নারী ও পুরুষ স্বতন্ত্র, চিরকাল ছিল এবং থাকবে
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২২, ২০১৯
`তন্ত্র` আর `স্বতন্ত্র` বিষয় দুটি এক নয়। প্রথমটি সমাজ দ্বারা তৈরি, স্বীকৃত এবং প্রণোদিত। দ্বিতীয়টি স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বাভাবিক। যদিও `স্বতন্ত্র` শব্দটির মধ্যেও ছোট করে একটি `তন্ত্র` লুকিয়ে আছে, কারণ ব্যক্তি নিজেকে কিভাবে পেশ করবে তারও একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট আছে, তবু যেহেতু তা ব্যক্তির নিজস্ব রুচির নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই `তন্ত্র` এর মধ্যে যে আরোপ আছে, যে শক্তির প্রয়োগ আছে, `স্বতন্ত্র` এর মধ্যে তা নেই। বিষয়টি বললাম `লিঙ্গ তন্ত্র` এবং `লিঙ্গ স্বাতন্ত্র্য` এর প্রসঙ্গে।
আজকাল আমার মনে হয়, এই বিষয় দুটিকে আমরা বেশ গুলিয়ে দিচ্ছি। নারী ও পুরুষকে সমাজই পুরোপুরি নারী ও পুরুষে পর্যবসিত করে, এ কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত নই। কারণ এই লিঙ্গ পার্থক্য একটি ক্রোমজোমাল পেয়ারিং এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রেও যে স্বতন্ত্র গঠনমূলক পার্থক্যগুলি প্রকট করে তুলেছে তার সবটাই কি সামাজিক অবদমন বা অবমূল্যায়নের ফসল? এক্ষেত্রে, `পার্থক্য` শব্দটিই ব্যবহার করলাম, কারণ `বিভেদ` বা `বৈষম্য` এর প্রয়োগ অবশ্যই সামাজিক।
এর রুট ট্রেস করতে গেলে অবশ্যই আদিম অরণ্যসঙ্কুল জীবনের দিকে তাকাতে হবে। যে সময় শিকারই ছিল মানুষের একমাত্র জীবিকা বা জীবন ধারণের মাধ্যম, এখনো যদিও তাই, শুধু খাদ্য আহরণ বা শিকারের আরো নানা ছল বা কৌশল আবিষ্কার হয়েছে মাত্র। সেই আদিম সময়ে বিপুল অরণ্যের উদ্ভিজ্জ প্রশাখার মধ্যে দিয়ে প্রবিষ্ট সূর্যালোকই ছিল যখন একমাত্র আলোর উৎস, তখন কে শিখিয়ে দিয়েছিল পুরুষকে যে সেই দুর্গম অনালোকিত রহস্যময় অরণ্যের কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের বৃহৎ কাণ্ডের আড়ালে তাকে ওৎ পেতে বসে থাকতে হবে শিকারের জন্য? কারণ দূরে কোনো গুহার কন্দরে আগুন জ্বেলে বসে আছে ন মাসের গর্ভবতী নারীটি, যার পেটে তার সন্তান। যে কোনো মুহূর্তেই যার প্রসব বেদনা উঠতে পারে, তার খাবার তবে জোগাড় করে দেবে কে? পাশেই ঘুমিয়ে আছে যে দুধের শিশুটি, তাকেই বা আগলাবে কে হিংস্র জানোয়ারের লালসা থেকে? কে-ই বা ক্ষুধার সময় মুখে পুরে দেবে দুধের বোঁটা? মা ছাড়া ঈশ্বর আর কাকেই বা দিয়েছিল সেদিনের সদ্যজাতকে সেই আদিম অনাবৃত সময়ে? বিভেদটি তবে তিনিই তৈরি করেছিলেন। কারণ আনন্দ নিতে চেয়েছিলেন তিনি, প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত ও অগণিত বিস্তারে। তারজন্য দরকার ছিল কেবল সন্তান, এক থেকে দশ দশ থেকে শ, একশো থেকে হাজার হাজার থেকে লক্ষ কোটি। সেই লক্ষ কোটি প্রাণের গর্ভ তিনি দিলেন নারীকে একা, মাসের পর মাস তাকে ব্যস্ত রাখলেন অনুরক্ত রাখলেন প্রসবের পীড়ায়, অপত্যস্নেহে উপচে পড়া দুধের লালিত্যে তিনি নারীকে করলেন আরক্ত, তার শরীরের মায়া কন্দরে নতুন নতুন প্রাণের বপনে সুফলা হলো পৃথিবী। এই প্রাণ বয়ে চলার শ্রমে কোনো ভাগাভাগি হলো না। আর পুরুষকে রাখলেন মুক্ত, নিজের ঔরসজাত মনুষ্যে উত্তরাধিকারের ঔদ্ধত্যে পৃথিবী ছেয়ে ফেলার অঙ্গীকারে শিকারের বল্লম হাতে পৃথিবীর দুর্ধর্ষতম অববাহিকায় ছড়িয়ে দিলেন তাকে। তাহলে বৈষম্যটি করলেন কে? স্বয়ং ঈশ্বর। একটি সম্পূর্ণ পৃথিবীকে দ্বিখণ্ডিত করলেন তিনি, নারী ও পুরুষ নামে, আরো প্রাণের জন্ম দেবেন বলে, এই ছিল তাঁর কৌশল।
