নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা
পর্ব ১১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২০
ফরাসি বিপ্লব ছিল এক নতুন ধরনের বিপ্লব। রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষদের দ্বারাই ঘটেছিল এ বিপ্লব। বিপ্লবে সাম্যের বাণীও ঘোষিত হয়েছিল। সাম্যই ছিল তার প্রধান কথা। ইংল্যান্ডের বিপ্লবে গণতান্ত্রিক সংসদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে শাসন ক্ষমতায় ধনী বুর্জোয়াদের সাথে উচ্চ অভিজাতদের সমন্বয় ঘটেছিল। ফরাসি বিপ্লবে পূর্বের গোটা ব্যবস্থাই উল্টে গেল। সে বিপ্লবে শ্রমিক-কৃষকরাও ছিল অন্তর্ভুক্ত। মাথার উপর বসে ছিল যে ক্ষমতাশীল অভিজাতরা তাদের সেখান থেকে বিচ্যুত করা হলো। চার্চের সমস্ত কর্তৃত্বের অধিকার কেড়ে নেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত রাজা ও রানীর শিরচ্ছেদ করা হলো। ঘোষণা দেয়া হলো, আইনের চোখে সবাই সমান সুতরাং বিশেষ সুবিধার ইতি ঘটবে। সব জায়গাতেই মনোনয়নের স্থানে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলো বিপ্লবী পরিষদ। বিচারকরা পর্যন্ত নির্বাচিত হতে থাকলো। রাজপদ ক্রয়ের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেল। ফরাসি সমাজ পুরানো ব্যবস্থার জড়ত্বের হাত থেকে মুক্তি পেল। যখন রাজতান্ত্রিক ইউরোপ পুরানো ব্যবস্থার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে গতিহীন, ফ্রান্সে তখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা দিয়েছিল। শৃঙ্খলমুক্ত মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যম সেখানে অবাধ গতির সঞ্চার করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের পরপর প্রজাসাধারণ কিছুদিনের জন্য হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল। ফলে সে সময়কার নাটক নিয়ে নতুন সব চিন্তাভাবনা দেখা গিয়েছিল জনগণের স্বার্থকে ঘিরে।
ফরাসি দেশে মিশেল ভেবেছিলেন জনগণের নাট্যশিল্পের কথা। নাট্যশালা দর্শকদের কী দিতে পারে সে সম্পর্কে তিনি তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘নাট্যশালার মঞ্চে দর্শকদের উপহার দিন তাদেরই নিজস্ব গৌরবময় উপাখ্যান, দেখান তাদেরই নিজস্ব কাজ এবং ক্ষমতাকে। জনগণের মধ্যে আনুন তাদের নিজস্ব বোধ, তাদের জনগণত্ব। নাট্যাভিনয় হলো শিক্ষা প্রসারের এক মস্ত অস্ত্র, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পকর্কে যা ঘনিষ্ঠতর করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন ঘটানোর ক্ষেত্রে নাট্যশালা হলো মস্ত বড় এক আশা। নাট্যপ্রযোজনা হবে বিশ্বজনীনভাবেই জনগণের, নাটক জনগণের প্রতিটি চিন্তাভাবনার প্রতিধ্বনি তুলবে’। জাঁ জাক রুশোর ভাবনাও ছিল একই রকম। মিশেলের ভাবনা মূলত রুশোর ভাবনারই প্রতিফলন। সতেরশো আটান্ন সালে রুশো এরকম একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন নাট্যশালাকে কেন্দ্র করে। নাট্যশালাকে কেন্দ্র করে ধর্মের বিকল্প একটা জায়গা তৈরি করা এবং মানুষের ভিতর জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার কথা তিনিই প্রথম বলেন, যার স্ফূরণ ঘটে ফরাসি বিপ্লবে। পাশাপাশি একথাও সত্য যে, শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে নাট্যশালাকে ‘জনগণের নাট্যশিল্প’ করার উদ্যোগ যথেষ্ট ব্যাপক হলেও তখনো সুসংগঠিত ছিল না। গণনাট্যের রূপটি কী হবে অনেকেই তা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ফরাসি বিপ্লবের পর পরই নাটক গণসংযোগের শক্তিশালী মাধ্যম এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে চিন্তাবিদদের কাছে খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল। সতেরশো নব্বই সালে বিপ্লবীদের জয় ও স্বৈরাচারের পতনে দর্শকরা কোরাস গাইতে থাকে ‘সামন্ততন্ত্র তুমি পরাজিত’। বিখ্যাত সাহিত্যিক গকুর-এর লেখা থেকে জানা যায়, জনগণ তখন নাট্যশালা দখল করে। বিপ্লবের স্বার্থে