নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা
পর্ব ১০
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০২০
বুর্জোয়া যুগে নাট্যকলার উপযোগিতা বা উদ্দেশ্যগত দিকটি খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল। বহুজন বহুভাবে নাটককে কাজে লাগাবার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের যুগে, বিপ্লবের উত্তাল পরিস্থিতিতে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হিসেবে নাট্যপ্রযোজনা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়। এ ছিল নাট্যশালার কর্মকাণ্ডে উন্মাদনার যুগ। হাজার হাজার নতুন নাটক রচিত হয়, শয়ে শয়ে নতুন নাট্যদল জন্ম নেয়। ঐ সময়ের অস্থির বৈপ্লবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় তাঁদের নাট্য প্রযোজনায়। দেশের রাজনৈতিক মত ও ক্ষমতা যেমন অনবরত পরিবর্তিত ও উগ্র হতে থাকে, সেইরকম নাটকই প্রযোজিত হতে থাকে। নাটকের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে থাকে সপ্তাহ থেকে সপ্তাহে, দিন থেকে দিনে। যাঁদের জীবন ধারণের একমাত্র উপায় দর্শকের সামনে রাতের পর রাত অভিনয়, তাঁদের পক্ষে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলাই ছিল একমাত্র পথ। প্রতিটি চরিত্র, এমনকি প্রতিটি নাটকের সংলাপ ছিল নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং শতাব্দীর শোষণে জর্জরিত, নিপীড়িত হিংস্র জনতার নিয়ন্ত্রণাধীন। নাটক এভাবেই তার সমকালে ঘটে যাওয়া বড় বড় ঘটনা থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না। ঘটনার পক্ষে অথবা বিপরীতে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফরাসী বিপ্লবের পরে কিংবা পূর্বে খুব ব্যাপকভাবে সেটা লক্ষ্য করা যায়।
নাটকের বক্তব্য কীভাবে শাসকশ্রেণীকে ভীত করে তুলতে পারে তার বড় উদাহরণ ফরাসী দেশের অগাস্টিন বমার্শের লেখা “ফিগারোর বিবাহ” নাটকটি। নাটকটি প্যারিসের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল ‘কমেডিয়া ফ্রান্স’ প্রযোজনার জন্য গ্রহণ করে এবং সরকারি অনুমোদনের জন্য পুলিশ প্রধানের কাছে জমা দেয়। নাটক পাঠ করার পর পুলিশ প্রধান অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত হন কারণ নাটকটি খুবই শিল্পগুণসম্মত হলেও এতে স্থান পেয়েছিল সমসাময়িক কয়েকটি জ্বলন্ত বিষয়; যেমন পুলিশের ব্যাপক ক্ষমতা, বাক-স্বাধীনতার অভাব ও অভিজাত শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধা সম্বন্ধে সমালোচনা বা নানা প্রশ্ন। সময়টা ছিল অস্থির এবং এ ধরনের আবেগ অনুভূতি ফ্রান্সের জাতীয় নাট্যশালায় প্রকাশ্যভাবে আলোচিত হলে তাতে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। পুলিশ প্রধান লেনর এসব ভেবে খোদ সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের কাছে পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়ে দেন। যিনি সম্রাটকে ঐ পাণ্ডুলিপিটি পড়ে শোনান তাঁর স্মৃতিকথা থেকে পরবর্তীতে সম্রাটের প্রতিক্রিয়া জানা যায়। সম্রাট ষোড়শ লুই নাটকটির বক্তব্য শুনে ‘ন্যাক্কারজনক! এ নাটক কখনো মঞ্চস্থ হতে দেয়া যায় না’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় যা কিছু শ্রদ্ধেয় নাট্যকার সেসব বিষয়কে ব্যঙ্গ করেছেন। এ নাটক মঞ্চস্থ করার আগে বাস্তিল কারাগার ধ্বসিয়ে দিতে হবে, নয়তো এ হবে এক বিপজ্জনক বোকামি।’ নাট্যকার বমার্শে বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রবক্তা হিসেবে ফরাসী অভিজাতদের কাছে খুবই ঘৃণার পাত্র ছিলেন। শাসকশ্রেণীর বিরোধী চিন্তাকে সঙ্গী করে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় বমার্শে তা ভালোই জানতেন, এমন কি তিনি খোদ সম্রাটকে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করেননি। তাই ফিগারোর বিবাহ সম্বন্ধে সম্রাটের উক্তি শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘সম্রাট ফিগারোর বিবাহ নাটক বন্ধ করে দিতে চান তো, তাই এ নাটকের অভিনয় হবেই’।
