শেক্সপিয়ার রচিত নাটকের একটি দৃশ্য
নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা
পর্ব ৯
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২০
নাটক যে শুধু উদ্দেশ্যমূলক তাই নয়, যুগের বা সময়ের বৈশিষ্ট্যও নাটক ধারণ করে। খণ্ডিতভাবে কোনো নাট্য ইতিহাস তাই গড়ে ওঠে না। কোনো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেও নয়। একটি যুগ, তার দাবি, তার প্রয়োজন আর পারিপারিপার্শ্বিকতার মধ্য দিয়েই নাটকের ইতিহাস গড়ে ওঠে। বিভিন্ন নাট্যধারা সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে সেই যুগেরই বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতোরকম ক্রমোন্নতি হচ্ছিলো শেক্সপিয়ারের যুগে বা এলিজাবেথের যুগে, নাটক তার সাক্ষ্য বহনকারী। ইতিহাসের নানারকম ঘটনা, নতুন নতুন নৌপথ আবিষ্কার, আইন-কানুন, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রাকৃতিক-বিজ্ঞান, পৌরবিজ্ঞান, জনতার গালগপ্প, সকলই ঠাঁই পেয়েছিল তৎকালীন নাট্যাভিনয়ে। নাটকে স্থান পেয়েছিল প্রাচীন গ্রীস-রোমের নাটকীয় কাহিনী, ইতালীর উপন্যাস, ইংরেজ জাতির অভিযানও; এমনকি সেকালের লন্ডন শহরের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও। শুধু যুগের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই নাটক কালোত্তীর্ণ হতে পারে না। সেই যুগের প্রধান প্রধান দ্বন্দ্বগুলোও নাটকে ধরতে পারা চাই। যুগ-যন্ত্রণাকে তুলে ধরার পাশাপাশি নাটকে নাটকীয়তা তৈরি করাটাও আবশ্যক। শেক্সপিয়ার তা পেরেছিলেন বলেই তিনি কালজয়ী।
যুগের দ্বন্দ্ব কীভাবে নাটকে ফুটে ওঠে তা বুঝতে হলে শেক্সপিয়ারের যুগ এবং তাঁর নাটকগুলোকে বিশেষ মনোযোগের সাথে উপলব্ধি করতে হবে। শেকস্পিয়ারের যুগ ছিলো বণিকতন্ত্রের যুগ। বণিকদের কাছে পৃথিবীটা একটা বাজার ছাড়া কিছুই নয়। ইতিহাসের বিচারে বুর্জোয়া যতো প্রগতিশীল হিসাবেই আবির্ভূত হোক, তার প্রধান উদ্দেশ্য সব সময়ে হীন জঘন্য মুনাফা লাভ। মুনাফার স্বার্থেই সে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়েছে, যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়েছে, নতুন নতুন দেশ জয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে; দূরকে নিকট করে তুলেছে। ব্যক্তি নিরপেক্ষ, উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ বিচারে বুর্জোয়ার উত্থান এক মহান প্রগতিশীল অধ্যায়। তবে এই বুর্জোয়ারা সচেতনভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা ভাবেনি। জনতার দুঃখ-দুর্দশা মোচনের অভিপ্রায় নিয়ে, সদিচ্ছা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই আরম্ভ করেনি। সামন্তবাদের বিরুদ্ধে তার বিজয় লাভটাই ছিল মূল কথা। ইতিহাসের অনিবার্যতার কারণেই জনতাকে সে সাথে পেয়েছিল, যে জনতাই পরে তার নির্মম শোষণের শিকার হয়েছে; বুর্জোয়া শাসনের যন্ত্রণা ভোগ করেছে। বণিকরা যেমন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী কখনো রাজার পক্ষে, কখনো রাজদ্রোহী; ঠিক তেমনি সকল শ্রেণীসংগ্রামের নানা স্তরে জনতা কখনো বণিকের সঙ্গে, কখনো বা বিরুদ্ধে। সামন্তবাদের এবং তাদের কূপমণ্ডুক চিন্তার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর মতবাদ জনতার ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। ফলে বণিকদের সাথে