আবরার ফাহাদ
‘নাই’ করে দেয়ার রাজনীতি চলতেছে দেশে
মঈনুল ইসলাম তুহিনপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৭, ২০১৯
শিবির সন্দেহে খুন। এক্সপ্রেশনটা কি নতুন লাগে আপনাদের কাছে? অপরাধ মনে হয় খুব? এই অপরাধের সামাজিক ভিত্তি তৈরি হইছে গত এক দশকে।
শিবির সন্দেহে, `গোপন` বৈঠকের খবর পেয়ে, `বিতর্কিত` পেইজে লাইক দেয়ায়, অমুকের সমালোচনা করায়, তমুকের বিরুদ্ধে বলায় শত শত ছাত্র আর সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হইছে। সড়ক দুর্ঘটনায় খুনের প্রতিবাদ হইছে, শিবির ভাইবা হিন্দু যুবকরে খুনের প্রতিবাদ হইছে, আরো নানারকম খুনের প্রতিবাদ এদেশে হইছে। কিন্তু `শিবির সন্দেহে খুন`র প্রতিবাদ? আপনারা গত এক দশকে কয়টা করছেন?
আপনারা ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে বলছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু সরকারের সমালোচনার কারণে শিবির বইলা গুম, খুন, জেল-জুলুম— এই যে বিশাল লিবারাল ব্লাসফেমি, জাতিয়তাবাদী ধর্মের রাজনীতি— এর বিরুদ্ধে আপনি কই, কমরেড?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। আমারে যখন কোনোরকম কারণ ছাড়াই `শিবির সন্দেহে` থানায় দেয়া হইল, তখন অনেকে প্রতিবাদ করছেন। বাসায় আইসা আমি প্রতিবাদগুলা দেখছি। প্রতিবাদের ভাষা মোটামুটি কমন— `আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উনি শিবির করেন না।` মানে, যদি প্রমাণিত হয় যে আমি শিবির করি, তাইলে এই দুনিয়ার একটা ব্যক্তিও আর আমার দায় নেবেন না। অনেকেই সেই সময় প্রতিবাদ তো দূরে থাকুক, নিকটস্থ বন্ধুদের সাথে কানাঘুষা করতেছিলেন— উনি কি আসলেই শিবির করে?
আপনারা ব্লগার হত্যার বিচার চান, কলমের জবাব কলমে দিতে বলেন, মতাদর্শের জবাব মতাদর্শ দিয়া দিতে বলেন— কিন্তু গত এক দশকে আপনারা কয়জন এই হত্যাকাণ্ডগুলার প্রতিবাদ করছেন? বরং এখনও অনেকে ভাবেন, নুরের পোস্টে পুজায় অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বলা লোকগুলারে `স্রেফ নাই করে না দিলে` দেশে শান্তি আসবে না।
তো, এই নাই করে দেয়ার রাজনীতি চলতেছে এই দেশে। আপনারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নাই করে দিতে চান, কারণ এইটা `নেসেসারি ইভিল`। তো এর কর্মীরাও নিশ্চয়ই তাই। জামাত-শিবিররে বিনা বিচারে রাস্তায় ফালাইয়া খুন করা যায়— ২০১৩ সালে সুশীল মিডিয়া, `প্রগতিশীল` রাজনীতিবিদগণ, উগ্র জাতিবাদী ও মুক্তমনা ব্লগারচক্র আর শিল্পপাড়ার ভাঁড়েরা এই সম্মিলিত সোশাল কনসেন্ট তৈরি করছেন। খুন, মানুশ হত্যার ইফেক্ট এদেশে, ফলে নাই হইয়া গেছে।
আজকের এই খুন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা যদি ভাবেন, ভুল করবেন। খেয়াল করেন, খুনের সাথেসাথেই লীগের স্টেটমেন্ট হইল— আবরার শিবির। কেন তারা এই স্টেটমেন্টটা দেয়, আপনারা জানেন? কারণ, এইটার বিরুদ্ধে আপনাদের কিচ্ছু বলার নাই। গত এক দশক ধইরাই ছিল না। এইটার পক্ষে এক নীরব সোশাল কনসেন্ট গইড়া উঠছিল দেশে। সেই পাপ এখন গ্রাস করতেছে সবাইরে।
আমি সবসময় বলি, একটা অন্যায় কখনোই ন্যায় আনতে পারে না। আপনি অপজিশনরে রাস্তায় পিটাইয়া খুন করবেন, কালকে আপনারে লোকে শিবির বইলা খুন করবে। তো, করতেছে না? যুবলীগের সব নাকি বিএনপি-জামাতের লোক, এই মর্মে খবর পাইতেছি। ছাত্রলীগে দুই দলের গ্যাঞ্জাম হইলেই একদল আরেকদলরে শিবির কইয়া হামলা করে। বামদের `বামাতি` বা `বাশি` এক্সপ্রেশন তো খুবই জনপ্রিয় হইছে, শহীদুল আলমও রাজাকার পরিবারের সন্তান মর্মে খবর দেখছি।
এইগুলি কেন? কারণ, আপনি সমাজে পাপের কনসেন্ট দিলে, সেই পাপ আপনারে ছাড়বে না। সেই পাপ আজ হউক, কাল হউক, আপনার ঘরে আইসা পড়বে। আজকে আবরার খুনের পরেও বহু লোকের অন্তরে খচখচ করতেছে, আচ্ছা, আসলেই শিবির করত নাকি? ইয়ে মানে, কী করব? আপনার এই খচখচানির দায় আসলে আপনার একার না, আমাদের সবার। গত এক দশক যাবত আস্তে আস্তে এই খচখচানি তৈরি করা হইছে।
এই খচখচানিরে প্রশ্রয় দিয়েন না। আওয়ামী লীগের রাজাকার কার্ড খেলা রুইখা দিছিল কোটা আন্দোলন। এবার শিবির কার্ড খেলাটা রুইখা দাঁড়ান প্লিজ। আর কোনো মায়ের বুক খালি হইতে দিয়েন না। মতাদর্শিক কারণে হত্যার যে করুণ অগ্নিযজ্ঞে আপনারা কনসেন্টের ঘি ঢাইলা আসছেন এতকাল, সেই আগুনে এইবার কিছু পানি ঢালেন। নগর পুড়লে কোনো আলয়ই বাকি থাকবে না, স্মরণ রাইখেন।
এইটা একটা অনেক বড় ইস্যু। আপনেরা এইটারে `ইসকনের ষড়যন্ত্র` টাইপ আলাপে রিডিউস কইরেন না প্লিজ। এর আগেও এমন খুন হইছে। তবে হ্যাঁ, যারা শোভন-রাব্বানির স্যাকিংয়ে আনন্দে লাফাইছিলেন, তাদের বলছিলাম যে, যে দিন আসতেছে, তা খুব বেশি ভালো হবে না। প্রমাণ আরো পাইবেন। ফলে শোভন-রাব্বানিরে ছাড়েন, মূল ইস্যুতে নজর দেন।