খুব কৌশলী প্রকৃতির মানুষ হিসেবে বমার্শে জানতেন যে, সম্রাজ্ঞী মারি আঁতোয়ানেত ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা এবং সম্রাটের দ্বিতীয় ভ্রাতা কোঁত দ্যর্তোয়া নাট্যপ্রেমী। স্বভবতই তিনি তাই তাঁদের সমর্থন লাভের আশা করেন। উপরন্তু তিনি নাটকে যে-গোষ্ঠীকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন গোপনে সেই অভিজাত শ্রেণীরই সমর্থন লাভের চেষ্টা চালান। ইতিমধ্যে তাঁর নাটকটি বিপজ্জনক এবং বিপ্লবী বিষয়বস্তুর জন্য বেশ দুর্নাম অর্জন করেছে। ফলে ফিগারোর বিবাহ হয়ে ওঠে এক নিষিদ্ধ ফল যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও আগ্রহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি ঐ নাটক নিয়ে একটি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন রাশিয়ার গ্র্যান্ড ডিউকের কাছ থেকে নাটকটি সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরে মঞ্চস্থ করার জন্য বমার্শের কাছে আমন্ত্রণ আসে। বমার্শে ফরাসী দেশের সম্মানের কথা ভেবে ডিউকের সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন; পাশাপাশি সযত্নে চেষ্টা করেন ঘটনাটা সম্রাটের এবং রাজদরবারের কর্ণগোচর করার। নাট্যকার বমার্শের এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়। নাটকটা দেশের বাইরে চলে যেতে পারে ভেবে খোদ সম্রাজ্ঞী নাটকটি মঞ্চায়ন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন এবং নাটকের অভিনয়ের ব্যাপারে ব্যাপক তোড়জোর চলে। নির্বিঘ্নে মহড়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু অভিনয়ের দিন পর্দা ওঠার আধঘণ্টা আগে সম্রাটের কাছ থেকে এক বিশেষ দূত মঞ্চের পেছনে সম্রাটের জরুরি বার্তা নিয়ে প্রবেশ করে। কঠিন ও কঠোর সে বার্তাটি হলো, ‘এ নাটক মঞ্চস্থ হলে সম্রাটের ঘৃণা ও ক্রোধের উদ্রেক হবে’। ফলে অভিনয় বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দর্শকরা সারারাত নাট্যশালা ঘেরাও করে বসে থাকে। বমার্শের ভক্তের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। সম্রাট শেষ পর্যন্ত জনতার চাপের মুখে নিরুপায় হয়ে পরবর্তীতে এ নাটক মঞ্চায়নের আদেশ দেন। দীর্ঘ পঁচাত্তর রজনী একটানা পূর্ণ মিলনায়তনে নাটকটির অভিনয়ের মাধ্যমে তা জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। দূর দূর প্রদেশ থেকে জনগণ প্যারিসে ছুটে আসে নাটকটির অভিনয় দেখতে।
ফরাসী বিপ্লবের কিছুকাল পূর্বে নাটক সম্পর্কে বলা হয়েছিল, নাটকের কাজ মানুষের চেতনা বিকাশে সহায়তা করা। ফরাসী নাটক ফরাসী বিপ্লবের ঠিক পূর্বমুহূর্তে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগ্রাম করার প্রেরণা দেয়, আবার বিপ্লবের পরই তা গির্জা ও ধর্মযাজকদের সোচ্চারে ব্যঙ্গ শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী সমাজের ভণ্ডামি, কৃত্রিমতা, উন্নাসিকতা প্রভৃতির উপর নির্মম আঘাত করেন মলিয়ের। মলিয়েরের নাটকের প্রতি তখন অনেকেই বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। তবুও কেউ তাঁর অকাট্য সত্য ও অপরিসীম প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি। বিপ্লবের পূর্বে