জনতার চিন্তাভাবনার যেমন মিল ছিল, তেমনি বণিকদের বহু চিন্তার বিরুদ্ধে জনতার নিজস্ব মতামতও বেরিয়ে এসেছিল। বণিকদের অর্থ লালসাকে পূর্ণ সমর্থন তাঁরা কোনোদিনই দিতে পারেননি। সেইজন্যই বণিকদের অর্থ লালসার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে জনমত। জনতার পাশাপাশি বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের অনেকের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। নবোত্থিত বুর্জোয়া চিন্তাবিদরা যেমন জমিদারতন্ত্রের ছিলেন ঘোর শত্রু, তেমনি বুর্জোয়ার অর্থগৃধ্নুতা, তার কূপমণ্ডুকতা, নানা প্রশ্নে বিস্ময়কর পশ্চাদপদতা, সবই তীব্র কশাঘাতে জর্জরিত হচ্ছিলো লেখক-কবি-নাট্যকারদের হাতে।
বণিকশ্রেণীর মুখপাত্ররা যখন বাণিজ্যের জয়গান করেছেন, জনতার প্রতিনিধিরা সে গানে কণ্ঠ মেলাননি। সেই কারণেই বুর্জোয়া যুগের শাসকদের, সুবিধাভোগীশ্রেণীর স্বার্থ-চিন্তা, বুর্জোয় যুগের অগ্রগতি যেমন শিল্প-সাহিত্য-নাটকে ধরা পড়তে বাধ্য, তেমনি তার বিপরীত সত্যটাও। যারা বুর্জোয়া চিন্তার বলি সেই জনগণের ক্ষোভটাও সত্যিকারের শিল্প-সাহিত্যে ধরা পড়বে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। সেজন্য মহৎ শিল্প-সাহিত্যে বিভিন্ন যুগের সম্পূর্ণ ছবিটাই ফুটে ওঠে। শেক্সপিয়ারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। নিজ যুগচেতনার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি এর পাল্টা মতও দাঁড় করাবার প্রয়াস পেয়েছেন। বুর্জোয়ার মতবাদকে তিনি কতোটা গ্রহণ করেছিলেন আর কতোটা বর্জন করেছিলেন সেটা সে বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সময়কালে রাজা, অভিজাত এবং বুর্জোয়ারা নিজেদের মধ্যে শত বিরোধ সত্ত্বেও নিজ স্বার্থচিন্তায় এক এবং ঐক্যবদ্ধ শক্তি ছিল। ভিন্ন দিকে লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব মানুষ, যাদেরকে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থায় মজুর হিসাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা চলছে, যাদের শ্রম শোষণের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী; ইতিহাসের সেই দ্বান্দ্বিক নিয়মটা শেক্স্পিয়ার কাছে পরিষ্কার না থাকলেও ধনীদের কর্তৃক দরিদ্রদের শোষণ, বণিকদের অর্থলালসা তাঁর নজর এড়ায়নি। ফল কী দাঁড়াল? শেক্সপিয়ার উঠতি বুর্জোয়াকে বরণ করতে পারেননি আবার পশ্চাদপদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজকেও গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়েছিল। সেজন্য সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে যেমন তাঁর নাটকে তীব্র আক্রমণ রয়েছে, তেমনি বুর্জোয়া বণিকদের বিরুদ্ধেও তিনি কলম ধরেছেন।
ধর্মীয় আবেষ্টনীর মধ্যে জন্মগ্রহণ করায় যেমন শেক্সপিয়ার ধর্মকে বর্জন করতে পারেননি, তেমনি আবার ধর্মের কুসংস্কার, পুরোহিতদের সম্পদ-লালসা, ধর্মীয় গির্জার কর্তৃত্বকে সমর্থন দেননি। পাশাপাশি সে সময়কার প্রোটেস্টান্টদের দ্বারা ক্যাথলিকদের প্রতি অত্যাচার হতে দেখেই তিনি ক্যাথলিকদের পক্ষ নিয়েছিলেন। যে-সমাজে শেক্সপিয়ার বাস করতেন এবং যে-শ্রেণীর তিনি মুখপাত্র এবং ইতিহাসের যে সময়কালে তিনি কলম ধরেছিলেন; সবই তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। শেক্সপিয়ারের রচনাগুলোই তার প্রমাণ। শেক্সপিয়ারের নাটকে তাঁর সমাজের মূল বিরোধগুলো এবং সেই সাথে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সংর্ঘষগুলোও ধরা পড়েছে। তিনি মহৎ ও জনপ্রিয় এ কারণেই যে, নিজ সময়কে এত ব্যাপকভাবে খুব কম নাট্যকারই ধরতে পেরেছেন। একান্তভাবেই তিনি তাঁর যুগ দ্বারা সীমিত কিন্তু তিনিই আবার সেই যুগের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। বুর্জোয়া অর্থগৃধ্নুতার বিরুদ্ধে তাঁর নাটক মার্চেন্ট আব ভেনিস বা ভেনিসের সওদাগর। মহৎ ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয়েই তিনি আক্রমণ চালিয়েছিলেন বণিকদের ওপর। সুদখোর বণিকদের বিরুদ্ধে যে প্রবল জনমত ছিল শেক্সপিয়ার তারই প্রতিনিধি। সেজন্যই তাঁর নাটকের খলনায়করা শুধু টাকাই চিনেছে। ইয়াগো, এডমণ্ড, ‘এজ ইউ লাইক ইট’-এর ফ্রেডারিক, ‘টেমপেস্ট’-এর আন্তিনিও ক্লোটেন সকলেই অর্থের পূজারী। শাইলক সেখানে অর্থের পূজারী আবার একই সঙ্গে খ্রিস্টানদের ধর্ম বা বর্ণবিদ্বেষের শিকার।
নাট্যকার হিসেবে শেক্সপিয়ার ছিলেন নির্যাতিতের মুখপাত্র সেজন্যই বুর্জোয়াদের লালসাবৃত্তিকে তিনি শুধু ঘৃণাই করেননি, শুধু সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, ধর্মচেতনায় রঞ্জিত বিশেষ এক পাল্টা জীবনবিধি সৃষ্টির সক্রিয় প্রচেষ্টা তাঁর লেখায় সুস্পষ্ট। লক্ষণীয় শেক্সপিয়ারের সমসাময়িক নাট্যকার ন্যাশ আক্রমণ করেছিলেন সুদখোর মহাজনদের, চেটল্ও ব্যঙ্গ করেছেন সেই সব রসবোধহীন ধনীদের যারা শুধু টাকা সঞ্চয়কেই জীবনের লক্ষ্য মনে করে। শেক্সপিয়ার-পরবর্তী জনপ্রিয় ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরও লোভী ও ভণ্ড বুর্জোয়াদের আক্রমণ করেছেন। টাকাকে আক্রমণ করা ছিল সে যুগের লেখনীর এক বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে বালজাকের উপন্যাসে বারংবার দেখি টাকার হিসেব কষা কৃপণ বুর্জোয়ার চিত্র যাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হয়ে রয়েছে বৃদ্ধ গোরিও এবং গ্রাঁদে। গ্রাঁদে মুনাফা বৃদ্ধির লোভে নিজ কন্যা ইউজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফটকা খেলতেও দ্বিধা করে না। টাকার মালিক বুর্জোয়াদের প্রতি এভাবেই নাটকের পর নাটকে ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, লেখক-শিল্পীদের দ্বারাই।
বর্তমানকে লঙ্ঘন করে চিরন্তনকে যে ধরা যায় না, শেক্সপিয়ারের নাটকে সেটাই প্রমাণিত। বর্তমান সময়কে দ্বন্দ্বসমেত ধরতে গিয়ে তিনি চিরন্তনকে তুলে ধরেছেন। জনগণের মধ্যকার বিদ্রোহ, প্রতিক্রিয়াশীলতা সবই শেক্সপিয়ারের রচনায় প্রতিফলিত। শেক্সপিয়ারের নাটকে যে গুপ্তহত্যা, বিষপ্রয়োগ ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের ছড়াছড়ি; সেগুলো সে যুগেরই বাস্তবতা। শেক্সপিয়ার তাঁর নাটকে সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেননি, কোনো বড় নাট্যকারের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। নির্যাতিতের মুখপাত্র বলেই তিনি যুগের মুখপাত্র। শেক্সপিয়ারের চোখে বুর্জোয়ারা, নতুন শাসকরা ছিল অর্থগৃধ্নু ষড়যন্ত্রকারী নীতিবোধ বিবর্জিত দস্যুর দল। সে কারণে শাসকশ্রেণী যেমন ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য, তেমনি পুরোহিত সম্প্রদায়কে শেক্সপিয়ার সদাসর্বদা নীচ-প্রকৃতির করে দেখিয়েছেন। পুরোহিতদের জ্বলন্ত ভাষায় আক্রমণ করে তিনি সমকালীন শোষণের বিরুদ্ধে একটি প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতি যেহেতু সমাজবদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার অঙ্গ, তাই প্রশ্নাতীতভাবে তা এসে গেছে তাঁর নাট্যচিন্তায়।