সচেতনভাবে নাটককে ব্যবহারের চিন্তা শুরু হয়। রুশো এই সময় নাট্য প্রদর্শনী দ্বারা যেমন জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন মানুষের গৌরবের দিকগুলোকে তুলে ধরতে। রুশোর ধারণায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রয়োজন পরিষ্কার। তাঁর রাজনৈতিক ধারণার মূল কথা ছিল, সামাজিক রাষ্ট্র তখনই সুবিধাজনক যখন প্রত্যেকেরই কিছু থাকে এবং কারোরই বেশি থাকে না। সুতরাং সমাজের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা ও একধরনের সাম্য। নাট্য মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েও ফরাসি বিপ্লব সাম্যের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিল। সতেরশো চুরানব্বই সালে জনশিক্ষা পরিষদের জোশেফ পায়াঁ শুধুমাত্র লেখক এবং নাট্য পরিচালকদের ফটকাবাজি ও সস্তা নাটকীয় মনোরঞ্জনের নীতিহীনতা ও মুনাফাবাজির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তা নয়, তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো সেই সময়ের মন্থর মেজাজ এবং শিল্পের ক্রীতদাসসূলভ মনোবৃত্তি। তিনি বললেন, উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের নাট্যশালা থেকে অবশ্যই দূর করতে হবে। মঞ্চকে করে ফেলতে হবে পরিষ্কার। স্বাধীনতার ভাষাকে উচ্চারণ করতে হবে জোরালো কণ্ঠে, শহিদদের সমাধির ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে ফুল, গাইতে হবে বীরত্ব ও গৌরবের গান, জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে হবে ভালোবাসা ও দেশপ্রেমে। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রচিন্তায় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। নাট্যচিন্তায়ও তার প্রভাব পড়ে। বহু নাট্যকারের রচনায় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয় না। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও নাটকের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে থাকে। শুধু বুর্জোয়াদের নয়, সকল মানুষের ভাগ্য পাল্টাবার দাবি তোলে নাটক। বিপ্লবকে মাঝপথে থামিয়ে না দিয়ে বিপ্লবের চূড়ান্ত রূপটি তারা দেখতে চায়।
ফরাসি বিপ্লবকে কেন্দ্র করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে ইউরোপের রাষ্ট্রীয় কঠোমোয় পরিবর্তনের যে ঢল নামে তার জোয়ারে সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীটি কাটছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতার মধ্যে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লব ছাড়াও আরো দুটি বিপ্লব ঘটে। রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটে আমেরিকায়, সেখানকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো বিদ্রোহ করে। ফলে স্বাধীন সাধারণতন্ত্র হিসাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পত্তন হয়। শিল্প বিপ্লব শুরু হয় ইংল্যান্ডে এবং পরে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লিখিত তিন তিনটি বিপ্লবের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারা। পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণিও জেগে ওঠে নিজেদের ভাগ্য পাল্টাবার প্রশ্নে। বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিকদের সংঘর্ষ কখনো কখনো মারাত্মক আকার নেয়। সময়টা নতুন যুগসন্ধিক্ষণ ও অস্থিরতার। এই সময় থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায় এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব শুরু হয় নতুনভাবে। ধর্মের অনুশাসনের জায়গায় শুরু হয় আইনের নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারটাকে দেখা হতে থাকে রাষ্ট্রের শাসকদের স্বার্থে। রাষ্ট্রের স্বার্থে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের উৎপত্তিও ঘটে বুর্জোয়া উত্থানের এই পর্বে।
ফরাসি বিপ্লবের পর সা-সিমঁ প্রমুখ দাবি করেছিলেন, শিক্ষক এবং সাহিত্যিকদের এক বিশেষ সামাজিক ভূমিকা আছে। বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাঁরা হবেন অগ্রবাহিনী। ফরাসি বিপ্লব শুধু বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্যেই আটকে থাকতে চায়নি। নতুন নতুন আরো বিপ্লবের স্বপ্নও ছিল তা। ফরাসি বিপ্লবের অভ্যন্তরেই একদল মানুষ সাম্যবাদী সমাজের যে স্বপ্ন দেখতেন তাকে সমাজে প্রয়োগ করার কথা ভাবলেন কেউ কেউ। রুশো, সা-সিমঁ, জ্যাকোবিনদের নেতা রোবস্পিয়েরও ছিলেন এইরকম চিন্তার ধারক। সেটা বাস্তবে ঘটলো না বাস্তব অবস্থার কারণেই। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ফ্রান্সের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিকাশ এমন ধারায় ঘটেছে যাতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনই সর্বহারা শ্রেণির প্রাধান্য স্বীকার না করে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ফরাসি সর্বহারাশ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনা সেই অনুপাতে উপযুক্ত ছিল না। নিজেদের রক্তে বারবার ফ্রান্সে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথ করে দিলেও, নিজেদের কিছু কিছু দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করলেও, ফরাসি সর্বহারারা সাধারণভাবে নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে ছিলেন অস্পষ্ট ও বিভ্রান্ত। বিপ্লব সম্পর্কে তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, না ছিল এসব বিষয়ে তখন পর্যন্ত কোনো গ্রন্থ যা পাঠ করে তাঁরা বিপ্লবকে সঠিক পথে এগিয়ে নিযে যেতে পারতেন। বিপ্লবের ফল নিজেদের হাতে ধরে রাখতে পারলেন না তাঁরা সুষ্ঠু চিন্তার অভাবে।
ফ্রান্সে প্রতিটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরেই একটি নতুন সংগ্রাম শ্রমিকদের গড়ে তুলতে হচ্ছিলো, অথচ যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে বারবার তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিলো। পাশাপাশি ফ্রান্সের পরাজিত অভিজাত শ্রেণি বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো অনেকাংশে বুর্জোয়া পরিবর্তন স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের সামন্ততন্ত্রের ক্ষমতা কায়েম করতে এবং জমির মালিকানার সুবাদে ও পরম্পরাগত আধিপত্যের দরুণ অজ্ঞ ও পশ্চাদপদ ফরাসি কৃষক সমাজকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে। বুর্জোয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রজাতন্ত্রবাদী হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভিজাত শ্রেণিকে মিত্র রূপে বেছে নেয়। জেগে ওঠা শ্রমিক শ্রেণির ভয়ে যেমন ভীত ছিল গির্জার পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণি, তেমনি নতুন এই শক্তির জাগরণে বুর্জোয়ারাও ছিল শঙ্কিত। বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল তখন জনগণের প্যারিস কমিউন। প্যারিস কমিউনের সমর্থন ছিল জ্যাকোনিদের নেতা রোবস্পিয়েরের দিকে। বুর্জোয়ারা চেয়েছিল ক্ষমতা থেকে শ্রমিকদের উৎখাত করতে আর তাই তারা কৌশলগত কারণে অভিজাতদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। ভিন্নদিকে রোবসপিয়ের সাধারণ মানুষের স্বার্থে সন্ত্রাস চালালেন ধনীদের উপর। ধনীদের নিধন করে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তিনি সমতা আনতে চাইলেন সমাজে। কিন্তু রোবসপিয়ের ব্যর্থ হলেন, কেবলমাত্র গায়ের জোরে সমাজ ব্যবস্থা পাল্টানো যায় না এই সত্য তিনি বুঝতে পারেননি। বুর্জোয়া আর অভিজাতরা এক হলো রোবসপিয়েরের বিরুদ্ধে এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো। ক্ষমতাচ্যুত করার পর রোবসপিয়েরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো গিলোটিনে পাঠিয়ে। সন্ত্রাসের রাজত্বকে কেন্দ্র করে রোবসপিয়েরকে গিলোটিন-এ পাঠানোর মধ্য দিয়ে জনগণের বিপ্লব মুখ থুবড়ে পরে এবং শীঘ্রই ক্ষমতা দখল করেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। ফরাসি বিপ্লবে সাম্যের নির্ঘোষ শোনা গেলেও অতি দ্রুত তা ভিন্ন পথে পা বাড়ালো; নেপোলিয়নের নতুন ক্ষমতা লাভকে কেন্দ্র করে তা সম্রাটের সিংহাসনের চোরাগলিতে হারিয়ে গেল।
