নাদিয়া সারওয়াতের গল্প ‘বড় হওয়ার আগে’

প্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০১৯

নিঃশ্বাস প্রায় আটকে রেখে, যতদূর পারা যায় নড়াচড়া না করে মায়ের পাশ থেকে সরে এলো রুনু। সন্তপর্ণে খাট থেকে নেমে পড়ল। এবারই সবচেয়ে কঠিন কাজটা। দরজা খোলা। কোনো শব্দ না করে পাশের ঘর থেকে চেয়ারটা নিয়ে আসা। অনন্তকাল পরে, শেষ পর্যন্ত মায়ের ঘুম না ভাঙিয়েই রুনু চেয়ারটাকে দরজার সামনে আনতে পারলো। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে অভ্যস্ত হাতে ছিটকিনিটাও খোলা গেল। এবার কিছুক্ষণ থামতে হবে। কারণ দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা এড়ানোর কোনো বুদ্ধি রুনু এতদিনেও বের করতে পারেনি। অবশ্য সকাল থেকে রান্না-বান্না, ধোয়া পাকলা আর কাপড় কাচা শেষে মায়ের এই অবসন্ন ঘুম বিকেল গড়ানোর আগপর্যন্ত ভাঙার আশঙ্কা তেমন যে নেই, সে বোধ রুনুর শিশুমনে তৈরি হয়নি।

ঘর থেকে বের হতেই মুক্তি। এরকম রোদ ঝলমলে একটা দুপুরে কেন মানুষকে ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে সেটা কোনোমতেই মানতে পারে না রুনু। বাসায় ফেরার পর পিটুনি খেতে হয় হোক, বের হওয়ার সময় কিছুতেই ধরা পড়তে চায় না সে। রোজ-রোজই এরকম বেরিয়ে যেতে পারলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু তা তো হওয়ার জো নেই। ৮-১০ দিন মায়ের কথামতো লক্ষ্মী হয়ে চলার পর এরকম একেকটা দুপুর আসে। মফস্বলের ছোট এই পাড়াটা গ্রামের মতোই। দোতলা দালান বাড়িতে ভাড়া থাকে রুনুরা। তবে সেই দোতলা বাড়ির দুই পাশেই কয়েক সারি টিনের ঘর। ছাদের সাথে লাগোয়া দুটো ঘর রুনুদের। একটায় থাকে মা ও বাবা। আরেকটাতে সে আর মা। মানে, মা দুই ঘরেই থাকে। রুনু ঘুমানোর আগপর্যন্ত তার ঘরে, এরপর বাকি রাতটুকু বাবার ঘরে। রুনুর ঘরটা একই সাথে খাবার আর বসার ঘরও। রান্নাঘর আর গোসলখানায় যাওয়ার পথটাও তার ঘর দিয়েই। বারান্দা নেই, তবে খোলা ছাদটা তারচেয়েও বেশি। যেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে এরকম পালায় না রুনু, সেদিন শেষ বিকেলটা ওই ছাদেই কাটে তার। নিচতলায় দুই ঘর ভাড়াটিয়াদের এক হালি ছেলে মেয়ে, বয়সে রুনুর চেয়ে কিছুটা বড় হলেও খেলা জমে যায়। মাও ঘুম থেকে উঠে খোশ-মেজাজেই থাকে। নিচতলার খালাম্মার সাথে গুটুর গুটুর গল্প করতে করতে রাতের জন্য চাল বাছে। কখনো কখনো ময়দা-চিনি আর ডিম দিয়ে পিঠাও বানায়। সে যাক, আজকের দিনে পিঠা জোটার কোনো সুযোগ নেই। পিটুনি যা জুটবে সেটাও তেমন ভাবার বিষয় না। রুনু সিঁড়ি দিয়ে নেমে টিনের বাড়িগুলো পাশ কাটিয়ে মাঠের দিকে রওনা দেয়।

একটা ভুল হয়ে গেছে। গরমের দিনে দুপুরে গায়ে জামা না দিয়ে ঘুমোলেও মা কিছু বলে না। বাইরে বেরুনোর তাড়ায় জামাটা গায়ে গলাতে ভুলেই গেছে রুনু। এখন ফেরত গেলে মা যদি টের পেয়ে যায় তাহলে আর বের হতে পারবে না। আবার খালি গায়ে ঘোরাঘুরি করলে বাসায় এসে পিটুনির মাত্রাটা দ্বিগুণ-তিনগুণ হওয়ার আশঙ্কাটাও তাকে স্বস্তি দেয় না। ভাবতে ভাবতেই মাঠে পৌঁছে গেল রুনু। সেখানে পুরো মাঠ দখল করে খেলছে পাড়ার ছেলেরা। বেশিরভাগ জুড়েই ছেঁড়াফাটা এক ফুটবল নিয়ে দৌড়োদৌড়ি চলছে। এর বাইরেও ডাংগুলি, মার্বেল খেলার ছোট ছোট দল আছে। এক কোণে ঘুড়ি ওড়ানোও চলছে। কেউই রুনু কিংবা তার খালি গা নিয়ে মাথা ঘামালো না। রুনুও ব্যাপারটা আপাতত ভুলে যাবে বলেই ঠিক করলো। সে খুঁজতে গেল সাথী ও তার দলবলকে। এই মাঠে খেলার জন্য জায়গা দখল করতে দল ভারি করা ছাড়া উপায় নাই। কিন্তু সাথীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল ওর ছোট ভাইয়ের ফোঁড়া উঠেছে। গায়ে জ্বর। ফোড়াগুলোতে চুন আর হলুদ মাখাতে মাখাতে সাথীকে নানারকম নির্দেশনা দিচ্ছে তার মা। ঘরের কোণে কেরোসিনের চুলায় এখনই রাতের রান্না হচ্ছে, আপাতত যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সাথীই। সন্ধ্যার আগে আর সে ছাড়া পাবে না বুঝে হতাশ হয়ে বেরিয়ে পড়লো রুনু। নতুন গন্তব্য ইমনদের বাড়ি। কথা বলতে পারে না ইমন, কানেও শোনে না। কিন্তু তাতে তার বাড়িতে যাওয়ার আকর্ষণ কমে না একটুও। পাড়ার অন্যতম অবস্থাপন্ন পরিবার ইমনরা। বাড়ির সামনের খোলা জায়গার নাম যে লন হয়, সেটা ইমনের কলেজপড়ুয়া বোনের কাছ থেকেই জেনেছে রুনু। তারচেয়েও বড় কথা, লনের এক কোণায়, কাঠের ছোট্ট একটা ঘরে থাকে ধবধবে সাদা কুকুর টম। এরই মধ্যে রোদ পড়ে আসা বিকেলটুকু সেখানে কাটিয়ে গেলে খারাপ হয় না।

ইমনের বড়বোন সিমি কিন্তু তার জামা না পড়া নিয়ে খোঁচাতে ছাড়লো না। অ্যাই, তুই না স্কুলে পড়িস, এখনো খালি গায়ে ঘুরিস তোর লজ্জা নাই? খালাম্মাকে ঘুমে রেখে পালিয়ে এসেছিস তাই না? বাসায় গেলে পিঠে পড়বে দুমদুম। যে জিনিসটা ভোলার চেষ্টা করছিল সেটাই আবার মনে করিয়ে দিলো সিমি আপা। তারপর আবার আরেকটি অস্বস্তিকর প্রসংগ। স্কুল। হ্যাঁ, এবছর সত্যিই তাকে মিশন স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল বাবা। কিন্তু সে স্কুলে পড়ে, এটা ঠিক সত্যি না। ভর্তির পর একদিনও তাকে সবগুলো ক্লাস করাতে পারেনি কেউ। প্রথম ক্লাসেই হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করে রুনু। কান্না থামে মায়ের কোলে চড়ে বাড়ি ফেরার পরই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময়েও কান্নাকাটি হল্লাহাটি কম হয় না। বাবার অফিসের নাস্তা তৈরির ফাঁকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না মা। ফলে কয়েকদিনের মাথাতেই স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা-মাকে বলতে শুনেছে রুনু, সামনের বছর বাড়ির পাশে নতুন খোলা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেয়া হবে তাকে। ওখানে নাকি টিচাররা বেশ হাসি-খেলায় বাচ্চাদের পড়াশোনা করায়। তা খেলতে খেলতে পড়ালেও স্কুলে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই রুনুর।

বড় ঝামেলা বাধলো ইমনদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে। তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে। দৌড়ে বাসার দিকে ফিরছিল রুনু। কিন্তু পথে বাবলা গাছটার গোড়ায় শালিকের বাচ্চা পড়ে থাকতে দেখে থামতেই হলো। বেশ বড়সড় বাচ্চা, আর ক’দিনের মধ্যেই উড়বে। ওড়ার চেষ্টা করতে গিয়েই বোধহয় বাসা থেকে পড়ে গেছে। মা-পাখিটা আশে পাশে নেই বলেই মনে হলো রুনুর। গাছ বাওয়া তার প্রিয় অভ্যাস। পাখির বাচ্চাটাকে ফের বাসায় ফিরিয়ে দেয়ার ইচ্ছাটা কোনোমতেই দমন করতে পারলো না সে। কতক্ষণই আর লাগবে। বাবলা গাছের কাঁটা বাঁচিয়ে সাবধানে এক হাতে পাখির বাচ্চা নিয়ে গাছে উঠতে শুরু করলো। বাসাটা খুব বেশি উঁচুতেও না। আরো তিনটি বাচ্চার সাথে আহত বাচ্চাটিকে রেখে খুশি মনেই গাছ থেকে নামছিল সে। কিন্তু পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা হঠাতই পিছলে গেল কিভাবে যেন। আকস্মিক আতঙ্কে কিছু না বুঝেই দুহাতে বেড় দিয়ে গাছটা ধরে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করে সে। সরসর করে নেমে যেতে যেতে আর থামতে পারছিল না। পড়ে যাওয়া ঠেকানো গেলেও বুক থেকে পেটের নিচ পর্যন্ত ছিলে গেল। এর চেয়ে অনেক কম ঘটনায় চিৎকার করে কাঁদার অভ্যাস থাকলেও, এখন কান্না পেল না রুনুর। একে তো আশেপাশে কেউই নেই কান্না শুনে তার দিকে মনোযোগ দেয়ার, তার ওপর নিজের দোষে পড়ে গিয়ে কাঁদতেও কেমন যেন উৎসাহ পাচ্ছিল না।

বাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে অবশ্য জ্বলুনির চোটে আপনিই গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করলো। বাড়ি এখনো বহুদূর। জ্বলুনিটা আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। জাহাঙ্গীর মামার মেসের পাশে আসতেই মনে পড়লো, মামার কাছে দাড়ি কাটার পরে দেয়ার সুগন্ধি সেই শিশিটার কথা। কেন সেটা মাখতে হয় জানতে চাইলে মামা বলেছিল, দাড়ি কাটতে গিয়ে গাল কেটে গেলে এইটা দিলে ভালো হয়। জাহাঙ্গীর মামার কাছে এখন যাবে বলেই মনস্থির করলো রুনু। নিজের মামা নয়, জাহাঙ্গীর পাড়ায় এসেছে বছর খানেক আগে। গ্রাম থেকে কলেজে পড়তে এসেছে, প্রথম দিকে ক্লাস শেষে সোজা মেসবাড়িতেই ফিরতো। বিকেলের দিকে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের সাথে আড্ডা দিত। তখনই রুনু আর তার দলবলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয় সে। নারিকেলের পাতা দিয়ে ঘড়ি চশমা আর আংটি বানিয়ে দিত জাহাঙ্গীর। পাতার বাঁশিও বানাতে পারে। রুনুদের কচুরিপানা আর ইটের গুড়া দিয়ে তৈরি তরকারি, হুমহাম শব্দ করে চেটে পুটে খেত জাহাঙ্গীর। শুন্যে ছুঁড়ে আবার লুফে নেয়ার খেলা দিয়ে পুরো দলের মন জয় করেছে সে। তবে এখন আর সন্ধ্যার আগে পাড়ায় ফেরে না সে। কলেজেই বহু বন্ধু জুটে গেছে এখন, ক্লাসের পর লম্বা আড্ডা শেষ করেই ফেরে। কখনো সখনো পরীক্ষা টরীক্ষা থাকলে অবশ্য দুপুরেই ফিরতে দেখা যায় তাকে। চোখে পড়লেই পেছনে জুটে যায় ন্যাওটা বাচ্চাকাচ্চাগুলো। এদের মধ্যে তাকেই যে বেশি আদর করে জাহাঙ্গীর, ছোট হলেও তা টের পায় রুনু। এখন ঘরে থাকলেই হয় জাহাঙ্গীর মামা।

ঘরেই ছিল জাহাঙ্গীর। ঘুমাচ্ছিল। অনিচ্ছাতে, অজ্ঞাতেই কলেজের এক সুন্দরী শিক্ষিকাকে স্বপ্নে দেখছিল। হঠাতই দরজায় ছোট ছোট ধাক্কায় চমকে ঘুম ভেঙে গেল। সারা শরীর ঘামে জবজবে। অস্বস্তি নিয়েই দরজা খুলতে গেল। আজ একটু আগেই এসে পড়লো তার ঘরের বাসিন্দারা। তবে দরজা খুলতেই একটু অবাক হতে হলো জাহাংগীরকে। এতক্ষণ শুধু চোখ থেকে পানিই গড়িয়ে পড়ছিল, রুনু কিন্তু কাঁদছিল না। এবার সশব্দে শুরু হলো সেটা। তার হাউমাউ করে বলা কথা থেকে শেষ পর্যন্ত বিষয়টা বুঝতে পারলো জাহাঙ্গীর। মাথা খারাপ? আফটার শেভ লোশন এই ছ্যাঁচরানো চামড়ায় দিলে আর উপায় আছে? বাথরুম থেকে আ্যন্টিসেপটিক ক্রিম নিয়ে এসে রুনুর ক্ষতে আংগুল দিয়ে মাখিয়ে দিতে লাগলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল এতে কিছুটা আরাম পাচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎই কি যেন হলো জাহাঙ্গীরের, সদ্য ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের দৃশ্য আর ছোট্ট রুনুর কোমল অনাবৃত শরীর কেমন যেন পেঁচিয়ে ধরলো তার স্বাভাবিক বোধকে। লাল একটা কুচিওয়ালা প্যান্টের ঠিক ওপরের অংশটুকু শিশুর না নারীর, তা গুলিয়ে যাচ্ছিল। শরীরে চেনা শিহরণ পর্যন্ত টের পাচ্ছিল জাহাঙ্গীর। ঠিক এসময় রুনুর কথায় যেন সম্বিত ফিরলো তার। বাসায় গেলে মা মারবে এ জাতীয় কী যেন একটা বলছিল মেয়েটা। ভীষণ গ্লানি আর অনুশোচনা হলো জাহাঙ্গীরের। কি ভাবছিল সে? কেন ভাবছিল? মাফ করে দিক তাকে খোদা! শয়তানের কবল থেকে বাঁচাক! এবার একটু রাগই হলো তার রুনুর ওপর। মা মারবে না তো কি করবে? দুপুর বেলা সারা পাড়া টই টই করে ঘুরে বেড়াস? তাও আবার খালি গায়ে? বড় হচ্ছিস না তুই? রুনু চোখ বড় বড় করে চুপ করে তাকিয়ে আছে। জাহাঙ্গীর তাকে বকবে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। তাও আবার জামা না পড়ার কথা তুলে? এবার সত্যিই মনে হলো কাজটা মোটেও ভালো হয়নি। মাথা নিচু করে ফের বাড়ির পথ ধরলো রুনু। এরপর আর কখনো খালি গায়ে বাড়ি থেকে বের হয়নি সে। আর কোনো এক অজানা কারণে, জাহাঙ্গীরকে দেখলেও আর কোনোদিন দৌড়ে যায়নি কাছে।