সত্যিকার অর্থে, প্রতি যুগে শাসকশ্রেণীর চিন্তা-ভাবনাই হয়ে ওঠে পুরো সমাজের চিন্তা। সুতরাং বুর্জোয়া যুগে শেক্সপিয়ার কিংবা অন্যান্য মহৎ নাট্যকারদের চিন্তায় কীভাবে সেই শ্রেণীর চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে, কীভাবে কতোটুকু নাট্য রচনাকে প্রভাবিত করেছে সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয়। ইউরোপের নবজাগরণ মানুষকে নিয়ে এলো সব শিল্পের কেন্দ্রস্থলে। সামন্তযুগে গির্জা মানুষকে ফেলে রেখেছিল ইশ্বর ও শয়তানের পদতলে। সেখানে নবজাগরণের যুগে ইশ্বরের স্থানে মানুষের উপাসনা ছিল এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি। শীঘ্রই এই ঘটনা ব্যক্তিত্ববাদের জন্ম দিলো। ব্যক্তিই হয়ে উঠলো সর্বেসর্বা। ব্যক্তিই যেন নিয়ন্ত্রণ করছে ঘটনাকে, যা ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতাকেই অস্বীকার করে। সম্পদের মালিকানার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ববাদ জন্ম দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিরোধী পরিস্থিতির। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা বলা হলেও বৃহৎ ব্যক্তির দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তিগত সম্পত্তির হাতিয়ারে পরিণত হয়ে ব্যক্তিত্ববোধের নয়া শিকলে বাঁধলো সাধারণ মানুষকে। বুর্জোয়া সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম সম্পর্কে ক্রিস্টোফার কডওয়েল বলেছেন, বুর্জোয়া নিজেকে দেখে স্বাধীনতার জন্যে একাকী যুদ্ধরত বীরনায়করূপে; যেসব প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পর্ক মানুষকে আটকে রেখেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত একজন ব্যক্তি হিসাবে। বুর্জোয়া শিল্পী-সাহিত্যিকরাও নিজেদের দেখেন ঠিক তেমন একজন ব্যক্তিরূপেই। কেন এটা ঘটে? বুর্জোয়া সমাজে প্রতিযোগিতার মধ্যেই সবকিছুর সৃষ্টি। প্রতিযোগিতার মধ্যেই মানুষ সম্পদ ও সৌভাগ্য গড়ে তোলে কিংবা সর্বহারা হয়ে যায়।
বুর্জোয়া ব্যবস্থা মানুষকে শেখায় নিজের জন্যই নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করতে। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা, আলাদাভাবে ধনী হওয়ার প্রয়াস পাওয়া বুর্জোয়া ধারণাগুলোরই অন্তর্ভুক্ত। বুর্জোয়াদের বিকাশকালে রোমান্টিক বা ভাববিলাসী যুগ মানেই ব্যক্তিত্ববাদের যুগ। বুর্জোয়া বিপ্লব তার ঊষালগ্নে মানুষকে মুক্ত করেছিল সামন্ততন্ত্রের কঠিন নিগড় থেকে। ব্যক্তি স্বাধীনতার জয়গানে মুখরিত ছিল সেই সময়বৃত্ত। সমষ্টির স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বার্থকে দাঁড় করানোটা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিবাদের ঝোঁক হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের স্থানে একটা নগদ-কড়ির সম্পর্ক স্থাপন করা। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বুর্জোয়া সমাজে তাই স্বার্থ কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, অন্যের বিরুদ্ধে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সামন্ত সমাজের সীমাবদ্ধতাকে চূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত বুর্জোয়ার ব্যক্তি সর্বস্বতা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড ও নিরন্তর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আনয়ন করে। বুর্জোয়া চিন্তায় ব্যক্তি নিজেকে দেখেন এমন একজন ব্যক্তিরূপে যিনি তার হৃদয়স্থিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ। এই বুর্জোয়া-স্বপ্ন, জগতপ্রপঞ্চকে এককভাবে রচনা করার একক মানুষের স্বপ্ন। যেমন ফাউস্ট, হ্যামলেট, রবিনসন ক্রুশো, শয়তান এবং প্রফুক। মার্লো, শেক্সপিয়ার বা পরবর্তীরা সেই ব্যক্তিত্ববাদের চিন্তাকে এড়াতে পারেননি তাঁদের নাটকের চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে।
ভাববিলাসী যুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণেই শেক্সপিয়ারের বিরাট বিরাট চরিত্ররা নিজেদের বিরাটত্ব প্রমাণ করতে এতো ব্যস্ত যে তার জন্য ঘটনার বাস্তবতা পর্যন্ত চুরমার হয়ে যায়, বিরাটত্ব প্রমাণ করার জন্য রাজা লিয়রকে যেতে হয় বনবাসে এবং শেষে কন্যার মৃতদেহ বুকে নিয়ে মহত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। নবজাগরণের যুগের মানববন্দনার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ‘হ্যামলেট’। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বলিষ্ঠতম ঘোষণা হ্যামলেট। শেক্সপিয়ারের নাটকে সব ধরনের চরিত্ররাই এসেছে। কিন্তু রাজারাই, অভিজাতরাই এসেছে নায়ক হিসাবে। শেক্সপিয়ারের আমলে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, চিন্তার বলিষ্ঠতায়, কুসংস্কারের বিরোধিতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল শিক্ষিত অভিজাতদেরই, রাজা রাজকুমারদেরই। বিশেষত ইংল্যান্ডে। সেইজন্য শেক্সপিয়ার তাদেরকেই নাটকের নায়ক করেছেন। সেটাই সেই সময়ের বাস্তবতা। তাঁর নাটকে বিপ্লবী কোনো শ্রমিক নেতার দেখা মেলেনি। ফরাসী বিপ্লবের আগে সেটা সম্ভবও ছিল না। সেজন্য কোনো শ্রমিক নেতাকে নায়ক করা শেক্সপিয়ারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আবার গণবিদ্রোহের ঘটনা এড়ায়নি তাঁর চোখ যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ “কোরিওলেনাস“, “জুলিয়াস সীজার”। সেই সব গণবিদ্রোহকেও শেক্সপিয়ার চিত্রিত করেছেন চমৎকারভাবে জনতার দোদুল্যমান চরিত্রসহ। সেজন্য উৎপল দত্ত লিখছেন, ‘রাজনৈতিক নাটকও শেক্সপিয়ারের কাছ থেকেই শিখতে হবে এখনো’।
প্রাচীন গ্রীক নাটক বা শেক্সপিয়ারের নাটকে যা দেখা গিয়েছিল, নাটক হচ্ছে নানা চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে ফুটে ওঠে বৃহত্তর দ্বন্দ্বের প্রতিরূপ। শেক্সপিয়ার সম্পর্কে বলা হয় তিনি নাকি কোনোদিন কারো ভালো করেননি, করবেনও না কোনোদিন। বস্তুত শেক্সপিয়ার মানবতার যেটুকু উপকার করেছেন তার ধরনটা পরোক্ষ, দূরস্থিত। তিনি তাঁর মহত্তম নাটকগুলোর ঘটনা পরম্পরার ক্ষেত্রে বিকৃত নৈতিকতা চিত্রায়ণের অভ্যাস থেকে মুক্ত ছিলেন। নাটকে তিনি সমাজ সত্যকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, নীতিকথা বলার চেষ্টা করেননি। বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়বে শেকসপিয়ারের নাটকের ভিতরেই প্রথম এক ব্যক্তি চরিত্র সেই সমাজের শ্রেণীচরিত্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশিত হলো। হ্যামলেট কোনো ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া রাজপুত্র নয়। যুগ যুগের সবকিছু বুঝতে পারা কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমান মধ্যবিত্তের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। হ্যামলেট দোদুল্যমানতা নিয়ে অন্তরে যাতনা ভোগ করে, নানারকম পরিকল্পনা সাজায় রাজার বিরুদ্ধে, ব্যক্তি হিসেবে লড়তে চেষ্টা করে হ্যামলেট। সকল লড়াইয়ের পর প্রাণ দেয়ার ভিতর দিয়ে ব্যর্থতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাবে। ঠিক এমন করে শেক্সপিয়ারের আগে দ্বান্দ্বিকভাবে সমাজের চরিত্রগুলো নাটকে বিকশিত হয়নি। শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রগুলি তাই একপেশে নয়, সর্বদাই দোষেগুণে মিশ্রিত। ত্রুটির উর্ধ্বে কেউ নয়। যুগের বিচারে নাট্যকার হিসেবে শেক্সপিয়ার এর চেয়েও বেশি কিছু করেছেন। তিনি বস্তুবাদের মূল ভিত্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্যক্তি দ্বন্দ্বকে সামাজিক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে। জুলিয়াস সীজারের সাথে ব্রুটাসের বিরোধ কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে নয়, তা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব। দুই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব। ব্যক্তির প্রেম বা ভালোবাসা, লোভ বা হিংসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা নাটকে কিন্তু আদর্শই হলো মূল নাটকীয়তা; মূল দ্বন্দ্ব। কিন্তু সকল আদর্শের পেছনেই রয়েছে আবার ভিন্ন একটা স্বার্থ।
সত্যিকার অর্থে শেক্সপিয়ার বা তাঁর সমকালীন বা পরবর্তী নাট্যকারদের চিন্তা কি শাসকশ্রেণী মেনে নিয়েছিল? বুর্জোয়া উত্থানের পেছনে যে প্রগতিশীল ভূমিকা তার প্রতি এইসব নাট্যকারদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ধনীদের অর্থগৃধ্নুতার যে সমালোচনা তাঁরা করেছিলেন শাসকশ্রেণী কি ইতিবাচকভাবে সেটা গ্রহণ করতে পেরেছিল? মোটেও না। শেক্সপিয়ারের যুগের নাট্যশালা ও নাটকের সঙ্গে বুর্জোয়াদের ক্রমান্বয়ে সংঘর্ষ সর্বজনবিদিত। শেক্সপিয়ারের “দ্বিতীয় রিচার্ড” নাটকের রিচার্ডকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করার দৃশ্যটি সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেটে বাদ দেয়া হয় এবং শেক্সপিয়ারকে “ওল্ড কাস্ ল” নাটকটির নাম পরিবর্তন করে “ফলস্টাস” রাখতে বাধ্য করা হয়। ষোল শতকের মাঝামাঝি থেকেই শাসকশ্রেণী নাটক নিষিদ্ধ করার বহুরকম চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বুর্জোয়ারা ষোল শতকেই নাটকের বিরোধিতা করেছিলেন এই বলে যে, নাট্য প্রযোজনাগুলো যুব শক্তিকে পাপের পথে টেনে নেয়। শহরে নাট্যশালা থাকলে খুন জখম বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে, নাটকে রাজদ্রোহী কথাবার্তা উচ্চারিত হয় জনগণের বোধগম্য ভাষায়। জন স্টকউডের মতে নাট্যশালা হচ্ছে শয়তানের আখড়া। পাদ্রী নর্থব্রুক বলেন, শয়তান যে বিদ্যালয় খুলেছে তার নামই নাট্যশালা। গসন বলতে চেয়েছেন নাটক মানুষকে শেখায় খুন, পাশবিকতা, নানা ধরনের অবৈধ প্রেম ও নিষিদ্ধ আত্মীয়-সঙ্গম। ইংল্যান্ডে ষোল শতকের শেষদিক থেকেই নাটকের ওপর ছাড়পত্র প্রথা চালু করা হলো। সরাইখানাগুলোতে নাটক মঞ্চায়নের জন্য লর্ড মেয়রের অনুমতি নিতে হতো। মেয়রের নিষেধ থাকলে যে-কোনো নাটক বন্ধ হয়ে যেতো। ষোল শতকের শেষে টমাস ন্যাশ ও বেনসনের মতো নাট্যকারদের কারাগারে পাঠানো হলো। শেক্সপিয়ারের নাটকের ওপর কড়া নজর দেয়া হতে থাকলো। সেজন্য তাঁর বেশকিছু নাটক থেকে বহু সংলাপ বাদ পড়েছে, বহু সংলাপ উধাও হয়ে গেছে। ষোলশো বিয়াল্লিশ সালে নাটকের ওপর এলো চরম আঘাত। বুর্জোয়াদের অগ্রণী সৈনিক পিউরিটানরা ক্ষমতা দখল করে নাট্যশালা বন্ধ করে দেয় দীর্ঘদিনের জন্য। সতেরো শতকের মধ্যভাগেই এভাবে ইংল্যান্ডে নাটকের ওপর শাসকশ্রেণীর খড়গ নেমে এলো।
প্রাচীন গ্রীসের নাটক ও শেক্সপিয়ারের নাটক রচনার উদ্দেশ্যকে কিছুটা গুরুত্বের সাথেই দেখতে হবে। দুটো নাট্যধারাই যেমন সেই সময়কার শাসকশ্রেণীর মতামতকে প্রতিফলিত করেছে তেমনি নির্যাতিত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কথাও বলেছে। শেক্সপিয়ার ও তাঁর সমসাময়িক নাট্যধারার যেটা বড় লক্ষণ তাহলো, নাটকের ভিতর দিয়ে তাঁরা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। কোথাও তা সামন্ত সমাজের বিরুদ্ধে, কোথাও তা বুর্জোয়া সমাজের বিপরীতে। নাটক সেখানে উদ্দেশ্যহীন ছিল না। শুধুমাত্র বিনোদন বিতরণ তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। প্রাচীন গ্রীসের নাটক যখন জনপ্রিয়তা লাভ করে তখন নাটক খোলা প্রান্তরে মঞ্চায়িত হতো। বড় বড় দাপুটে তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিল না। ছিল না বর্তমান প্রযুক্তির ব্যবহার, নানান রকম আলো প্রক্ষেপণের কারসাজি। নাটকগুলি দর্শকের মন জয় করেছিল নাট্যকারের লিখবার ক্ষমতায়। বিচিত্র সব চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। স্মরণীয় সব সংলাপ রচনা করেন যা মানুষের হৃদয়কে জয় করেছিল। দুই আড়াই হাজার বছর পর সেসব নাটক এখনো মঞ্চায়িত হচ্ছে সারা বিশ্বে, কারণ মূলত তার বক্তব্য আজকের দিনেও সমসাময়িক। ঠিক একই কথা বলা যাবে শেক্সপিয়রের ক্ষেত্রে। সুন্দর মঞ্চ ছিল না, মিলনায়তন ছিল না, নাটক হতো উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে। গ্রীসের যুগের মতো খোলা প্রান্তরে বসে নাটক দেখতেন দর্শকরা। গ্রীসের নাট্যকারদের মতোই শেক্সপিয়ার প্রযুক্তির খেলা, উজ্বল আলো, জাকজমকপূর্ণ মঞ্চসজ্জা বা নানা ঝলমলে পোষাক দিয়ে দর্শকের মন ভোলাবার সুযোগ পাননি। নাটকের জন্য বিচিত্র সব চরিত্র সৃষ্টি করে আর তাদের মুখে অর্থপূর্ণ সংলাপ বসিয়ে দিয়ে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। চালাকি করে, পত্রিকার প্রচারের জোর জনপ্রিয়তা অর্জন করার সুযোগ ছিল না তাঁদের; সবটা ঘটেছিল তাঁদের লেখনির জোরে। বৃহৎ চিন্তা করবার শক্তি বা লেখনির প্রতিভা দিয়ে নিজ যুগে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁরা, বর্তমান যুগকে পর্যন্ত শাসন করে চলেছেন। শেক্সপিয়ারের যুগ পরিচিত ছিল রোমাণ্টিক বা ভাববিলাসী যুগ, মানুষ তার ভাব বা কল্পনার জগতে নতুন এক বাস্তব তৈরি করেছিল। সেখানে ভাবের আদান প্রদান ঘটেছে বাস্তবের মাটিতে সম্পূর্ণ পা না রেখে। সন্দেহ নেই, শেক্সপিয়ার বা সে যুগের অনেকেই জনতার জন্য লিখেছেন, কিন্তু সকল গণমানুষ তাদের সাহিত্য বা নাটকের চরিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। চলবে