নাহিদুল ইসলামের গল্প ‘ছোবল’
প্রকাশিত : জুন ০৬, ২০২০
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে লাফিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে সোহান। গত মধ্যরাতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। সারা দিনের প্রেম, প্রতিবাদ, মিছিল, স্লোগান, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, আহত, রক্তাক্ত অভিজ্ঞতাময় দিনের শেষে মুমূর্ষু বন্ধুদের হাসপাতালে রেখে তবেই ঘরে ফিরতে পারে সে। তারপর তন্দ্রাঘুমের অচেতনতায় দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতার দাপাদাপিতে বিছানা থেকে পড়ে যায় মেঝেতে। মাথাটা তার ধুম করে বাড়ি খায় কংক্রিটে। সম্বিত ফিরে এলে বুঝতে পারে, সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল। তারপরেও স্বপ্নের মধ্যকার আতঙ্কের শেষ দমকের রেশটুকু রয়ে যায় কিছুক্ষণ।
একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছে সে। সাধারণত স্বপ্নের ঘটনাবলি মনে থাকে না তার। কিন্তু সেদিনের স্বপ্নটা এমনই জীবন্তভাবে তীব্র যে, মেঝের ওপর পড়ে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠার পরেও ঘাম ঝরতে থাকে তার। সোহান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, রাতের অন্ধকার কেটে আবছা আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সকাল হচ্ছে।
স্বপ্নের ঘটনা স্থানটা হচ্ছে সোহানের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে নাহারের সাথে সংসার পেতেছে সে। দু’চারটা হাসি আনন্দের দৃশ্য ফুটে ওঠে সেখানে, নাহারকে সাথে নিয়ে নৌকায় করে বিলের জলে ঘুরতে যায় সে। লাল হয়ে ফুটে থাকা পদ্মফুল তুলে সে গুঁজে দেয় নাহারের চুলে। এইসব ছোটোখাটো মুহূর্ত ভেসে ভেসে ওঠে সেই স্বপ্নের মাঝে। এরপর এক সকালে বাড়ির কাছারি ঘরের দোলচেয়ারে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকে সে, আর হঠাৎ নাহারের চিৎকার শুনে বাইরে এসে নাহারকে উঠানের ওপর চিতপটাং হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে তুলে নেয় তাকে। প্রবলভাবে ভীতসন্ত্রস্ত রক্তশূন্য চোখে নাহার পুকুরঘাটের দিকে আঙুল তুলে দেখায়। বলে, সাপ! ওমা! ইয়া বড় সাপ! ফোঁস করে আমারে ছোবল দিতে নিছিল।
বাড়ির বউ-ঝিরা এসে নাহারের মুখে পানির ছিটা দেয়। আর ভাই-ভাতিজা মিলে কয়েকজন লাঠিসোটা নিয়ে ওরা যায় পুকুরঘাটে। কিন্ত কোথায় সাপ? নেই। সোহান ঘাটের পাশ দিয়ে পুকুরপাড় ধরে সন্তর্পণে হেটে যায় খেজুর গাছটার দিকে। গাছের গোড়ায় পৌঁছতেই কানের কাছে শি শি করে একটা কম্পমান আওয়াজ ঘনিয়ে আসে। মাটি থেকে চোখ তুলে গাছের দিকে তাকাতেই তাগড়া কালো সাপের ফণা বিদ্যুৎবেগে নেচে ওঠে চোখের সামনে। সপাং করে ছোবল বসিয়ে দেয় ওর গালে।
যাক, ব্যাপারটা সত্যি নয় তাহলে... একটা স্বস্তির হাওয়া বয়ে যায় সোহানের মনে। সে শুয়ে আছে শহরের হোস্টেলের মেঝেতে। গ্রামের বাড়ির পুকুরঘাট আর খেজুর গাছ পড়ে আছে সেই কোথায়!