মলিয়েরের তিন অংকের প্রখ্যাত প্রহসন হলো ‘তারতুফ’। এই নাটকে তিনি ধর্মান্ধতাকে আঘাত করেন। চার্চের ক্রমাগত আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত এই নাটক মঞ্চায়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। নাট্যকার মলিয়েরের নাটকে যে খুব জোরালো রাজনীতি ছিল বা সমাজ বিশ্লেষণ ছিল তা নয়। জনগণ তখন গির্জার পাদ্রীদের বিরুদ্ধে খুবই বিরক্ত, পাদ্রীদের ধর্মব্যবসা জনগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। সতেরশো ষাট সালে মলিয়েরের নাটক সম্পর্কে সোরিন লিখেছিলেন, তাঁর ‘স্পার্টাকাস’ নাটকটি গির্জা ও ধর্মযাজকদের সোচ্চারে ব্যঙ্গ করেছিল। মলিয়েরের তখন পাদ্রীদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু করে তোলেন হাস্যরসের মাধ্যমে। মলিয়েরের নাটক জনগণের সেই সময়ের মনের চাহিদা মেটাতে পেরেছিল উচ্চকিতভাবে, যদিও গভীরভাবে রাজনীতি তাতে ধরা পড়েনি। নাট্যকার মলিয়ের তখন খুবই জনপ্রিয় ফরাসী দেশে, যাঁর আসল নাম জাঁ বাপ্তিস্ত পোক্ল্যাঁ। রাজা নিজেও মলিয়েরের নাটক খুব পছন্দ করতেন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই সভাসদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মলিয়ের তাঁর ব্যঙ্গ বা প্রহসনগুলো মঞ্চস্থ করার সুযোগ পান।
মলিয়ের নাটকে মূলত আক্রমণ করেছিলেন অভিজাত ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে। সেই সম্প্রদায়ের নানা অসঙ্গতিকে হাস্য-রসের মাধ্যমে নাটকে চিত্রিত করে তুলেছিলেন। গির্জার পুরোহিতদের আক্রমণ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি তারতুফ নাটক রচনা করেছিলেন। রাজা পুরোহিতদের চাপের মুখেই এ নাটক বন্ধ করতে বাধ্য হন এবং ধর্ম সম্প্রদায়গুলেকে ভবিষ্যতে না ঘাঁটাবার জন্য মলিয়েরকে শাসকরা সাবধান করে দেন। রাজার সভাসদরা সকলেই ছিলেন মলিয়েরের বিরুদ্ধে। মলিয়েরের নাটকে তেমন কোনো রাজনীতি ছিল না, ছিল শাসকশ্রেণী ও পুরোহিতদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বক্রোক্তি। সেটাই তৎকালীন শাসকশ্রেণী সহ্য করতে পারলো না। ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে বমার্শের নাটক যেমন সামন্তদের সমালোচনা আরম্ভ করে, ঠিক তেমনি মলিয়েরের নাটক ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। মলিয়ের সম্পর্কে রঁম্যা রলাঁ লিখেছিলেন যে, বুর্জোয়াদের থেকে মলিয়েরের দৃষ্টি অনেক বেশি প্রসারিত ছিল জনগণের প্রতি, তবে শ্রেণীসংক্রান্ত চিন্তাভাবনা সবসময় মলিয়েরের সঙ্গে মেলে না। রলাঁ একই প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘হাসি হলো একটা শক্তি, এবং লাম্পট্যের প্রতি সুচতুর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ সেক্ষেত্রে কারণটাকে যুক্তিযুক্ত করে তোলে। কিন্তু মলিয়েরের মধ্যে আমরা যেটা পাই না সেটা হলো কাজে নামার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।’ রঁম্যা রলাঁ দেখাচ্ছেন যে, মলিয়েরের নাটক সমাজ ও জীবনকে বিশ্লেষণ করার চেয়ে জীবনকে ভরিয়ে দেয় হৈ-হুল্লোড়ের মত্ততায়। দর্শকরা আবিষ্ট হয়ে থাকে মঞ্চে ঘটে যাওয়া ঘটনার তোড়ে। সেজন্য রল্যাঁর মন্তব্য, জনগণ যদি মলিয়েরের কাছ থেকে কিছুই না পায় শুধু নীচু মানের কমেডি ছাড়া, তাহলে তার প্রয়োজনটা কি? জনগণ হয়ত লাভবান হতে পারে ভাষার দিক থেকে, ভালো ভাষার ব্যবহারে; তাতে চেতনার বিকাশ কিছু ঘটবে না, মলিয়েরও ছুঁতে পারবেন না তাদের। তিনি মনে করেন, মলিয়েরের শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী নাটকগুলো দর্শকদের বিচলিত বা উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা রাখে না, দর্শকদেরদের ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মলিয়েরের নাটকগুলি ছিল, সমসাময়িক কালের যাজকদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রচার।
ফরাসী বিপ্লবের পর মধ্যবিত্তশ্রেণীর চিন্তার ধারক বাহক হয়ে ওঠে সাধারণ নাট্যশালা। ফরাসী বিপ্লব সাধারণ নাট্যশালার সর্বত্র তার ছাপ রেখে যায় এবং নাট্যপ্রযোজনাও বিপ্লবের গায়ে তার ছাপ এঁকে দেয়। বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ জনগণের জন্য বিশাল নাট্য উৎসবের আয়োজন নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাটককে শিক্ষা এবং বিনোদনের বিষয় করে তোলে, নাটকে শিক্ষার পাশাপাশি আমোদ বিতরণ করা হয়; যে আমোদ প্রমোদে এযাবৎ রাজা রাজড়াদেরই একচ্ছত্র অধিকার ছিল। বিপ্লবের কিছুকাল পূর্বেই মার্সিয়া দাবি জানিয়েছিলেন যে, এমন এক গণনাট্য বা জনগণের স্বার্থের পক্ষে নাট্যধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যার প্রেরণা হবে জনগণ এবং যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে জনগণ। রুশোরও দাবি ছিল, নাট্যকলাকে ঘিরে গণউৎসবের আয়োজন করা ও শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়া। জাতিকে কীভাবে শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে তুলবেন রুশোর ভাবনা ছিল সেই লক্ষ্যে পরিচালিত। ফরাসী বিপ্লবের পর নানাভাবে নাট্যচর্চা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু হলো। প্যারীর সাধারণ পরিষদ বিভিন্ন নাট্যশালার পরিচালকদের কাছে সুপারিশ পাঠালেন যে, তাঁরা যেন তাঁদের নাট্যশালাগুলিকে রীতিনীতি ও শোভনতার শিক্ষায়তন হিসাবে গড়ে তোলেন। দেশাত্ববোধক নাটকের পাশাপাশি অন্যান্য নাটকও যেন প্রযোজনা করেন, যেখানে ব্যক্তি গরিমাকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরা যাবে।
ব্যক্তিত্ববাদের জয় ফরাসী বিপ্লবেও ধ্বনিত হলো। সেই একই সময় আবার ফরাসী বিপ্লবের অভ্যন্তরেই একদল মানুষ সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। পাশাপাশি সারা বিশ্বের বহু চিন্তাশীল মানুষ যে তখন বুর্জোয়া বিপ্লবের কট্টর বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন তারও বহু নজির আছে। নাট্যকার গ্যাটে, শিলার এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। এই ধারারই অন্তর্ভুক্ত উপন্যাসিক বালজাক। অথচ ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা এই যে, যেসব নাটকে সচেতনভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা করা হয়েছিল সেগুলোও ছিল বুর্জোয়া নাট্যেরই অঙ্গীভূত। সমর্থন হোক, বিরোধিতা হোক, বুর্জোয়া যুগের প্রায় সব নাটকই বুর্জোয়া মূল্যবোধকে নাটকের কেন্দ্রে এনে ফেলেছিল। নইলে গ্যাটে থেকে ইবসেন পর্যন্ত অনেকেই বুর্জোয়া ক্ষুদ্রমন্যতায় ছিলেন বীতশ্রদ্ধ ও বিদ্রোহী, তবুও বুর্জোয়া মূল্যবোধ সম্পর্কে উদাসীন তাঁরা থাকতে পারেননি। কারণ তাঁদের চারপাশে বুর্জোয়ার প্রভাব ছিল অপ্রতিরোধ্য। গ্যাটে এবং শিলারেব নাটকে দর্শক বারবার যে ভাবনার মুখোমুখি হয় সেটা হচ্ছে দেশপ্রেম, দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম এবং স্বেচ্ছায় শাহাদত বরণ। পৃথিবীকে আধুনিক দেশপ্রেম দিয়ে গেছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক একটি জাতিসত্ত্বার বিকাশ, দেশের সীমানা নির্ধারণ এবং ঐক্যবদ্ধ দেশের জন্য গর্ব ও ভালোবাসা। পরবর্তীকালে সেই বুর্জোয়া দেশপ্রেম হয়ে দাঁড়াবে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা ঘৃণার প্রকাশ, বিভিন্ন দেশ সাম্রাজ্যবিস্তারের প্রতিযোগিতায় পরস্পরের বিরুদ্ধে “দেশপ্রেম” নিয়ে লিপ্ত হবে প্রথম মহাযুদ্ধে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে। বণিকদেরই দরকার হয় জনগণের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, যেন বিশ্বজুড়ে তাদের বাজার সৃষ্টির লড়াইয়ে জনগণ দেশপ্রেমের নামে প্রাণ দেয় বণিকদের মুনাফা লাভের যুদ্ধে। বণিকদের স্বার্থে জনগণ যে লড়াইটা করে, নিজের সচেতনতার অভাবে সে মনে করে সে লড়ছে দেশপ্রেমের জন্য। শিলার, গ্যাটে প্রমুখ নিজের অজান্তে সেই দেশপ্রেমের কথা প্রচার করে গেছেন তাঁদের নাটকে। নিজ যুগের প্রগতিশীল চিন্তা যে, পরের যুগের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা হয়ে দাঁড়াবে সেটা তখন বুঝে উঠতে পারার কথা নয় তাঁদের। কিন্তু তাঁদের সকল সৃষ্টিগুলি ছিল বড়মাপের, কালের বিচারে চিরায়ত সাহিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তা।
মূলত আঠার শতকের শুরু থেকেই ফরাসী দেশের মতো জার্মানী ও রাশিয়াতেও দ্রুত নাট্যশিল্পের বিকাশ ঘটে। সারাবিশ্ব জুড়েই স্বাধীনতার প্রশ্নগুলি সামনে চলে আসে। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশসমূহ এবং মধ্যে ও দক্ষিণ ইউরোপে নাট্যকলার যাত্রা শুরু হয়। ব্যক্তিত্ববাদের স্পৃহা তার মধ্যে ধরা পড়তে থাকে। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে থাকে সাধারণ মানুষ। বুর্জোয়া উত্থানের মধ্য দিয়ে নাট্যচর্চা জনমনে নতুন আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর সব দেশের বুর্জোয়ার বৈশিষ্ট্য এই যে মুনাফার লোভে তারা একেকটা দেশকে এক এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাঁধতে বাধ্য হয়। বুর্জোয়ারই প্রয়োজন হয় স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ দেশ যেখানে বুর্জোয়া পুরো বিকশিত হতে পারবে। যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে তখন মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের জন্য মৃত্যুবরণের আগ্রহ জাগাতেই হয়। বুর্জোয়া সমাজের এই দাবির কাছে হার মেনেই শিলার পরপর মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শোনাতে লাগলেন নাট্যরচনায়। ‘দস্যু’ নাটকে কার্ল ফন এক দস্যু দল সংগঠিত করে জমিদার এবং রাজার পশুশক্তির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। ইউরোপের বুর্জোয়ারা জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রবল বিজাতীয় ঘৃণা পোষণ করতেন, শিলারও সেই বক্তব্যের প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। মার্সিয়ার চিন্তা ভাবনা শিলারের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। শিলার তাঁর “ভিনহেলম টেল”-এর বিষয় বা ভাবনাকে পেয়েছিলেন মার্সিয়ার নুভেল এসাই-এর মধ্যে। শিলার তাঁর বেশির ভাগ নাটকে যা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, তাহলো; ‘স্বাধীনতার স্পৃহা স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মুখর হচ্ছে তরবারির ফলায়, মূঢ়তার শৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার, একটি জাতি দাবি জানাচ্ছে মানুষের অধিকারের; প্রজাতান্ত্রিক ঐতিহ্য কায়েম হচ্ছে’। গ্যাটেও তার ‘এডমন্ড’ নাটকের নায়কের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, নিজেদের অধিকার রক্ষা করো, তোমার যা আছে তাকে রক্ষা করতেই হে প্রিয়, আনন্দের সাথে মুত্যুবরণ করো।