নারী ও পুরুষ স্বতন্ত্র , আলাদা, চিরকাল ছিল এবং থাকবে। তারা আলাদা বলেই এক হওয়ার জন্য চিরটাকাল উৎপীড়িত হবে তারা, এক হবে আসলে অনেক হতে চায় বলে। প্রকৃতি এর চেয়ে বেশি কিছু চায়নি তার কাছে। আর যত চাওয়া পাওয়া, যত তার নিজস্ব আনন্দের সৃজন, সবই তার নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত, যেই মস্তিষ্কের ভেতর গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে সে। প্রতিটি মানুষের ভেতর লালিত হয় সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ব্রহ্মাণ্ড।
স্বতন্ত্র হওয়া তাই খারাপ নয়। মনুষ্য জীবন যাপনে স্বতন্ত্র যেটুকু তার বেশিটাই আসলে নারীর জন্যই সৃজন হয়েছে, তাকে আভরিত করবে বলে, সুন্দরতর করে তুলবে বলে। পুরুষের যা কিছু সম্পদ যা কিছু শক্তি, তা চাইলে নারী স্বেচ্ছায় ধারণ করতে পারে। কারণ তার ধারণ করার স্পেসটুকু অনেক বেশি, সেতো একটা গোটা মানুষকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে। কিন্তু নারীর যা কিছু নিজস্ব, পুরুষ তা চাইলেও ধারণ করতে পারবেনা, ঢলঢলে টুপির মতো সেটা খসে পড়ে যাবে যে কোন সময়। পুরুষের এই ইনসিকিউরিটি থেকেই পুরুষ`তন্ত্র`এর জন্ম, অর্থাৎ যার মধ্যে আছে অহেতুক শক্তির প্রয়োগ, যার মধ্যে আছে অবদমন, আঘাত দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবণতা। এই অংশটুকু খারাপ, বাকি সবটাই খারাপ নয়।
`মেন উইল বি মেন`এই শব্দ বন্ধটি নেগেটিভ নয়, যদি এটাকে কনস্ট্রাকটিভ অর্থে নেওয়া হয়। কারণ এর পাশাপাশি এটাও স্বতঃসিদ্ধ যে "ওম্যান উইল অলসো বি ওম্যান" । পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্র বলেই এরা পরস্পরের জন্য উন্মুখ, আছে এবং থাকবে। একজন মায়ের যদি দুটি সন্তান হয় , একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে তবে কি তিনি ছেলেকে মেয়ের মতো করে বড় করবেন না মেয়েকে ছেলের মতো করে? এবার আপনি বলতে পারেন, যে এই মেয়ের মতো বা ছেলের মতো করে বড় করার ব্যাপারটি আসলে সোস্যাল কনস্ট্রাকশন। তাহলে না হয় আপনার ছেলে তার বোনের পুতুল বা রান্নাবাটি নিয়ে খেলা করলে আপনি কোন আপত্তি করলেন না। কিন্তু পোশাকে আশাকে সাজগোজে কিংবা অন্য অনেক শারীরবৃত্তীয় অভ্যেস তৈরির ক্ষেত্রে আপনার ছেলে এবং মেয়েকে কি সম্পূর্ণ একই লেশন দেবেন? তার ফল ভালো হবে কি? এক্ষেত্রেও বলি, আপনি যদি আপনার মেয়েকে ছেলেটির মতো করে মানুষ করেনও তাহলে তার খুব বেশি ক্ষতি হবেনা, কারণ ঐ যে বললাম, মেয়েরা এক জীবনে অনেক জীবন ধারণ করতে পারে। কিন্তু ছেলেরা তা পারেনা।
কাজেই `স্বতন্ত্র` আর `তন্ত্র`কে গুলিয়ে ফেললে হবে না। যাকিছু আঘাত দিয়ে গলা টিপে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম এবং তৎসংলগ্ন নিয়মানুবর্তিতার দাবিদার, সেইসব তন্ত্র নিপাত যাক। কিন্তু পুরুষ ও নারী স্বতন্ত্রই থাক, থাক পরস্পরের প্রতি আকর্ষণে ভালোবাসায় ও সহানুভূতির রসায়নে বিভোর। পুরুষ ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার পাঠ দেওয়া হোক, পরস্পরকে সম্মান দেওয়ার পাঠ দেওয়া হোক, পরস্পরকে ঘৃণা করার পাঠ নয়। নারীকে পুরুষ বানানোর বা পুরুষকে নারী বানানোর পাঠ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, পাঠ দেওয়া হোক মানুষ হওয়ার।
লেখক: কবি