তবু মনের মধ্যে খচখচ করে তার। সাপে কাটার স্বপ্ন কেন দেখল সে? যদিও বাস্তবতা নয় এটা, কিন্ত এর কি কোনো মানে আছে? দুঃস্বপ্নের প্রাথমিক স্বস্তির নিঃশ্বাস অতিক্রম করে স্বপ্নের ব্যাখ্যা কি হতে পারে, তা ভেবে চিন্তিত হয় সে।
সোহান বাথরুমে যায়। শহুরে জীবনে ঘুমের স্বপ্ন নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার সময় কোথায়? তার উপরে সময়টা যখন উত্তাল হয়ে আছে! ক্ষ্যাপা সময়! গোটা যুগটা যেন একটা দুঃসহ প্রসববেদনা পুষে নিয়ে নবজন্মের আর্তচিৎকারে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। শহর জুড়ে আজকাল শুধু মিছিল আর স্লোগান আর প্লাকার্ড আর চিৎকার আর রাস্তায় রাস্তায় অত্যাচারে পিষ্ট মানুষের ঢল! এদিক থেকে মানুষের রক্ত চুষে নিয়ে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় ওদিকে চালান করে দিয়ে ওরা সেখানে বিলাসের নিশ্চিত আবেষ্টনী তৈরি করেছে। কিন্ত ইদানীং যেন ক্ষ্যাপা কুকুর হয়ে উঠেছে মিছিলগুলো। যেন এই শহরের গলিতে গলিতে অক্লান্ত দাঁত বের করে খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা অত্যাচারকে। পেলেই জ্যান্ত খেয়ে নেবে, ছিঁড়ে-ফুঁড়ে লণ্ডভণ্ড করে দেবে সব। এবার আসবেই স্বাধীনতা। বাথরুমের বদ্ধ অন্ধকারে বসে বসে ভাবতে থাকে সোহান।
মানুষ শুধুই কি মলত্যাগ করার জন্য এসেছে পৃথিবীতে? গতদুপুরের শুকনো ভাত আর ডালের হজমকৃত ধ্বংসাবশেষটুকু বাথরুমের প্যানের সরু নল দিয়ে চালান করে দিতে দিতে ভাবে সোহান। নাহ, মানুষকে দাঁড়াতেই হবে মানুষের কাতারে।
গোসল সেরে হোস্টেলের ল্যান্ডফোন থেকে নাহারকে ফোন করে সে। নাহার পাশে না থাকলে মিছিলও নির্জন মনে হয় তার কাছে। গতকাল নাহারকে স্লোগান দিতে দেখে সোহান আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। ফোন রিসিভ করে বিরক্তি দেখায় নাহার। কারণ এখনই বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না তার। সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে কি চায় সোহান তার কাছে? সোহান দুঃস্বপ্নটার কথা খুলে বলে তাকে। প্রশ্ন করে, তুমি কি জানো নাহার, সাপে কাটার স্বপ্ন দেখা ভালো না খারাপ?
নারীরা সাধারণত এসব ব্যাপারে অধিক সংবেদনশীল হয়, এরকমই মনে করত সোহান। কিন্ত ওসবের বালাই নেই নাহারের। সে রেগে গিয়ে বলে, আরে ধ্যাত, কীসব আজেবাজে প্যাঁচাল শুরু করলা তুমি! দশটায় টিএসসিতে দেখা হবে। রাখো।
ঠিক একারণেই নাহারকে এত পছন্দ করে সোহান। সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে টহল দেয়া সশস্ত্র জিপগাড়ি দেখে মনে মনে হাসে। সোহান শাহবাগ হয়ে সোহরাওয়ার্দীর ধার ধরে হেঁটে যায়।
নাহারের আসতে এখন কিছু দেরি আছে। সোহান রাস্তার ধারে মাদুর বিছিয়ে ব্যবসা পেতে বসা ভাগ্য গণকের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার কেরামতির কারিগরি দক্ষতা। টিয়া পাখি, তাস, আতশি কাঁচ, রঙিন কাগজের ওপর দুর্বোধ্য সব নকশা, বিভিন্ন রঙের পাথর আর আঙটি। মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। সোহান জটাধারী গণকের সামনে থপ করে বসে পড়ে বলে, বাবা, আজ সকালে আমি একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি, একটা লম্বা কালো সাপ আমার গালে ছোবল দিয়েছে, এই স্বপ্নের মানে কি?
