নারী দিবস উদযাপন ও বাস্তবতা

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০১৯

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস । প্রতি বছর ৮ মার্চ সারা বিশ্বে নারীরা অন্যতম প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বর্তমানে এই উদযাপন হয়ে উঠেছে অনেকটাই বানিজ্যিক। নারী দিবস প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বা এই দিবস পালন করার উদ্দেশ্য বা এই দিনটি আমরা আদৌ কেন পালন করব সে বিষয়ে চিন্তার জায়গা থেকে সরে গিয়ে আমরা আনন্দ উদযাপন আর সমাজের এক শ্রেনীর নারীর জয়গান করার মধ্যেই নিজেরদের আটকে রেখেছি। অথচ, যারা সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে এসে আমাদের অধিকার নিয়ে প্রথম মুখ খুলেছিল, সেই শ্রমজীবী নারীরা নিজেরাই আজ চরম উপেক্ষার পাত্র।

 

তাই নারী দিবস পালনের পূর্বশর্ত হলো, এই দিবস প্রতিষ্ঠার পূর্ণ ইতিহাস জানা। নারী দিবসের আদি নাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস।

 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন।

 

সিদ্ধান্ত হয়ঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। সুত্রঃ উইকিপিডিয়া।

 

আমরা জানতে পারলাম, আজ থেকে ১৬২ বছর আগের শ্রমজীবী নারীরা রাস্তায় নেমেছিল মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। নানা দমন পীড়ন সহ্য করে তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের দাবিতে অনড় ছিল বলেই আজকের নারীরা কর্মক্ষেত্রে কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়েছেন। কিন্তু, তাতে খুব বেশি কিছু পালটে গেছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, আজও আমাদের শ্রমজীবী নারীদের পথে নেমে নিজের নুন্যতম অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই আন্দোলন ছিল সমাজে নারীর সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সমাজের শ্রেনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আন্দোলন, প্রচলিত শ্রেনী কাঠামোর জাল ছিড়ে বের হয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন। কিন্তু, কালের বিবর্তনে এই দিনটি আজ বেনিয়াদের ঠিক করে দেয়া নিয়মে উদযাপিত হচ্ছে। নারীরা যাদের প্রতিষ্ঠা করে দেয়া নিয়মনীতির দেয়াল টপকে সমতার ময়দানে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে চেয়েছিল, আমরা আজ সেই সংগ্রামী পথিকৃতদের সফলতার ফসল তুলে দিয়েছি তাদের হাতে যারা সেইগুলোতে নারীদের তাদের প্রাপ্য অধিকার দেবে না বলে রাজপথে চালিয়েছিল দমন আর পীড়ন।

 

তাই আজ বড়বড় ম্যাগাজিনের কভারে কোন শ্রমজীবী মায়ের বা বোনের ছবি ছাপে না, সেখানে উঠে আসে সমাজপতিদের তৈরী করা ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠা নারীদের অবয়ব। আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, আদর্শ নারীদের হতে হবে পরিপাটি, তাদের পরনে থাকবে দামি পোশাক, আর অনুষঙ্গ হিসেবে তাদের অবশ্যই পরিধান করতে হবে সমাজপতিদের উৎপাদিত পণ্য। সেখানে নারীর সম্মান নির্ধারণ করা হবে, তার সামাজিক অবস্থান আর অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে। সেখানে অগ্রাহ্য করা হবে আমাদের শ্রমজীবী মা আর বোনদের, যাদের জন্য আজ আমারা এই দিবস পালন করছি, তাদেরই আজ এইদিনে কোন এক অন্ধকার কারখানার স্যাঁতসেতে পরিবেশে বসে অল্পদামে শ্রম বিক্রী করেতে হচ্ছে অথবা পাওনা মজুরী আদায়ের জন্য রাস্তায় মার খেতে হচ্ছে। আর আমরা গোলাপী আর বেগুনী রঙের নতুন নতুন পোশাক, তার সাথে মিলিয়ে আনা অনুষঙ্গ দিয়ে নিজের সাজিয়ে বড় বড় সভা সেমিনারে নারীর অধিকার আদায়ের জন্য গলাবাজি করে তালি কুড়াচ্ছি।

 

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে, সভা-সেমিনারে গলা ফাটিয়ে অধিকার চাইলেই অধিকার পাওয়া সম্ভব নয়। নারী অধিকার কোন ট্রফি না, যে আপনি চাইলেই আপনার হাতে কেউ তুলে দিবে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই আমাদের নিজেদের চিন্তার মূলে আঘাত হানতে হবে। নিজের নায্য দাবি বুঝে নিতে হবে নিজেকেই, নিজের কর্মের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, অধিকার পাবার পূর্বশর্ত হলো নিজের দায়িত্ব পালন করা। আমাদের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত অন্য নারীর সম্মান আর অধিকারের প্রতি সহনশীল হওয়া। নারী হিসেবে আরেকজন নারীর পাশে না দাড়াতে পারলে, আমরা কোনদিনও সমাজে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না। আমাদের ভুলে গেলে হবে না, কোন বিভক্ত শ্রেনীর পক্ষেই একক আর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা সম্ভব না। আজ আমি যদি আমার কন্যার প্রাপ্য আমার পুত্রকে বুঝিয়ে দেই, আমার বোনের দায়িত্ব আমার ভাইয়ের কাধে চাপিয়ে দেই বা আমার নিজের কাজ আমার স্বামীকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাই, আমার দ্বারা কোনদিনো নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।

 

আমাকে প্রথমেই নিজের ভেতর থেকে শক্ত হয়ে নিজের কাজ নিজেকে করে যেতে হবে, নিজেকে স্বাবলম্বী হতে হবে। সেটা করতে পারলেই সমাজের পুরুষসত্তা আমার কাজে কর্মে নাক গলানোর সুযোগ হারাবে। মনে রাখবেন, নারীকে আগে নিজেকে মানুষ ভাবতে হবে তারপরে প্রথমেই দাঁড়াতে হবে আরেকজন নারীর পাশে। আমরা নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষা দেয়া শিখে গেলে, সভা সেমিনারে গলা ফাটিয়ে সমাজের কাছে সুরক্ষা চাইতে হবে না। কোনকিছু অর্জন করা সহজ কিছু না, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই আমরা আমাদের লক্ষ্যবস্তু পেতে পারি, সেখানে নারী-পুরুষ বলে আলাদা কোন কথা নেই। আমি জানি, নারীদের পথটা এইক্ষেত্রে একটু বেশি কঠিন। তারপরেও আসুন মনে মনে বলি, আমি নারী আমি হাজার কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারি, কারণ আমি অনেক শক্তিধর আমার নিজের মনে মনে, আমার অন্তরের গভীরে।