হাজার বছরের বাঙালি, শত বর্ষের শ্রেষ্ঠ ফরাসি ইত্যাদি ক্লেইমকেও মিস্টার স্মার্টের এই মিথিকাল ডাইমেনশনের মধ্যে ফেলতে পারবেন, চাইলে।

Experiential and emotional dimension থাকে ধর্মের। যেমন, নবির ওহি প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা। স্বপ্ন বা ভিশন। একটা ভীতি, একটা বিহ্বলতা, অপরাধবোধ, একটা রহস্য ইত্যাদি বোধসমূহ জাগ্রত রাখার পরিস্থিতি ধর্ম বা ধর্ম হয়ে উঠতে চাওয়া কোনো ব্যবস্থা হাজির রাখে। ধরা যাক, জর্জ ওয়াশিংটনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন বা কোনো ‘বিশেষ চেতনা’কে বাস্তবায়ন বা সেই চেতনাকে প্রায় অতীন্দ্রিয়রূপে হাজির করে সেটির প্রতি বশ্যতা বা আনুগত্য দাবি করা। ধর্মের রিচুয়াল বা আচার-অনুষ্ঠানগত মাত্রা থাকে। আমাদের ইসলামে যেমন আছে সালাত-সিয়াম ইত্যাদি। আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কোনো চিন্তাকে বা মতাদর্শকে ধর্মভাবে হাজির রাখা যায়।

ধরা যাক, প্রতিবছর বা বছরের বিশেষ দিনে কারো নামে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন, প্রতিবছর ঘটা করে জন্মদিন পালন বা একশো পঞ্চাশতমবর্ষ উদযাপন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কাউকে প্রেরিত পুরুষের সুরতে উপস্থাপনের মাধ্যমে তার চিন্তা বা তার ডাকনামে উপস্থাপিত মতাদর্শকে ধর্মাকারে সমাজসংস্থানে প্রবিষ্ট করা যায়। অনেক সময় স্ট্যাটাস বা স্থিতাবস্থাও বজায় রাখা যায়।

নিনিয়েন স্মার্ট ধর্মের আরেকটি ডাইমেনশনের কথা পেড়েছেন— The Social. যেকোনো ধর্ম বা ধর্মের মতো বা মিশনারি সদৃশ হতে চাওয়া কোনো মতাদর্শ বা দল তার নিজেদের একটা সোসাইটি বা কমিউনিটি তৈরি করে। এই কমিউনিটির মেম্বাররা টুকটাক ভিন্নতা সত্ত্বেও একই মতাদর্শিক ডোমেইনে অবস্থান করে। স্মার্ট কথিত সোসাল ডাইমেনশনে আবার পদগত হায়ারার্কি বা উঁচু-নিচু বিন্যাস থাকতে পারে। খ্রিস্টসমাজে আমরা যেমন দেখি কার্ডিনাল, প্রিস্ট, তারপর লেম্যান বা আওয়াম! কোনো দল যদি স্পিরিচুয়াল প্রজেক্টের মতো করে নিজেকে হাজির করতে চায় তবে তার একটা সোশাল ডাইমেনশন লাগবে। সেক্ষেত্রে টিভি,রেডিও, ছোট-বড় নেতা সবাই মোটামুটি একই সুরে ও স্বরে কথা বলবে, মিডিয়া বা সুশীল সমাজও একই সুর ধরবে এবং এভাবে নানা পরিসরের লোকজন একটা মতাদর্শিক আনুগত্যময় ‘সোশাল` গঠন করে  প্রোজেক্টটাকে সংহত করবে।

অতিপ্রাকৃত জগত থেকে প্রত্যাদিষ্ট কিছু নৈতিক ও আইনি কানুন প্রদান ধর্মের আরেক মাত্রা Ethical and legal Dimension। যেমন, আমাদের শরিয়ত বা মূসার (আ.) টেন কমান্ডমেন্ট। ধর্ম বা  ওই নির্দিষ্ট মতাদর্শের সর্বদা পক্ষে থাকা এবং কোনো ধরনের বিরোধিতা না করা; ‘উপর’ থেকে আসা নীতির বিরোধিতা করলে সে ওই ধর্ম বা মতাদর্শের গণ্ডিচ্যুত বলে ঘোষণা করা হবে। আশপাশের কোনো এক `আকবর` হোসাইনের বহিষ্কারকে এই অনুসারে পাঠ করতে পারবেন। এটা ধর্মভাবসম্পন্ন যেকোনো মত বা পথের বৈশিষ্ট্য।

এই সাতমাত্রা বা দুই একমাত্রা কমবেশি করে একটা প্যারাডাইম বা গ্রান্ড ন্যারেটিভ গঠিত হতে পারে বা করা যায়, যা ধর্ম বা ধর্মভাবে সম্পন্ন হইতে পারে। আপনারা কোনো চিন্তা,মত বা মতাদর্শকে ধর্মভাবাপন্নতা প্রদান করিতে পারিবেন, এই সাত মাত্রাকে উচ্চকিত করিয়া। সেক্ষেত্রে অবশ্য ফলে ওঠা এই এই নতুন দ্বীন-ধর্মের সাথে ‘রিয়াল রিলিজিয়ন’ এর টক্কর লাগার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে!

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