জটাধারী গণক ওর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, তুই তো মইরা যাবি রে আইজকা।
সোহান উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে যেতে পেছনে মুখ ফিরিয়ে বলে, তুমি আমার বাল গুনতে জানো শালা বজ্জাত। বলে হন হন করে হেঁটে চলে যায় টিএসসিতে। একটা কালো শাড়ি পরিহিত অসম্ভব সুন্দর রূপে নাহার এগিয়ে আসে। সোহান ওর ওই হেঁটে আসার দৃশ্যের সাথে হিলহিলে সাপের বাঁক নেয়া চলনের একটা সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করে। নাহার কাছে এগিয়ে আসলে বলে, সাপে কাটার স্বপ্ন দেখলে মানুষ মরে যায় নাহার।
নাহার গভীর আবেগভরা চোখ তুলে হাত দিয়ে সোহানের ঠোঁট চেপে ধরে বলে, এসব অলক্ষুণে কথা বলতে নেই। তোমার হয়েছেটা কি বলো তো! তুমি ভয় পেয়েছ দেখতে পাচ্ছি। ওসব এলোমেলো অস্থির ভাবনার কারণে হয়। চলো, শহিদ মিনার থেকে মিছিল শুরু হবে আজ।
শহরের সবগুলো দিক থেকে পালে পালে মানুষের দল এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই শহিদ মিনারের দিক থেকে গুলির আওয়াজ পায় ওরা। মানুষের দল এলোমেলো হয়ে দৌড়াতে থাকে। ওরা হাতে হাত ধরে লাইন ধরে এগিয়ে যেতে থাকে ওদিকে।
গুলির শব্দ আবার। পঞ্চাশ ফুট দূরে একটা ছেলে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। মুহূর্তেই একটা ধ্বংসক্ষেত্রে পরিণত হয় যেন গোটা দৃশ্যপট। নাহার দৌড়ে যায় তার দিকে। বিচ্ছিন্নভাবে এদিকে সেদিকে গর্জে ওঠে স্লোগান, তারপর বন্দুকের নল। নাহার রাস্তায় বসে ছেলেটার মাথা তুলে নেয় তার কোলে। সোহান দাঁড়িয়ে থাকে নাহারের দিকে তাকিয়ে। স্থির হয়ে। নাহার কেঁদে ওঠে। আর আঙুল তুলে ওদের দিকে ছুড়ে দেয় বিস্ফারিত ঘৃণামিশ্রিত চিৎকার।
সোহান এগিয়ে যায়। নাহারকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায় ওদের দিকে। চলে যায় ওদের গণ্ডির মধ্যে। দূর থেকে একটা ছোট্ট আগুনের পিণ্ড ঝলসে ওঠে সোহানের চোখে। আর একটা বুলেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় ওর মুখটাকে। বাজ পড়া ধাক্কায় পেছন ফিরে সোহান নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে যেতে যেতে নাহারের ওর দিকে ছুটে আসার দৃশ্যটাই শুধু দেখে নিতে পারে। সে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় নাহার উন্মাদ হয়ে ওঠে। সোহানের প্রাণহীন থ্যাতলানো মুখটাকে জড়িয়ে ধরে সে। চারপাশে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা বয়ে যায়। অপ্রকৃতস্থ নাহার উঠে দাঁড়ায়। বাতাসের দমকায় উড়ে উড়ে যায় তার চুল। রক্তমাখা মুখে নিষ্পলক এগিয়ে যায় সে। অদূরে একজন পিস্তলধারীকে ধরে ফেলে মানুষের দল। অসংখ্য আঘাতে মুহূর্তেই ধরাশায়ী হয় সে। নাহার এগিয়ে যায় সেখানে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে প্রবল আক্রোশে তার গলায় রাক্ষুসির মতো দাঁত বসিয়ে ছিঁড়ে আনে একপিণ্ড মাংস। তারপর থুতু ছুড়ে সোহানের কাছে ফিরে যেতে যেতে দেখে, সমুদ্রের গর্জনের মতো অনন্ত মানুষের ঢেউয়ের চূড়ায় ভেসে ভেসে বয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ...