চিত্রকর্ম: কাইয়ূম চৌধুরী
নিতাই কাকা
মারুফ ইসলামপ্রকাশিত : নভেম্বর ২৪, ২০১৮
গল্প শুরু হচ্ছে। নিতাই কাকার গল্প। নিতাই কাকা আমাদের আবাল্যের চেনা। রোগা, টিংটিংয়ে দেহ। মুখমণ্ডল খানিকটা গোলাকার হলেও দৃঢ়চেতা মানুষের মতো চিবুক। কোটরাগত চোখ দুটোয় চার্জ ফুরিয়ে আসা টর্চের মতো টিমটিমে আলো। সে আলোর তলে শূন্যতা না স্বপ্নের বাস, তা ঠিক করে শনাক্ত করা যায় না।
এই নিতাই কাকাকে একটা ঝুপড়ি ঘরে চা বিক্রি করতে দেখা যায়। এর আগে দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন উধাও। এই উধাও হওয়ার আগে তাকে তিন রাস্তার মোড়ে বাদাম বিক্রি করতে দেখা গিয়েছিল বেশ কিছুদিন। এবং তারও আগে সেই একাত্তরে তাকে নাকি দেশের জন্য যুদ্ধ করতেও দেখা গেছে।
সে যাই হোক, আমরা অবশ্য জন্মের পর থেকেই দেখছি ইস্টিশনের বগলঘেঁষা এই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরটাই তার শেষ আশ্রয়। এই ঘরের তিন দিকে চাটাইয়ের বেড়া, শুধু ইস্টিশনের দিকে মুখটা খোলা। মাথার ওপর খড়ের একচালা ছাউনি। ভেতরে এক পাশে বাঁশের তৈরি একখানা বেঞ্চি, অপর পাশে ওই বাঁশেরই তৈরি চরাট আরেক খানা। বেঞ্চখানা কাস্টমারদের বসার জন্য আর চরাটখানা নিতাই কাকার রাত্রি যাপনের জন্য।
ঘরের বাকি অংশজুড়ে দেখা যায় চায়ের গেলাশ, কেতলি, বিস্কুটের বয়াম, দুধের কৌটা, মাটির চুলা, জ্বালানি কাঠ, পানির ঠিলা— এইসব নিত্য আসবাব। আমরা রোজ বিকেলে নিতাই কাকার এই চা ঘরে তশরিফ নিই। চা খেতে খেতে উপুর করি গল্পের ঝুড়ি। সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, রাজনীতি, জঙ্গি ইত্যাদি গল্প শেষে এক সময় উঠে পড়ি যে যার মতো। কাকা পড়ে থাকেন ঝুপড়িতে। তার কাছে কখনো জানতে চাওয়া হয় না তার জীবন-যাপন সংসার ধর্মের কাহিনি। কিংবা তার বাদাম বিক্রি করতে করতে হঠাৎ উধাও হওয়ার কাহিনি। অথবা উধাও অবস্থা থেকে ফিরে আসার কাহিনি।
জীবন তো এমনই। এখানে যে যার জীবন নিয়ে গলদঘর্ম। অন্যের কাহিনি শোনার সময় কোথায়? তবু সময় সময় এমন হয়, জীবন যেন পিঠের ওপর ঝুলে পড়ে। একে বয়ে বেড়াতে আর ভালো লাগে না। আমি তখন আমার জীবনটাকে পিঠ থেকে খানিক সময়ের জন্য নামিয়ে রেখে তার সামনে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদি। এভাবে আর কত! একদিন করলাম কী, এরকম এক ভালো না লাগা রাতে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়াই নিতাই কাকার ঝুপড়ি ঘরের সামনে।
রাত অনেক। কাকা তবু ঘুমাননি। সেদিন আমি আমার জীবনটাকে পিঠ থেকে নামিয়ে রেখেছিলাম নিতাই কাকার সামনে। নিতাই কাকাও তার জীবনটাকে নামিয়ে রেখেছিলেন আমার সামনে। নিতাই কাকার জন্ম আমাদের এ এলাকায় নয়। এখান থেকে আরও আট-দশ গ্রাম দূরে। কিন্তু সেই গ্রামে তিনি না থেকে কোনও না কোনও ছুতোয় আমাদের এ এলাকাতেই থাকতে চান। এ থাকতে চাওয়ার পেছনে রয়েছে এক অন্যরকম গল্প।
নিতাই কাকা দম নিয়ে নিয়ে বলছিলেন সে রাতে, ‘তখন হামি কেবলই বিয়া করছি। খাই দাই, ঘুরি ফিরি, আর সারাক্ষণ ঝুমুরের আশে পাশে বিলাইয়ের লাকান ঘুর ঘুর করি।’ সেই ঝুমুর। হালকা গড়নের ছিপছিপে শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে, দেবনাথ বংশীয় হিন্দু ধর্মের একটা মেয়ে; যার পুরো নাম দিতি দেবনাথ ঝুমুর। যার মাথা থেকে কোমর অব্দি ঝরণার মতো নেমে এসেছে এক ঢাল ঘনকালো রেশমি চুল। যার আছে সন্ধ্যা তারার মতো জ্বলজ্বলে এক জোড়া বড় বড় চোখ। এবং যার কথা মনে পড়লে এখনো নিতাই কাকার মাথা ক্রমশ নিচু হতে থাকে। দৃষ্টিজোড়া ভূমিতে নিবদ্ধ হয়। আর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি অযথাই মাটিতে আঁচড় কাটে।
‘সেই ঝুমুরকে হয়তো হামি ভালোইবাসি।’ নিতাই কাকা বলে চলেন, হয়তো কচ্ছি এ জন্যি যে ভালোবাসার জন্য মানুষ হাতের মধ্যে প্রাণ নেয়, রাজ্য সিংহাসন ত্যাগ করে, সাত সমুদ্দুর পাড়ি না দিলেও নিদেন পক্ষে মেঘনা দামোদোর পাড়ি দেয়। অথচ হামি তেমন কিছুই করিনি। হামার ভালোবাসায় তাই ‘হয়তো’ শব্দ ঢুকে পড়ে। তবে ‘কিছু করিনি’ না কইয়া মনে হয় কওয়া উচিত ‘করার সুযোগ পাইনি’। কারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা মোটেও কিছু করার মতো অনুকুল ছিল না। একে তো বয়স কম, তার ওপর আবার দ্যাশজুড়ে দেখা দিল গোলযোগ।
সেই গোলযোগময় প্রহরে আতঙ্কিত চোখে নিতাই কাকা দেখলেন এক এক একটা আতঙ্কিত মুখ, মাথায় কাপড়ের পোটলা, কোলে বাচ্চা, হাতে চিড়া-মুড়ি-গুড়ের টিন নিয়ে বনপোড়া হরিণীর মতো ছুটছে শরণার্থী শিবিরের দিকে। কাকা তার বাবাকে গিয়ে বললেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। বাবা ‘হ্যাঁ-না’ কিছুই বললেন না। থ্রি ব্যান্ড রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, দ্যাশের অবস্থা ভালো না।
মাকে গিয়ে বললেন। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ঘরত লতুন বউ, তুই এগলা কী কচ্ছু বাপ! কাকা বুঝলেন, বাবা মা তাদের একমাত্র ছেলেকে হারাতে চান না। তিনি তাই এক জোছনা ধোয়া রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘর থেকে পা বাড়ালেন। আকাশে আষাঢ় মাসের বড় একটা চাঁদ। নিতাই কাকা পিছন ফিরে দেখলেন, জানালার ফাঁক গলে সে চাঁদের অপূর্ব আলো খেলা করছে তার ঘুমন্ত স্ত্রীর চোখে মুখে।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আস্তে করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। তারপর বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে, ধানী জমির আল মাড়িয়ে, নিঃসাড়ে শুয়ে থাকা রেল লাইনের ওপর দিয়ে খানিক এগিয়ে, বড় দুটো গ্রাম পেরিয়ে সোজা গিয়ে উঠলেন নদী পাড়ের জঙ্গলঘেরা এক পোড়ো বাড়তে।
নিতাই কাকা আগেই খবর নিয়ে জেনেছেন, এখানে কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করেছে। এখান থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে নিতাই কাকা চলে যান আগরতলা। সেখানে ট্রেনিং নেওয়ার পর ঝাপিয়ে পড়েন গেরিলা অপারেশনে।
দুই.
এটুকু বলে নিতাই কাকা আবার খানিকটা দম নেন। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকান। আমিও আকাশের দিকে মুখ তুলে চাই। দেখি আকাশে বিস্ময়কর বড় একটা চাঁদ।
কাকা আবার বলতে শুরু করেন, যেরকম এক চাঁদনী রাতে ঘর থ্যাক্যা বাইর হছনু, সেরকম আরেক চাঁদনী রাতে আবার বাড়িত ফির্যা আসনু। দ্যাশ স্বাধীন হয়্যা গেছে এরমধ্যে। বাড়িত দেখি মা ছাড়া আর কেউ নাই। ওই রাতে বাড়ির উঠানে মাদুর পেতে মায়ের কোলে মাথা রেখে নিতাই কাকা তার বাবার কথা জানতে চান। ঝুমুরের কথা জানতে চান।
কালো উঠান সাদা করে জোছনা নামে। সেই জোছনার ম্লান আলোয় কাকা দেখেন তার মায়ের পরনে কালো পেড়ে সাদা শাড়ি, নাকে নাকফুল নেই, হাতে সোনার বালা নেই। রিক্ত মা তবু সাত রাজার ধন পাওয়ার মতো করে আদুরে গলায়, নিতাই কাকার এলোমেলো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, এক রাতে বাছেদ রাজাকার তোর বাপক ধর্যা লিয়া গেল। তারপর থ্যাক্যা মানুষটা লিখোঁজ। আর ফির্যা আসলো না। তাতে কী, তুই তো ফির্যা আসিছু... হামার মানিক...।
‘আর ঝুমুর?’ নিতাই কাকা প্রশ্ন করেন। মা কোনো কথা বলে না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ঘরত চল বাপ, ম্যালা রাত হচে। ‘হামার ঝুমুর কোনটে? ও মা?’ কাকা আবার জিজ্ঞেস করেন। মা এবার কাঁদতে শুরু করেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওই দিন তোর বউকেও তুল্যা লিয়া গেছে বাছেদ রাজাকার।
তারপর?
‘তারপর জোর কর্যা মোছলমান বাইনা বিয়া করিছে...।’ মা আরও কী জানি বলে চলে। নিতাই কাকার মাথায় আর কিছুই ঢোকে না।
তিন.
তারপর থেকে নিতাই কাকা আমাদের এলাকায়। কারণ আমাদের গ্রামেই বাছেদ রাজাকারের বাড়ি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ গ্রামে তারা কেউ থাকে না। কোথায় থাকে সে কথাও কেউ বলতে পারে না। ‘তারপরও যদি কোনোদিন এই গাঁয়ে আসে... ঝুমুর... হামার ঝুমুর।’ আর্তনাদ করে ওঠেন নিতাই কাকা। আর আমি তখন ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করি।