নিত্যদিনের কড়চা

শাহরুখ পিকলু

প্রকাশিত : জুন ২০, ২০১৯

বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে কবরস্থানের দিকে। সেই রাস্তার একপাশে বাড়িঘর আর অন্যপাশে বনানী খেলার মাঠের সীমানা প্রাচীর, যা ইটপাথরের গাঁথুনির উপর লোহার গ্রিল দিয়ে তৈরি। সেই সীমানা প্রাচীরের গা ঘেঁষে প্রায় ১০-১২টা ছাপরা ঘর ছিল বছর চারেক আগেও।

খালি জায়গা পেলেই এই শহরে ছাপরা ঘর ওঠে, আর কতগুলো ছাপরা মিলে নিমেষেই একটা বস্তি হয়ে যায়। অবশ্য তা ক্ষণস্থায়ী, কারণ সেই বস্তির নোংরা কাপড় দিয়ে ঢাকা নোংরা শরীর ভদ্দরনোকদের চোখে লাগে, যদিও রাস্তায় গোসল করতে বাধ্য হওয়া যুবতী মেয়েদের ভেজা কাপড় সেঁটে থাকা স্তন দেখতে বড় বড় গাড়ির লোকেরাও পুলক অনুভব করে। কিন্তু সে ঘোর বেশিক্ষণ থাকে না। হঠাৎ একদিন মহাসমারোহে চলে আসে কর্পোরেশনের দানব, সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট। তারা ভদ্দরনোকদের সরকারি লোক, তাই তাদের কথামতো কাজ করে। ‘শালা বস্তির মানুষগুলা জানোয়ার কিসিমের, তাই মাঝে মাঝে লাথি ঘুষা দিতেই লাগে’ ভাবে বস্তি ভাঙতে আসা লোকগুলো। তারাও তো অচিরে সমাজের এভারেস্টে উঠবে, সেখান থেকে ন্যাংটো বাচ্চা দেখতে ভালো লাগবে কেন!

শেষ বিকেলে রাস্তায় বসে ভাত রান্না করছে আয়েশা। দুটো বাসায় ছুটা কাজ করে সে। আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। টায়ার-কার্ডবোর্ড-খবরের কাগজ দিয়ে একটা চুলাতে মিটি মিটি আগুন জ্বলছে। আগুনের থেকে ধোঁয়ার তেজ বেশি। আয়েশার চোখের পানি কি ধোঁয়ার না দুঃখের, তা বোঝা মুশকিল। পাশে কোনো এক ঘাসপাতা জাতীয় শাক কুটছে তার চৌদ্দ বছরের মেয়ে শাবনূর। জোয়ান মেয়ে, সারাক্ষণ তার দিকে একটা চোখ রাখতে হয়। সে যখন কাজে থাকে তখন কোনো ছেলের সঙ্গে কী করে তা ভেবে আয়েশা অস্থির থাকে। মেয়েটারও চোখ সর্বদা এদিক ওদিক চায়, কেউ যেন আসবে।

‘ছিনালি বাদ দিয়া শাক কোট, হারামজাদি’, হুঙ্কার দেয় আয়েশা। তার পাশে বসে সাত বছরের ছেলে শাকিব খান কেঁদেই চলেছে, নাকের আর চোখের জলে একাকার অবস্থা, ভীষণ খিদা তার। সারাক্ষণ। বিল্লাল শেখ আয়েশার স্বামী, আয়েশা ডাকে ভাতার। আয়েশাকে খুব একটা ভাত যে এনে দেয় তা কিন্তু না। লম্বা-চওড়া সুঠাম দেহের বিল্লাল খুব একটা কাজের লোক না। কখনও রিকশা চালায়, কখনও জোগালির কাজ করে, কিন্তু বেশির ভাগ দিনই চোলাই-গাঁজা-ফেন্সি খায়। সে আবার এই ছোট বস্তির রোমিও। আর সবার বৌ-মেয়েদের সঙ্গে সুযোগ পেলেই টাঙ্কি মারে, রাত্রে কাউকে কাউকে বনানী মাঠে নিয়ে যায়, নেশা করে বেশ একটা মৌজ মারে। আয়েশা জানে কিন্তু কি করবে সে!

বিল্লাল টলতে টলতে এসে বললো, ‘কিরে মাগী, এত দেরিতে ফিরলি যে? ভাত কই? পোলাটা কান্দে।’ একটু থেমে ফের বলল, ‘দ্যাখলাম রইসুদ্দিনের লগে আবার ঢলাঢলিও করলি। বেশ্যাগিরি ছাড়বি কবে রে, খানকি মাগী? মাইয়াটাও তো বেশ ভাল টেরেনিং পাইতাছে।’

শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল আয়েশা। হাতের কাছের একটা শুকনো লাকড়ি ছুঁড়ে মারল বিল্লালের দিকে। চেঁচিয়ে সারা বস্তি মাথায় তুলল। ‘খানকির পোলা ভাতার আমার! কামাই কইরা ভাত দে, চুতমারানির পোলা। আমি বেশ্যাগিরি করি? বেশ্যা তোর মা, তোর বৈন্।’

মায়ের চিৎকারে শাকিব খানের খিদা আরও বেড়ে গেল। সে সশব্দে নতুন উদ্যমে কেঁদে উঠল। শাবনূর কিন্তু কিছুই পাত্তা দিল না। সে পাশের ছাপরার টগবগে ১৮-১৯ বছরের কুদ্দুসের দিকে তাকায় আর মিটি মিটি হাসে। কুদ্দুস নতুন রিকশা চালায়, খায় বাপের হোটেলে, সে আড়চোখে শাবনূরকে মাঠের দিকে ঈঙ্গিত করে।

বিল্লাল ক্রন্দনরত শাকিব খানকে বকা দেয়, ‘চুপ যা! বৈঠামাগীর জারোজ কোনহানকার।’ বাচ্চা ছেলেটা চুপ করে। অক্ষরজ্ঞান নেই কিন্তু প্রতিদিন সে নতুন নতুন শব্দ শেখে আর পুলকিত হয়। মাঠে অন্যদের সঙ্গে খেলার সময় সে তার নতুন জ্ঞানের পরিচয় দেয় প্রায় রোজই।

ঘণ্টাখানেকের চেঁচামেচির পর ভাত আর শাক রান্না হয়ে যায়। তারা চারজনে খেতে বসে। পাশ দিয়ে বড় বড় গাড়ি চলে যায়। বিল্লাল আর আয়েশা কিছুটা হাসি তামাশাও করে।