স্মরণ রাখতে হবে, শাসকশ্রেণীর চিন্তার প্রভাব যেমন যুগের ওপর প্রতিফলিত হয় তেমনি প্রভাব কখনো একপেশে হয় না। প্রভাবের মধ্যে স্বীকৃতির সঙ্গে থাকে অস্বীকৃতির প্রয়াস। বুর্জোয়া সমাজের ভিতরে থেকেই বুর্জোয়া সমালোচক হয়ে দাঁড়ান শেকাসপিয়ার, গ্যাটে, শিলার প্রমুখ। নিজেদের চিন্তাকে স্থির করতে পারেন না যখন দেখেন নিজ পক্ষের বুর্জোয়ারাই আবার অতিরিক্ত শোষণে লিপ্ত। সেজন্য গ্যাটের ‘গ্যোটস ফন বেলিখিঙ্গেন’ নাটকে দেখা যায়, এক অসমসাহসিক বীর অপ্রতিরোধ্য নতুন উঠতি সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুরাতনকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে কিন্তু মাথা নোয়াচ্ছে না। রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বুর্জোয়ারা, সেখানে এক পুরাতনপন্থী অভিজাত যোদ্ধা কিছুতেই হার মানতে রাজি নয়, যদিও ইতিহাস তার বিরুদ্ধে। এইভাবে গ্যাটে প্রকারান্তে বুর্জোয়ার নিরেট মুনাফাবৃত্তির বিপরীতে অভিজাত বীরকে দাঁড় করালেন। শুধু গ্যাটে নয়, অনেকেই বুর্জোয়ার ধনলিপ্সা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পতিত হলেন অতীতমুখি প্রতিক্রিয়াশীল সনাতনী রক্ষণশীলতায়, কেউ হয়ে দাঁড়ালেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। রাজা লুই ও মারি আঁতোয়ানেতের হারিয়ে যাওয়া কালটাই ছিল ফ্রান্সের স্বর্ণযুগ, এই মিথ্যা প্রচারে তাঁরা জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। আসলে এ সবই ছিল বর্তমান কালের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রকাশিত মতবাদ। ভ্লাদিমির লেনিন বলেছিলেন, বর্তমান কালের শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রথম প্রতিবাদ ঘোষিত হয় অতীতের প্রশংসায়। ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ত শোষণের অবসান ঘটলেও ইতিহাসে আবির্ভূত হলো নতুন শোষকশ্রেণী বুর্জোয়ারা। ফলে নতুন শাসকদের বিরুদ্ধে কলম ধরতে গিয়ে পুরানো সামন্ত সমাজের গুণগান গাইলেন বহুজন। শিলারও রয়েছেন তাঁদের মধ্যে।
ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী বুর্জোয়া শোষণের ভয়ংকর চেহারাটা অনেকে দেখেছিলেন। বুর্জোয়াদের উত্থান-পর্বে বুর্জোয়াদের যে দস্যুবৃত্তি সেটাও তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন। উঠতি বুর্জোয়ারা ছিল চোর, লুটেরা এবং ভয়াবহ অত্যাচারী। লক্ষ লক্ষ কৃষককে ভিখারিতে পরিণত করেছিলেন তাঁরা পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য। জনগণের অশ্রু, রক্ত ও হাহাকারের আঁচে আরম্ভ হয়েছিল বুর্জোয়া ভোগের রন্ধন, যার প্রতিটি তণ্ডুল-কণা চুরির মাল, ডাকাতির মুনাফা। মার্কস লিখেছিলেন, পুঁজি আসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রত্যেক রোমকূপ থেকে রক্ত ও নোংরামি ছড়াতে ছড়াতে। বুর্জোয়া পুঁজি সঞ্চয়ের সেই খুন-ডাকাতি ও নির্মম শোষণের মাঝখানে শেক্সপিয়ার-গ্যাটে-শিলারদের জন্ম। সেইজন্য বুর্জোয়া লুণ্ঠনটাকে বুর্জোয়াদের ভাড়াটে লেখকদের মতো তাঁরা কেউ এড়িয়ে যেতে পারলেন না। নিজেদের ভিতরের ক্রোধটা তাঁদের নাট্য রচনার ভিতর দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। অঁরি আঁরভোর মতে, মহৎ রচনা কখনো একটি একক শ্রেণীর পক্ষপাতমূলক ছাঁচে গড়ে ওঠে না, সামগ্রিকভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সম্পর্ককে সেটা প্রকাশ করে এবং বলার কায়দায় লেখককে তাঁর শ্রেণী পক্ষপাতের ওপরে উঠতে সাহায্য করে। এজন্য দেখা যায় যে, ব্যক্তিগত চিন্তায় একজন লেখক রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হতে পারেন আবার শিল্পী হিসাবে প্রগতিশীল রচনার লেখকরূপে আবির্ভূত হতে পারেন। চলবে