ফরাসি বিপ্লবের পর রোবস্পিয়েরের পতনের মধ্য দিয়ে নেপোলিয়ন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। নেপোলিয়ন বিপ্লবের মূলবাণী সাম্যকে বাদ দিয়ে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসকে তিনি পিছনে টেনে নিয়ে যেতে পারেননি। সামন্তযুগ আর কখনো ফিরে আসেনি। তিনি নিজে স্বৈরাচারী শাসক হলেও ইউরোপের রাজশক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন এবং ভেঙে পড়া পবিত্র রোম সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। তিনি যেসব দেশ জয় করেছেন নিজের ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে সেখানেই ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র বহন করে নিয়ে গেছেন। তিনি যে-সব দেশ দখল করেছিলেন সেখানে বিজয়ী সৈন্যরা লুটপাট করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি তা হতে দেননি। তিনি বিজিত দেশগুলোতে প্রথম পর্যায়ে নতুন আইন, নতুন ধরনের প্রশাসন এবং নতুন সামাজিকরীতি প্রচলন করেছিলেন। তিনি বিজিত দেশগুলিতে সরকারি সেনাবাহিনীর জায়গায় জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন। নেপোলিয়নের বিজয় লাভের পর ইতালির প্রায় সর্বত্রই ক্রীতদাস প্রথা বাতিল করা হয়। পাশাপাশি ধর্মকর, ভূমিদাসপ্রথা, সামন্তকর; এগুলি সব তুলে দেয়া হয়েছিল। বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির অধিকার তিনি খর্ব করলেন এবং চার্চের জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করে নিলেন। সমাজ বাস্তবতা হিসেবেই তিনি কৃষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন এবং বুর্জোয়াদের আকাঙ্ক্ষিত সামাজিক সমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একের পর এক বিজয় লাভের ফলে স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন এবং সম্রাট উপাধী ধারণ করলেন; বিপ্লবের মূলমন্ত্রের বিরুদ্ধেই চলে গেলেন। কিন্তু তিনি বিপ্লবের আদর্শে প্রথমদিকে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন যার ফল হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী।
ফরাসি বিপ্লবের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই নেপোলিয়ন ক্ষমতায় এসেছিলেন কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে নেপোলিয়ন শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। সম্রাট হবার পর ইউরোপের আশ্রিত রাজ্যগুলির প্রজাতন্ত্র ভেঙে ফেলে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘রাজপদে’ বসিয়ে তিনি তাঁর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে চাইলেন। তিনি খণ্ড খণ্ড রাজ্যগুলিকে সমন্বিত করে তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই ধরনের প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন। তিনি তাঁর অধীনস্ত রাজ্যগুলিতে দ্রুত সংস্কার এনে কৃষক সমাজ ও নবাগত মধ্যবিত্তদের তুষ্ট করার প্রয়াস নেন। ফরাসি বিপ্লবের যে বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে তাঁর সামরিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব ছিল, সেগুলি তিনি ছড়িয়ে দিলেন তাঁর সংগঠিত সাম্রাজ্যে। জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী রাজাদের মতোই ছিল তাঁর সংস্কারগুলি উপর থেকে চাপানো কিন্তু সেখানে সামন্তপ্রভুদের জন্য কোনো সুবিধা সৃষ্টি করা হয়নি। চার্চের জমি বিতরণ করা হলো নাগরিকদের মধ্যে, ধর্মীয় সঙ্ঘগুলি ভেঙে দেওয়া হলো। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি জোর দেওয়া হলো এবং তৈরি করা হলো আধুনিক বিচার ব্যবস্থা।
ফরাসি বিপ্লব তখনো অর্ধসমাপ্ত, জনগণের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেল সামরিক বাহিনী আর অভিজাতদের হাতে। শিল্প-সাহিত্য এবং নাটক নিয়ে নতুন শাসকরা নতুনভাবে চিন্তা শুরু করলেন। শিল্পীদের সমকালীন যুগের সচেতনতাকে নেপোলিয়ন সমর্থন করতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন যে সাম্রাজ্যের মহিমাময় কীর্তিও শিল্পীদের চিত্রপটে বিধৃত হোক। নেপোলিয়ন ছড়িয়ে পড়া নাট্যদলগুলোকে উৎসাহ দানের জন্য নানা উদ্যোগ নিলেন বটে, তবে ষোড়শ লুই মলিয়েরকে যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন সেটুকু স্বাধীনতাও তিনি নাট্যকারদের দিলেন না। তিনি চাইলেন তাঁর চিন্তার পক্ষে লিখবে নাট্যকাররা। সেই সময় শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণ জনগণ ছিল রাষ্ট্রের বিরাট শক্তি। শাসকরা জানতো যে-কোনো সময় শ্রমিকশ্রেণি বিদ্রোহ করে বসতে পারে শাসকদের বিরুদ্ধে। শাসক মহল তাই কঠোর হলো যাতে ফরাসি বিপ্লবের সাম্যের বাণী শিল্প-সাহিত্যে প্রচারিত না হয়। বুর্জোয়াদের ঘোষিত বিপ্লবের বাণী বুর্জোয়াদের শ্রেণিস্বার্থেই প্রচার করা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে বুর্জোয়া শিল্পচেতনাই আদর্শ বলে বিবেচিত হতো, সেখানে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আদর্শ করা হয়েছিল। কিন্তু বুর্জোয়াতন্ত্রের বিকাশ বা অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই স্বাধীনতার চেতনা ব্যক্তিসর্বস্বতায় পর্যবসিত হলো। বুর্জোয়াদের স্বার্থে পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে গিয়ে নাট্য মঞ্চায়নের স্বাধীনতা কিংবা শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করা হলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের কয়েক বছরের সঙ্গে উপরের এই সময়টাকে কেউ মিলিয়ে দেখতে চাইলে দেখতে পারেন।
ইউরোপের সর্বত্রই অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদ থেকে নাটক মঞ্চায়নের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু হলো। শাসকবর্গ নাট্যশালার ওপর তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে থাকলো। অস্ট্রিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘বার্গ থিয়েটার’-এ তো বটেই, বেসরকারি মালিকাধীন নাট্যশালাগুলোতেও ছাড়পত্রের কড়াকড়ি ছিল। সরকারি নাট্যশালাসহ জার্মানির সব কটি শহরে এবং ইতালির নগররাষ্ট্রগুলিতেও ছাড়পত্রের প্রতাপ ছিল প্রবল। বস্তুত শাসকশ্রেণী নাট্য প্রযোজনার গণসংযোগ ক্ষমতা সম্পর্কে ভীত ছিল বলেই তারা ছাড়পত্র প্রথার নিগড়ে নাট্যশালাগুলোকে বেঁধে রেখেছিল। রাশিয়াতে ঘটেছিল একই ঘটনা। ফরাসি বিপ্লবের পরে ‘কমেডি ফ্রঁসেজ’ যেভাবে বিপ্লবের পক্ষে রচিত নাটকের মঞ্চায়ন করে চলেছিল তাতে ইউরোপের রাজন্যবর্গ শঙ্কিত না হয়ে পারেনি। নাট্যশিল্পের চিরকালই একটা রাজনৈতিক প্রবণতা আছে, বহু লোককে একত্রিত করা এবং সমাজজীবনের নানা সমস্যা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচার চালানো। এটা নাট্যকলার ধর্ম এবং এটা অবশ্যই একটা রাজনৈতিক কাজ। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নাট্যশালার বিরোধ বাধাটাই ছিল সঙ্গত। নাট্যাভিনয় তাই কখনোই শুধুমাত্র ‘শিল্পের জন্য শিল্পে’-র সাধনা ছিল না। সর্বদাই ছিল চেতনে বা অবচেতনে উদ্দেশ্যমূলক। নাট্যকারের ভিতরের উদ্দেশ্যগুলো সেখানে প্রতিফলিত হতো। কিন্তু নাটক নিয়ে হঠাৎ নতুন এক প্রশ্ন উত্থাপিত হলো, নাটক কি কল্পনা-মিশ্রিত বাস্তবের রঙে রঞ্জিত হবে নাকি কল্পনা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে হুবহু বাস্তবকে চিত্রায়িত করবে? বহুদিন ধরে চলেছিল এই বিতর্ক। চলবে
চলতি লেখাটির পরবর্তী ধারাবাহিক দুটি পর্বের শিরোনাম হবে ‘নাট্যচর্চায় স্বাভাবিকবাদ আর বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব’