নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প ‘রস’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০২০

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের আজ জন্মদিন। ফরিদপুর জেলার সদরজিতে ১৯১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার ‘রস’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুর বাগান ঝুরতে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনের যেতে না যেতেই নিকা করে নিয়ে এলো পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনকে। পাড়া-পড়শি সবাই তো অবাক। এই অবশ্য প্রথম সংসার নয় মোতালেফের। এর আগের বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। তবু পঁচিশ-ছাবি্বশ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ। আর মাজু খাতুন ত্রিশে না পৌঁছালেও তার কাছাকাছি গেছে। ছেলেপুলের ঝামেলা অবশ্য মাজু খাতুনের নেই। মেয়ে ছিল একটি, কাঠিখালীর শেখদের ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঝামেলা যেমন নেই, তেমনি মাজু খাতুনের আছেই বা কী। বাঙ্-সিন্দুক ভরে যেন কত সোনাদানা রেখে গেছে রাজেক মৃধা, মাঠভরে যেন কত ক্ষেত-ক্ষামার রেখে গেছে যে তার ওয়ারিশি পাবে মাজু খাতুন। ভাগের ভাগ ভিটার পেয়েছে কাঠাখানেক, আর আছে একখানি পড়ো পড়ো শণের কুঁড়ে। এই তো বিষয়-সম্পত্তি, তারপর দেখতেই বা এমনকি একখানা ডানাকাটা হুরীর মতো চেহারা। দজ্জাল মেয়েমানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া কী আছে মাজু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।

সিকদারবাড়ি, কাজীবাড়ির বউ-ঝিরা হাসাহাসি করল, ‘তুক করছে মাগী, ধুলা-পড়া দিছে চৌখে।’

মুন্সীদের ছোট বউ সাকিনা বলল, ‘দিছে ভালো করছে। দেবে না? অমন মানুষের চৌখে ধুলা-পড়া দেওয়নেরই কাম। খোদা তো পাতা দেয় নাই চৌখে। দেখছো তো কেমন ট্যারাইয়া ট্যারাইয়া চায়। ধুলা ছিটাইয়া থাকে তো বেশ করছে।’

কথাটা মিথ্যা নয়, চাউনিটা একটু তেরছা তেরছা মোতালেফের। বেছে বেছে সুন্দর মুখের দিকে তাকায়। সুন্দর মুখের খোঁজ করে ঘোরে তার চোখ। অল্প বয়সী খুবসুরত চেহারার একটি বউ আনবে ঘরে, এত দিন ধরে সেই চেষ্টাই সে করে এসেছে। কিন্তু দরে পটেনি কারো সঙ্গে। যারই ঘরে একটু ডাগর গোছের সুন্দর মেয়ে আছে সেই হেঁকে বসেছে পাঁচ কুড়ি-সাত কুড়ি। মোতালেফের সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল ফুলবানুকে।

চরকান্দার এলেম সেখের মেয়ে ফুলবানু। আঠারো-উনিশ বছর হবে বয়স। রসে টলটল করছে সর্বাঙ্গ, টগবগ করছে মন। ইতিমধ্যে অবশ্য এক হাত ঘুরে এসেছে ফুলবানু। খেতে-পরতে কষ্ট দেয়, মারধর করে—এই সব অজুহাতে তালাক নিয়ে এসেছে কইডুবির গফুর সিকদারের কাছ থেকে। আসলে বয়স বেশি আর চেহারা সুন্দর নয় বলে গফুরকে পছন্দ হয়নি ফুলবানুর। সেই জন্যই ইচ্ছা করে নিজে ঝগড়া-কোন্দল বাধিয়েছে তার সঙ্গে। কিন্তু এক হাত ঘুরে এসেছে বলে কিছু ক্ষয়ে যায়নি ফুলবানুর, বরং চেকনাই আর জেল্লা খুলেছে দেহের, রসের ঢেউ খেলে যাচ্ছে মনের মধ্যে। চরকান্দায় নদীর ঘাটে ফুলবানুকে একদিন দেখেছিল মোতালেফ। একনজরেই বুঝেছিল যে সেও নজরে পড়েছে। চেহারাখানা তো বেমানান নয় মোতালেফের। নীল লুঙ্গি পরলে ফরসা ছিপছিপে চেহারায় চমৎকার খোলতাই হয় তার, তা ছাড়া এমন ঢেউ-খেলানো টেরিকাটা বাবরিই বা এ তল্লাটে কজনের মাথায় আছে। ফুলবানুর সুনজরের কথা বুঝতে বাকি ছিল না মোতালেফের। খুঁজে খুঁজে গিয়েছিল সে এলেম সেখের বাড়িতে। কিন্তু এলেম তাকে আমল দেয়নি। বলেছে, গতবার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে তার। এবার আর না দেখে-শুনে যার-তার হাতে মেয়ে দেবে না। আসলে টাকা চায় এলেম। গাঁটের কড়ি যা খরচ করতে হয়েছে মেয়েকে তালাক নেওয়াতে গিয়ে, সুদে-আসলে তা পুরিয়ে নিতে চায়। গুনাগার চায় সেই লোকসানের। আঁচ নিয়ে দেখেছে মোতালেফ সে গুনাগার দু-এক কুড়ি নয়, পাঁচ কুড়ি একেবারে। তার কমে কিছুতেই রাজি হবে না এলেম। কিন্তু অত টাকা সে দেবে কোত্থেকে।

মুখ ভার করে চলে আসছিল মোতালেফ। আশ্শেওড়া আর চোখ-উদানের আগাছার জঙ্গলা ভিটার মধ্যে ফের দেখা হলো ফুলবানুর সঙ্গে। কলসি কাঁকে জল নিতে চলেছে ঘাটে। মোতালেফ বুঝল সময় বুঝেই দরকার পড়েছে তার জলের।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিক করে একটু হাসল ফুলবানু, ‘কী মেঞা, গোসা কইরা ফিরা চললা নাকি?’
‘চলব না? শোনলা নি টাকার খাককাই তোমার বাজানের!’
ফুলবানু বলল, ‘হ, হ, শুনছি। চাইছে তো দোষ হইছে কি? পছন্দসই জিনিস নেবা বাজানের গুনা, তার দাম দেবা না?’
মোতালেফ বলল, ‘ও খাককাইটা আসলে বাজানের নয়, বাজানের মাইয়ার। হাটে-বাজারে গেলেই পারো ধামায় উইঠা।’
মোতালেফের রাগ দেখে হাসল ফুলবানু, ‘কেবল ধামায় ক্যান, পালায় উইঠা বসব। মুঠ ভইরা ভইরা সোনা-জহরত ওজন কইরা দেবা পালায়। বোঝব ক্ষেমতা, বোঝব কেমন পুরুষ মাইনষের মুঠ।’ মোতালেফ হনহন করে চলে যাচ্ছিল। ফুলবানু ফের ডাকল পিছন থেকে, ‘ও সোন্দর মিঞা, রাগ করলানি? শোন শোন।’
মোতালেফ ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘কী শুনব?’

এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে আরো একটু এগিয়ে এলো ফুলবানু, ‘শোনবা আবার কী, শোনবা মনের কথা। শোন, বাজানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনা-দানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনষের ত্যাগ দেখতে চায়, বুঝছ?’
মোতালেফ ঘাড় নেড়ে জানাল, বুঝেছে।
ফুলবানু বলল, ‘তাই বইলা আকাম-কুকাম কইরো না মেঞা, জমি ক্ষেত বেচতে যাইও না।’

বেচবার মতো জমি ক্ষেত অবশ্য মোতালেফের নেই, কিন্তু সে গুমর ফুলবানুর কাছে ভাঙল না মোতালেফ, বলল, ‘আইচ্ছা, শীতের কয়ডা মাস যাউক, ত্যাগও দেখাব, মানও দেখাব। কিন্তু বিবিজানের সবুর থাকবেনি দেখবার?’

ফুলবানু হেসে বলল, ‘খুব থাকব। তেমন বেসবুর বিবি ভাইবো না আমারে।’

গায়ে এসে আর একবার ধারের চেষ্টা করে দেখল মোতালেফ। গেল মলি্লকবাড়ি, মুখজ্যেবাড়ি, সিকদারবাড়ি, মুন্সীবাড়ি—কিন্তু কোথাও সুরাহা হয়ে উঠল না টাকার। নিলে তো আর সহজে হাত উপুড় করবার অভ্যেস নেই মোতালেফের। ধারের টাকা তার কাছ থেকে আদায় করে নিতে বেজায় ঝামেলা। সাধ করে কে পোয়াতে যাবে সেই ঝক্কি।

কিন্তু নগদ টাকা ধার না পেলেও শীতের সূচনাতেই পাড়ার চার-পাঁচ কুড়ি খেজুর গাছের বন্দোবস্ত পেল মোতালেফ। গত বছর থেকেই গাছের সংখ্যা বাড়ছিল, এবার চৌধুরীদের বাগানের দেড় কুড়ি গাছ বেশি হলো। গাছ কেটে হাঁড়ি পেতে রস নামিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক রস মালিকের, অর্ধেক তার। মেহনত কম নয়, এক একটি করে এতগুলো গাছের শুকনো মরা ডালগুলো বেছে বেছে আগে কেটে ফেলতে হবে। বালিকাচায় ধার তুলে তুলে জুতসই করে নিতে হবে ছ্যান। তারপর সেই ধারালো ছ্যানে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে তার মধ্যে নল পুঁততে হবে সরু কঞ্চি ফেড়ে। সেই নলের মুখে লাগসই করে বাঁধতে হবে মেটে হাঁড়ি। তবে তো রাতভরে টুপ টুপ করে রস পড়বে সেই হাঁড়িতে। অনেক খাটুনি, অনেক খেজমত। শুকনো শক্ত খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে হলে আগে ঘাম বের করতে হয় গায়ের। এ তো আর মায়ের দুধ নয়, গাইয়ের দুধ নয় যে বোঁটায়-বানে মুখ দিলেই হলো।

অবশ্য কেবল খাটতে জানলেই হয় না, গাছে উঠতে-নামতে জানলেই হয় না, গুণ থাকা চাই হাতের। যে ধারালো ছ্যান একটু চামড়ায় লাগলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে মানুষের গা থেকে, হাতের গুণে সেই ছ্যানের ছোঁয়ায় খেজুর গাছের ভেতর থেকে মিষ্টি রস চুইয়ে পড়ে। এ তো আর ধান কাটা নয়, পাট কাটা নয় যে কাঁচির পোঁচে গাছের গোড়াসুদ্ধ কেটে নিলেই হলো। এর নাম খেজুর গাছ কাটা। কাটতেও হবে, আবার হাত বুলোতেও হবে। খেয়াল রাখতে হবে গাছ যেন ব্যথা না পায়, যেন কোনো ক্ষতি না হয় গাছের। একটু এদিক-ওদিক হলে বছর ঘুরতে না ঘুরতে গাছের দফারফা হয়ে যাবে, মরা মুখ দেখতে হবে গাছের। সে গাছের গুঁড়িতে ঘাটের পৈঠা হবে, ঘরের পৈঠা হবে, কিন্তু ফোঁটায় ফোঁটায় সে গাছ থেকে হাঁড়ির মধ্যে রস ঝরবে না রাতভরে।

খেজুর গাছ থেকে রস নামাবার বিদ্যা মোতালেফকে নিজ হাতে শিখিয়েছিল রাজেক মৃধা। রস সম্বন্ধে এসব তত্ত্বকথা আর বিধিনিষেধও তার মুখের। রাজেকের মতো অমন নামডাকওয়ালা ‘গাছি’ ধারে-কাছে ছিল না। যে গাছের প্রায় বারো আনা ডালই শুকিয়ে এসেছে, সে গাছ থেকেও রস বেরুত রাজেকের হাতের ছোঁয়ায়। অন্য কেউ গাছ কাটলে যে গাছ থেকে রস পড়ত আধ-হাঁড়ি, রাজেকের হাতে পড়লে সে রস গলা-হাঁড়িতে উঠত। তার হাতে খেজুর গাছ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত গৃহস্থরা। গাছের কোনো ক্ষতি হতো না, রসও পড়ত হাঁড়ি ভরে। বছর কয়েক ধরে রাজেকের শাগরেদ হয়েছিল মোতালেফ, পিছনে পিছনে ঘুরত, কাজ করত সঙ্গে সঙ্গে। শাগরেদ দু-চারজন আরো ছিল রাজেকের—সিকদারদের মকবুল, কাজীদের ইসমাইল। কিন্তু মোতালেফের মতো হাত পাকেনি কারো। রাজেকের স্থান আর কেউ নিতে পারেনি তার মতো।

কিন্তু কেবল গাছ কাটলেই তো হবে না কুড়িতে কুড়িতে, রসের হাঁড়ি বয়ে আনলেই তো হবে না বাঁশের বাখারির ভারায় ঝুলিয়ে, রস জ্বাল দিয়ে গুড় করবার মতো মানুষ চাই। পুরুষ মানুষ গাছ থেকে কেবল রসই পেড়ে আনতে পারে, কিন্তু উনান কেটে, জ্বালানি জোগাড় করে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে বসে সেই তরল রস জ্বাল দিয়ে তাকে ঘন পাটালি গুড়ে পরিণত করবার ভার মেয়েমানুষের ওপর। শুধু কাঁচা রস দিয়ে তো লাভ নেই, রস থেকে গুড় আর গুড় থেকে পয়সায় কাঁচা রস যখন পাকা রূপ নেবে তখন সিদ্ধি, কেবল তখনই সার্থক হবে সকল খেজমত, মেহনত। কিন্তু বছর দুই ধরে বাড়িতে সেই মানুষ নেই মোতালেফের। ছেলেবেলায় মা মরেছিল। দুই বছর আগে বউ মরে ঘর একেবারে খালি করে দিয়ে গেছে।

সন্ধ্যার পর মোতালেফ এসে দাঁড়াল মাজু খাতুনের ঝাঁপ-আঁটা ঘরের সামনে, ‘জাগনো আছো নাকি মাজু বিবি?’
ঘরের ভেতর থেকে মাজু খাতুন সাড়া দিয়ে বলল, ‘কেডা?’

‘আমি মোতালেফ। শুইয়া পড়ছি বুঝি? কষ্ট কইরা উইঠা যদি ঝাঁপটা একবার খুইলা দিতা, কয়ডা কথা কইতাম তোমার সাথে।’

মাজু খাতুন উঠে ঝাঁপ খুলে দিয়ে বলল, ‘কথা যে কী কবা তা তো জানি। রসের কাল আইছে আর মনে পইড়া গেছে মাজু খাতুনরে। রস জ্বাল দিয়া দিতে হবে। কিন্তু সেরে চাইর আনা কইরা পয়সা দেবা মেঞা। তার কমে পারব না। গতরে সুখ নাই এ বছর।’

মোতালেফ মিষ্টি করে বলল, ‘গতরের আর দোষ কী বিবি। গতর তো মনের হাত ধইরা ধইরা চলে। মনের সুখই গতরের সুখ।’
মাজু খাতুন বলল, ‘তা যাই কও তাই কও মেঞা, চাইর আনার কমে পারব না এবার।’

মোতালেফ এবার মধুর ভঙ্গিতে হাসল, ‘চাইর আনা ক্যান বিবি, যদি ষোলো আনা দিতে চাই, রাজি হবা তো নিতে?’
মোতালেফের হাসির ভঙ্গিতে মাজু খাতুনের বুকের মধ্যে একটু যেন কেমন করে উঠল, কিন্তু মুখে বলল, ‘তোমার রঙ্গ তামাশা থুইয়া দাও মেঞা। কাজের কথা কবা তো কও, নইলে যাই, শুই গিয়া।’
মোতালেফ বলল, ‘শোবাই তো। রাইত তো শুইয়া ঘুমাবার জন্যেই। কিন্তু শুইলেই কি আর চোখে ঘুম আসে মাজু বিবি, না চাইয়া চাইয়া এই শীতের লম্বা রাইত কাটান যায়?’

ইশারা-ইঙ্গিত রেখে এরপর মোতালেফ আরো স্পষ্ট করে খুলে বলল মনের কথা। কোনো রকম অন্যায় সুবিধা-সুযোগ নিতে চায় না সে। মোল্লা ডেকে কলমা পড়ে সে নিকা করে নিয়ে যেতে চায় মাজু খাতুনকে। ঘর-গেরস্তালির ষোলো আনা ভার তুলে দিতে চায় তার হাতে।

প্রস্তাব শুনে মাজু খাতুন প্রথমে অবাক হয়ে গেল, তারপর একটু ধমকের সুরে বলল, ‘রঙ্গ তামাশার আর মানুষ পাইলা না তুমি! ক্যান, কাঁচা বয়সের মাইয়াপোলার কি অভাব হইছে নাকি দেশে যে তাগো থুইয়া তুমি আসবা আমার দুয়ারে!’

মোতালেফ বলল, ‘অভাব হবে ক্যান মাজু বিবি। কম বয়সী মাইয়াপোলা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু শত হইলেও তারা কাঁচা রসের হাঁড়ি।’

কথার ভঙ্গিতে একটু কৌতুক বোধ করল মাজু খাতুন, বলল, ‘সাঁচাই নাকি! আর আমি?’
‘তোমার কথা আলাদা। তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাশতার কালে গুড়, তোমার সাথে তাগো তুলনা?’

তখনকার মতো মোতালেফকে বিদায় দিলেও তার কথাগুলো মাজু খাতুনের মন থেকে সহজে বিদায় নিতে চাইল না। অন্ধকার নিঃসঙ্গ শয্যায় মোতালেফের কথাগুলো মনের ভেতরটায় কেবলই তোলপাড় করতে লাগল। মোতালেফের সঙ্গে পরিচয় অল্প দিনের নয়। রাজেক যখন বেঁচে ছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে থেকে যখন কাজকর্ম করত মোতালেফ, তখন থেকেই এ বাড়িতে তার আনাগোনা, তখন থেকেই জানাশোনা দুজনের। কিন্তু সেই জানাশোনার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। মাঝে মাঝে একটু হালকা ঠাট্টা-তামাশা চলত, কিন্তু তার বেশি এগুবার কথা মনেই পড়েনি কারো। মোতালেফের ঘরে ছিল বউ, মাজু খাতুনের ঘরে ছিল স্বামী। স্বভাবটা একটু কঠিন আর কাঠখোট্টা ধরনেরই ছিল রাজেকের। ভারি কড়া-কড়া চাঁছাছোলা ছিল তার কথাবার্তা। শীতের সময় কুড়িতে কুড়িতে রসের হাঁড়ি আনত মাজু খাতুনের উঠানে আর মাজু খাতুন সেই রস জ্বাল দিয়ে করত পাটালি গুড়। হাতের গুণ ছিল মাজু খাতুনের। তার তৈরি গুড়ের সের দুই পয়সা বেশি দরে বিক্রি হতো বাজারে। রাজেক মরে যাওয়ার পর পাড়ার বেশির ভাগ খেজুর গাছই গেছে মোতালেফের হাতে। দু-এক হাঁড়ি রস কোনোবার ভদ্রতা করে তাকে খেতে দেয় মোতালেফ, কিন্তু আগেকার মতো হাঁড়িতে আর ভরে যায় না তার উঠান। গতবার মাসখানেক তাকে রস জ্বাল দিতে দিয়েছিল মোতালেফ। চুক্তি ছিল দুই আনা করে পয়সা দেবে প্রতি সেরে, কিন্তু মাসখানেক পরেই সন্দেহ হয়েছিল মোতালেফের মাজু খাতুন গুড় চুরি করে রাখছে, অন্য কাউকে দিয়ে গোপনে গোপনে বিক্রি করাচ্ছে সেই গুড়, ষোলো আনা জিনিস পাচ্ছে না মোতালেফ। ফলে কথান্তর মনান্তর হয়ে সে বন্দোবস্ত ভেস্তে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তার ঘরে রসের হাঁড়ি পাঠাবার প্রস্তাব নিয়ে আসেনি মোতালেফ, মাজু খাতুনকেই নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছে। এমন প্রস্তাব পাড়ার আধ-বুড়োদের দলের আরো করেছে দু-একজন কিন্তু মাজু খাতুন কান দেয়নি তাদের কথায়। ছেলে ছোকরাদের মধ্যে যারা একটু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের ইয়ার্কি দিতে এসেছে, তাদের কান কেটে নেওয়ার ভয় দেখিয়েছে মাজু খাতুন। কিন্তু মোতালেফের প্রস্তাব সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তাকে যেন তেমনভাবে তাড়ান যায় না। তাকে তাড়ালেও তার কথাগুলো ফিরে ফিরে আসতে থাকে মনের মধ্যে। পাড়ায় এমন চমৎকার কথা বলতে পারে না আর কেউ, অমন খুবসুরত মুখ কারোও নেই, অমন মানানসই কথাও নেই কারো মুখে।

মোতালেফকে আরো আসতে হলো দু-এক সন্ধ্যা, তারপর নীল রঙের জোলাকী শাড়ি পরে, রং-বেরঙের কাঁচের চুড়ি হাতে দিয়ে মোতালেফের পিছনে পিছনে তার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল মাজু খাতুন।

ঘরদোরের কোনো শ্রী-ছাঁদ নেই, ভারি অপরিষ্কার আর অগোছাল হয়ে রয়েছে সব। কোমরে আঁচল জড়িয়ে মাজু খাতুন লেগে গেল ঘরকন্নার কাজে। ঝাঁট দিয়ে দিয়ে জঞ্জাল দূর করল উঠানের, লেপেপুঁছে ঝকঝকে, তকতকে করে তুলল ঘরের মেঝে।

কিন্তু ঘর আর ঘরনির দিকে তাকাবার সময় নেই মোতালেফের, সে আছে গাছে গাছে। পাড়ায় আরো অনেকের—বোসেদের, বাঁডুজ্যেদের গাছের বন্দোবস্ত নিয়েছে মোতালেফ। গাছ কাটছে, হাঁড়ি পাতছে, হাঁড়ি নামাচ্ছে, ভাগ করে দিচ্ছে রস। পাঁকাটির একখানা চালা তুলে দিয়েছে মাজু খাতুনকে মোতালেফ উঠানের পশ্চিম দিকে। সারে সারে উনান কেটে তার ওপর বড় বড় মাটির জ্বালা বসিয়ে সেই চালাঘরের মধ্যে বসে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রস জ্বাল দেয় মাজু খাতুন। জ্বালানির জন্যে মাঠ থেকে খড়ের নাড়া নিয়ে আসে মোতালেফ, জোগাড় করে আনে খেজুরের শুকনো ডাল। কিন্তু তাতে কি কুলোয়? মাজু খাতুন এর-ওর বাগান থেকে জঙ্গল থেকে শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে আনে ঝাঁকা ভরে ভরে, পলো ভরে ভরে, বিকেলে বসে বসে দা দিয়ে টুকরো টুকরো করে শুকনো ডাল কাটে জ্বালানির জন্যে। বিরাম নেই বিশ্রাম নেই, খাটুনি গায়ে লাগে না, অনেক দিন পরে মনের মতো কাজ পেয়েছে মাজু খাতুন, মনের মতো মানুষ পেয়েছে ঘরে।

ধামা ভরে ভরে হাটে-বাজারে গুড় নিয়ে যায় মোতালেফ, বিক্রি করে আসে চড়া দামে! বাজারের মধ্যে সেরা গুড় তার। পড়ন্ত বেলায় ফের যায় গাছে গাছে হাঁড়ি পাততে। তল্লাবাঁশের একেকটি করে চোঙা ঝুলতে থাকে গাছে। সকালে রসের হাঁড়ি নামিয়ে ঝরার চোঙা বেঁধে দিয়ে যায় মোতালেফ। সারা দিনের ময়লা রস চোঙাগুলোর মধ্যে জমা থাকে। চোঙা বদলে গাছ চেঁছে হাঁড়ি পাতে বিকেলে এসে। চোঙার ময়লা রস ফেলা যায় না। জ্বাল দিয়ে চিটে গুড় হয় তাতে তামাক মাখবার। বাজারে তাও বিক্রি হয় পাঁচ আনা ছয় আনা সের। দুবেলা দুবার করে এতগুলো গাছে উঠতে-নামতে ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ে মোতালেফের, পৌষের শীতেও সর্বাঙ্গ দিয়ে ঘাম ঝরে চুইয়ে চুইয়ে। সকালবেলায় রোমশ বুকের মধ্যে ঘামের ফোঁটা চিকচিক করে। পায়ের নিচে দূর্বার মধ্যে চিকচিক করে রাত্রির জমা শিশির। মোতালেফের দিকে তাকিয়ে পাড়া-পড়শিরা অবাক হয়ে যায়। চিরকালই অবশ্য খাটিয়ে মানুষ মোতালেফ, কিন্তু বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে, দিনরাত এমন কলের মতো পরিশ্রম করতে এর আগে তাকে দেখা যায়নি কোনো দিন। ব্যাপারটা কী? গাছ কাটা অবশ্য মনের মতো কাজই মোতালেফের, কিন্তু পছন্দসই মনের মানুষ কি সত্যিই এলো ঘরে?

সেরা গাছের সবচেয়ে মিষ্টি দুই হাঁড়ি রস আর সের তিনেক পাটালি গুড় নিয়ে মোতালেফ গিয়ে একদিন উপস্থিত হলো চরকান্দায় এলেম সেখের বাড়িতে। সেলাম জানিয়ে এলেমের পায়ের সামনে নামিয়ে রাখল রসের হাঁড়ি, গুড়ের সাজি, তারপর কোঁচার খুঁটের বাঁধন খুলে বের করল পাঁচখানা দশ টাকার নোট, বলল, ‘অর্ধেক আগাম দিলাম মেঞাসাব।’

এলেম বলল, ‘আগাম কিসের?’
মোতালেফ বলল, ‘আপনার মাইয়ার—’

তাজা করকরে নোট বেছে নিয়ে এসেছে মোতালেফ। কোনায়, কিনারে চুল পরিমাণ ছিঁড়ে যায়নি কোথাও, কোনো জায়গায় ছাপ লাগেনি ময়লা হাতের। নগদ পঞ্চাশ টাকা। নোটগুলোর ওপর হাত বুলোতে বুলোতে এলেম বলল, ‘কিন্তু এখন আর টাকা আগাম নিয়া আমি কী করব মেঞা? তুমি তো শোনলাম নেকা কইরা নিছ রাজেক মেরধার কবিলারে। সতীনের ঘরে যাবে ক্যান আমার মাইয়া। মাইয়া কি ঝগড়া আর চিল্লাচিলি্ল করবে, মারামারি-কাটাকাটি কইরা মরবে দিনরাইত।’

মোতালেফ মুচকে হাসল। বলল, ‘তার জৈন্যে ভাবেন ক্যান মেঞাসাব। গাছে রস যদ্দিন আছে, গায়ে শীত যদ্দিন আছে, মাজু খাতুনও তদ্দিন আছে আমার ঘরে। দক্ষিণা বাতাস খেললেই সব সাফ হইয়া যাবে উইড়া।’

এলেম সেখ জলচৌকি এগিয়ে দিল মোতালেফকে বসতে, হাতের হুঁকোটা এগিয়ে ধরল মোতালেফের দিকে, তারিফ করে বলল, ‘মগজের মধ্যে তোমার সাঁচাই জিনিস আছে মিঞা, সুখ আছে তোমার সাথে কথা কইয়া, কাম কইরা।’

ফুলবানুকেও একবার চোখের দেখা দেখে যেতে অনুমতি পেল মোতালেফ। আড়াল থেকে দেখতে-শুনতে ফুলবানুর কিছু বাকি ছিল না। তবু মোতালেফকে দেখে ঠোঁট ফুলালো ফুলবানু, ‘বেসবুর কেডা হইল মেঞা? এদিকে আমি রইলাম পথ চাইয়া তুমি ঘরে নিয়া ঢুকাইলা আর একজনারে।’

মোতালেফ জবাব দিল, ‘না ঢুকায়ে করি কী!’

মানের দায়ে জানের দায়ে বাধ্য হয়ে তাকে এই ফন্দি খুঁজতে হয়েছে। ঘরে কেউ না থাকলে পানি-চুনি দেয় কে, প্রাণ বাঁচে কী করে। ঘরে কেউ না থাকলে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে কে। আর সেই গুড় বিক্রি করে টাকা না আনলেই বা মান বাঁচে কী করে।
ফুলবানু বলল, ‘বোঝলাম, মানও বাঁচাইলা, জানও বাঁচাইলা, কিন্তু গায়ে যে আরেকজনের গন্ধ জড়াই রইল, তা ছাড়াবা কেমনে।’
মনে এলেও মুখ ফুটে এ কথাটা বলল না মোতালেফ যে মানুষ চলে গেলে তার গন্ধ সত্যিই আরেকজনের গায়ে জড়িয়ে থাকে না, তা যদি থাকত তাহলে সে গন্ধ তো ফুলবানুর গা থেকেও বেরুতে পারত। কিন্তু সে কথা চেপে গিয়ে মোতালেফ ঘুরিয়ে জবাব দিল, বলল, ‘গন্ধের জন্য ভাবনা কি ফুল বিবি। সোডা-সাবান কিনা দেব বাজার গুনা। ঘাটের পৈঠায় পা ঝুলাইয়া বসব তোমারে লইয়া। গতর গুনা ঘইসা ঘইসা বদ গন্ধ উঠাইয়া ফেইলো।’

মুখে আঁচল চাপতে চাপতে ফুলবানু বলল, ‘সাঁচাই নাকি?’

মোতালেফ বলল, ‘সাঁচা না ত কি মিছা? শুইঙ্গা দেইখো তখন নতুন মাইনষের নতুন গন্ধে ভুরভুর করবে গতর। দক্ষিণা বাতাসে চুলের গন্ধে ফুলের গন্ধে ভুরভুর করবে, কেবল সবুর কইরা থাকো আর দুইখান মাস।’

ফুলবানু আর একবার ভরসা দিয়ে বলল, ‘বেসবুর মানুষ ভাইবো না আমারে।’

যে কথা সেই কাজ মোতালেফের, দুই মাসের বেশি সবুর করতে হলো না ফুলবানুকে। গুড় বেচে আরো পঞ্চাশ টাকা জোগাড় হইতে মোতালেফ মাজু খাতুনকে তালাক দিল। কারণটাও সঙ্গে সঙ্গে পাড়া-পড়শিকে সাড়ম্বরে জানিয়ে দিল। মাজু বিবির স্বভাব-চরিত্র খারাপ। রাজেকের দাদা ওয়াহেদ মৃধার সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার ভারি আপত্তিকর।

মাজু খাতুন জিভ কেটে বলল, ‘আউ আউ ছি ছি! তোমার গতরই কেবল সোন্দর মোতিমেঞা, ভিতর সোন্দর না। এত শয়তানি, এত ছলচাতুরী তোমার মনে? গুড়ের সময় পিঁপড়ার মতো লাইগা ছিলা, আর গুড় যাই ফুরাইল অমনি দূর দূর!’

কিন্তু অত কথা শোনবার সময় নেই মোতালেফের; ধৈর্যও নেই।

আমের গাছ বোলে ভরে উঠল, গাবগাছের ডালে ডালে গজাল তামাটে রঙের কচি কচি নতুন পাতা। শীতের পরে এলো বসন্ত, মাজু খাতুনের পরে এলো ফুলবানু। ফুলের মতোই মুখ। ফুলের গন্ধ তার নিঃশ্বাসে। পাড়া-পড়শি বলল, ‘এবার মানাইছে, এবার সাঁচাই বাহার খোলছে ঘরের!’

ফুর্তির অন্ত নেই মোতালেফের মনে। দিনভর কিষান কামলা খাটে। তারপর সন্ধ্যা হতে না হতেই এসে আঁচল ধরে ফুলবানুর, ‘থুইয়া দাও তোমার রান্ধন-বাড়ন ঘরগেরস্তালি। কাছে বসো আইসা।’

ফুলবানু হাসে, ‘সবুর সবুর! এ কয় মাস কাটাইলা কী কইরা মেঞা?’
মোতালেফ জবাব দেয়, ‘খেজুর গাছ লইয়া।’
নিবিড় বাহুবেষ্টনের মধ্যে দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে ফুলবানুর, একটু নিঃশ্বাস নিয়ে হেসে বলে, ‘তুমি আবার সেই গাছের কাছেই ফিরা যাও। গাছির আদর গাছেই সইতে পারে।’

মোতালেফ বলে, ‘কিন্তু গাছির কাছেও যে গাছের রস দুই-চাইর মাসেই ফুরায় ফুলজান, কেবল তোমার রসই বছরে বারো মাস চোয়াইয়া চোয়াইয়া পড়ে।’

মাজু খাতুন ফের গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল রাজেকের পড়ো পড়ো শণের কুঁড়েয়। ভেবেছিল আগের মতোই দিন কাটবে। কিন্তু দিন যদিবা কাটে, রাত কাটে না। মোতালেফ তার সর্বনাশ করে ছেড়েছে। পাড়া-পড়শিরা এসে সাড়ম্বরে সালঙ্কারে মোতালেফ আর ফুলবানুর ঘরকন্নার বর্ণনা করে, একটু বা সকৌতুক তিরস্কারের সুরে বলে, ‘নাঃ বউ বউ কইরা পাগল হইয়া গেল মানুষটা। যেখানেই যায় বউ ছাড়া আর কথা নাই মুখে।’

বুকের ভেতরটা জ্বলে ওঠে মাজু খাতুনের। মনে হয় সেও বুঝি হিংসায় পাগল হয়ে যাবে। বুক ফেটে মরে যাবে সে।

দিন কয়েক পরে রাজেকের বড় ভাই ওয়াহেদই নিয়ে এলো সম্বন্ধ। বউটার দশা দেখে ভারি মায়া হয়েছে তার। নদীর ওপারে তালকান্দায় নাদির শেখের সঙ্গে দোস্তি আছে ওয়াহেদের। এক মাল্লাই নৌকা বায় নাদির। মাসখানেক আগে কলেরায় তার বউ মারা গেছে। অপোগণ্ড ছেলেমেয়ে রেখে গেছে অনেকগুলো। তাদের নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছে বেচারা। কম বয়সী ছুঁড়ি-টুড়িতে দরকার নেই তার। সে হয়তো পটের বিবি সেজে থাকবে, ছেলেমেয়ের যত্ন-আত্তি করবে না। তাই মাজু খাতুনের মতো একটু ভারিক্কি ধীরবুদ্ধি গৃহস্থঘরের বউই তার পছন্দ। তার ওপর নির্ভর করতে পারবে সে।

মাজু খাতুন জিজ্ঞেস করল, ‘বয়স কত হবে তার?’
ওয়াহেদ জবাব দিল, ‘তা আমাগো বয়সীই হবে। পঞ্চাশ, এক-পঞ্চাশ।’

মাজু খাতুন খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে জানাল—হ্যাঁ, ওই রকমই তার চাই। কম বয়সে তার আস্থা নেই। বিশ্বাস নেই যৌবনকে।
তারপর মাজু খাতুন জিজ্ঞেস করল, ‘গাছি না তো সে? খাজুর গাছ কাটতে যায় না তো শীতকালে?’

ওয়াহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘গাছ কাটতে যাবে ক্যান! ওসব কাম কোনো কালে জানে না সে। বর্ষাকালে নৌকা বায়, শীতকালে কিষান কামলা খাটে, ঘরামির কাজ করে। ক্যান বউ, গাছি ছাড়া, রসের ব্যাপারী ছাড়া কি তুমি নিকা বসবা না কারো সাথে?’

মাজু খাতুন ঠিক উল্টো জবাব দিল। রসের সঙ্গে কিছুমাত্র যার সম্পর্ক নেই, শীতকালের খেজুর গাছের ধারেকাছেও যে যায় না, নিকা যদি বসে মাজু খাতুন তার সঙ্গেই বসবে। রসের ব্যাপারে মাজু খাতুনের ঘেন্না ধরে গেছে।

ওয়াহেদ বলল, ‘তাহলে কথাবার্তা কই নাদিরের সাথে? সে বেশি করতে চায় না।’ মাজু খাতুন বলল, ‘দেরি কইরা কাম কী।’

দেরি বেশি হলোও না, সপ্তাহখানেকের মধ্যে কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গেল। নাদিরের সঙ্গে এক মাল্লাই নৌকায় গিয়ে উঠল মাজু খাতুন। পার হয়ে গেল নদী।

মোতালেফ স্ত্রীকে বলল, ‘আপদ গেল। পেত্নীর মতো ফাঁৎ ফাঁৎ নিঃশ্বাস ফেলত, চোখের ওপর শাপমন্যি করত দিনরাইত, তার হাতগুনা তো বাঁচলাম, কী কও ফুলজান?’
ফুলবানু হেসে বলল, ‘পেত্নীরে খুব ডরাও বুঝি মেঞা?’
মোতালেফ বলল, ‘না, এখন আর ডরাই না। পেত্নী তো ছুইটাই গেল। এখন চোখ মেললেই তো পরী। এখন ডরাই পরীরে।’
‘ক্যান, পরীরে আবার ডর কিসের তোমার?’
‘ডর নাই? পাখা মেইলা কখন উড়াল দেয় তার ঠিক কী!’
ফুলবানু বলল, ‘না মেঞা, পরীর আর উড়াল দেওয়ার সাধ নাই। সে তার পছন্দসই সব পাইয়া গেছে। এখন ঘরের মাইনষের পছন্দ আর নজরডা বরাবর এই রকম থাকলে হয়।’
মোতালেফ বলল, ‘চৌখ যদ্দিন আছে, নজরও তদ্দিন থাকবে।’

দিনরাত ভারি আদরে-তোয়াজে রাখল মোতালেফ বউকে। কোন মাছ খেতে ভালোবাসে ফুলবানু হাটে যাওয়ার আগে শুনে যায়, ট্যাঁকে পয়সা না থাকলে কারো কাছ থেকে পয়সা ধার করে কেনে সেই মাছ। ডিমটা, আনাজটা, তরকারিটা যখন যা পারে হাট-বাজার থেকে নিয়ে আসে মোতালেফ। ফি হাটে আনে পান সুপারি খয়ের মসলা।

ফুলবানু বলে, ‘অত পান আনো ক্যান, তুমি তো বেশি ভক্ত না পানের। দিনরাইত খালি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ তামাক টানো।’ মোতালেফ বলল, ‘পান আনি তোমার জৈন্যে। দিন ভইরা পান খাবা, খাইয়া খাইয়া ঠোঁট রাঙ্গাবা।’

ফুলবানু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘ক্যান, আমার ঠোঁট এমনে বুঝি রাঙ্গা না যে পান খাইয়া রাঙ্গাইতে হবে? আমি পান সাইজা দেই, তুমিই বরং দিনরাইত খাওয়া ধর। তামাক খাইয়া খাইয়া কালা হইয়া গেছে ঠোঁট, পানের রসে রাঙ্গাইয়া নেও।’

মোতালেফ হেসে বলল, ‘পুরুষ মাইনষের ঠোঁট তো ফুলজান কেবল পানের রসে রাঙ্গা হয় না, আর-একজনের পানখাওয়া-ঠোঁটের রস লাগে।’

নিজের ভুঁই ক্ষেত নেই মোতালেফের। মলি্লকদের, মুখুজ্যেদের কিছু কিছু জমি বর্গা চষে। কিন্তু ভালো কিষান বলে তেমন খ্যাতি নেই, জমির পরিমাণ, ফসলের পরিমাণ অন্য সকলের মতো নয়। সিকদারদের, মুন্সীদের জমিতে কিষান খাটে। পাট নিড়ায়, পাট কাটে, পাট জাগ দেয়, ধোয়, মেলে। ভারি খেজমত খাটুনি খাটে। ফরসা রং রোদে পুড়ে কালো হয়ে যায় মোতালেফের। বর্গা জমির পাট খুব বেশি ওঠে না উঠানে। সিকদাররা, মুন্সীরা নগদ টাকা দেয়। কেবল মলি্লক আর মুখুজ্যেদের বিঘেচারেক ভুঁইয়ের ভাগের ভাগ অর্ধেক জাগ-দেওয়া পাট নৌকা ভরে খালের ঘাটে এনে নামায় মোতালেফ। পাট ছাড়াতে ভারি উৎসাহ ফুলবানুর। কিন্তু মোতালেফ সহজে তাকে পাটে হাত দিতে দেয় না, বলে, ‘কষ্ট হবে, পচা গন্ধ হবে গায়।’

ফুলবানু বলে, ‘হইল তো বইয়া গেল, রউদে পুইড়া তুমি কালা কালা হইয়া গেলা, আর আমি পাট নিতে পারব না, কষ্ট হবে। কেমনতরো কথাই যে কও তুমি মেঞা।’

নিজেদের পাট তো বেশি নয়, পাঁকাটি পাওয়া যায় না। ফুলবানুর ইচ্ছা, অন্য বাড়ির জাগ দেওয়া পাটও সে ছাড়িয়ে দেয়। সেই ছাড়ানো পাটের পাটখড়িগুলো পাওয়া যাবে তাহলে। কিন্তু মোতালেফ রাজি নয় তাতে, অত কষ্ট বউকে সে করতে দেবে না।

আশ্বিনের শেষের দিকে আউশ ধান পাকে। অন্যের নৌকায় পরের জমিতে কিষান খাটতে যায় মোতালেফ। কোমর পর্যন্ত জলে নেমে ধান কাটে। আঁটিতে আঁটিতে ধান তুলতে থাকে নৌকায়। কিন্তু মোমিন, করিম, হামিদ, আজিজ—এদের সঙ্গে সমানে সমানে কাঁচি চলে না তার। হাত বড় ‘ধীরচ’ মোতালেফের, জলে ভারি কাতর মোতালেফ। একেক দিন পিঠে-বগলে জোঁক লেগে থাকে। ফুলবানু তুলে ফেলতে ফেলতে বলে, ‘জোঁকটাও ছাড়াইতে পারো না মেঞা, হাত তো ছিল সঙ্গে?’

মোতালেফ বলে, ‘ধান কাটার হাত দুইখান সাথেই ছিল, জোঁক ফেলাবার হাত থুইয়া গেছিলাম বাড়িতে।’
যেখানে যেখানে জোঁকে মুখ দিয়েছিল সেসব জায়গায় সযত্নে চুন লাগিয়ে দেয় ফুলবানু, আরো পাঁচজন কিষানের সঙ্গে ধান মলন দেয় মোতালেফ, দেউনি পায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ধামায় করে পৈঁকায় করে ধান নিয়ে আসে। ফুলবানু ধান রোদে দেয়, কুলোয় করে চিটা ঝেড়ে ফেলে ধান থেকে। মোতালেফ একেকবার বলে, ‘ভারি কষ্ট হয় বউ, না?’
ফুলবানু বলে, ‘হ, কষ্টে একেবারে মইরা গেলাম না! কার নাগাল কথা কও তুমি মেঞা। গেরস্ত ঘরের মাইয়া না আমি, না সাঁচাই আশমান গুনা নাইমা আইছি?’

বসন্ত যায়, বর্ষা যায়, কাটে আশ্বিন-কার্তিক, ঘুরে ঘুরে ফের আসে শীত। রসের দিন মোতালেফের বতরের দিন। কিন্তু শীতটা এবার যেন একটু বেশি দেরিতে এসেছে। তা হোক, আরো বেশি গাছের বন্দোবস্ত নিয়ে পুষিয়ে ফেলবে মোতালেফ। খেজুর গাছের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ে। এ কাজে নামডাক আছে মোতালেফের, এ কাজে গাঁয়ের মধ্যে সেই সেরা। এবারেও বাঁডুজ্যেদের কুড়িদেড়েক গাছ বেড়ে গেল।

গাছ কাটাবার ধুম লেগে গেছে। একটুও বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই মোতালেফের, সময় নেই তেমন ফুলবানুর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি রঙ্গরসিকতার। ধার-দেনা শোধ দিতে হবে, সারা বছরের রসদ জোগাড় করতে হবে রস বেচে, গুড় বেচে। দৈত্যের মতো দিনভর খাটে মোতালেফ, আর বিছানায় গা দিতে না দিতেই ঘুম ভেঙে আসে চোখ। দুহাতে ঠেলে, দুহাত জড়িয়ে ধরে ফুলবানু, কিন্তু মানুষকে নয়, যেন আস্তা একটা গাছকে জড়িয়ে ধরেছে। অসাড়ে ঘুমোয় মোতালেফ। শব্দ বোরোয় নাক থেকে, আর কোনো অঙ্গ সাড়া দেয় না। মোটা কাঁথার মধ্যেও শীতে কাঁপে ফুলবানু। মানুষের গায়ের গরম না পেলে, এত শীত কি কাঁথায় মানে?

কেবল রস আনলেই হয় না, রস জ্বাল দেওয়ার জ্বালানি চাই। এখান থেকে, ওখান থেকে শুকনো ডালপাতা আর খড় বয়ে আনে মোতালেফ। ফুলবানুকে বলে, ‘রস জ্বাল দেও—যেমন মিঠা হাত, তেমন মিঠা গুড় বানান চাই, সেরা আর সরেস জিনিস হওয়া চাই বাজারের।’

কিন্তু হাঁড়িতে হাঁড়িতে রসের পরিমাণ দেখে মুখ শুকিয়ে যায় ফুলবানুর, বুক কাঁপে। দু-এক হাঁড়ি রস জ্বাল দিয়েছে সে বাপের বাড়িতে, কিন্তু এত রস একসঙ্গে সে কোনো দিন দেখেনি, কোনোকালে জ্বাল দেয়নি।

মোতালেফ তার ভঙ্গি দেখে হেসে বলে, ‘ভয় কী, আমি তো আছিই কাছে কাছে—আমারে পুছ কইরো, আমি কইয়া কইয়া দেব। মনের মইধ্যে যেমন টগবগ করে রস, জালার মধ্যেও তেমন করা চাই।’

কিন্তু উনানের কাছে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে বসে মনের রস শুকিয়ে আসে ফুলবানুর, নিবু নিবু করে উনানের আগুন, তেমন করে টগবগ করে না জালার রস। সারা দুপুর উনানের ধারে বসে বসে চোখ-মুখ শুকিয়ে আসে ফুলবানুর, রূপ ঝলসে যায়, তবু গুড় হয় না পছন্দমতো। কেমন যেন নরম নরম থাকে পাটালি, কোনো দিন বা পুড়ে তেতো হয়ে যায়।

মোতালেফ রুক্ষস্বরে বলে, ‘কেমনতরো মাইয়া মানুষ তুমি, এত কইরা কইয়া দেই, বুঝাইলে বোঝ না। এই গুড় হইছে, এই নি খইদ্দারে কেনবে পয়সা দিয়া?’

ফুলবানু একটু হাসতে চেষ্টা করে বলে, ‘কেনবে না ক্যান। বেচতে জানলেই কেনবে।’
মোতালেফ খুশি হয় না হাসিতে বলে, ‘তাইলে তুমি যাইয়া ধামা লইয়া বইসো বাজারে। তুমি আইসো বেইচা। খুবসুরত মুখের দিকে চাইয়া যদি কেনে, গুড়ের দিকে চাইয়া কেনবে না।’

বোকা তো নয় ফুলবানু, অকেজো তো নয় একেবারে। বলতে বলতে শেখাতে শেখাতে দু-চার দিনের মধ্যেই কোনো রকমে চলনসই গুড় তৈরি করতে শিখল ফুলবানু, বাজারে গুড় একেবারে অচল রইল না। কিন্তু দর ওঠে না গতবারের মতো, খদ্দেররা তেমন খুশি হয় না দেখে।

পুরনো খদ্দেররা একবার গুড়ের দিকে চায় আর একবার মুখের দিকে চায় মোতালেফের, ‘এ তোমার কেমনতরো গুড় হইল মিঞা? গত হাটে নিয়া দেখলাম গেল বছরের মতো সোয়াদ পাইলাম না। গেলবারও তো গুড় খাইছি তোমার, জিহ্বায় যেন জড়াইয়া রইছে, আস্বাদ ঠোঁটে লাইগা রইছে। এবার তো তেমন হইল না। তোমার গুড়ের থিকা এবার ছদন শেখ, মদন সিকদারের গুড়ের সোয়াদ বেশি।’

বুকের ভেতর পুড়ে যায় মোতালেফের, রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে। গতবারের মতো এবার স্বাদ হচ্ছে না মোতালেফের গুড়ে। কেন, সে তো কম খাটছে না, কম পরিশ্রম করছে না গতবারের চেয়ে। তবু কেন স্বাদ হচ্ছে না মোতালেফের গুড়ে, তবু কেন দর উঠছে না, লোকে দেখে খুশি হচ্ছে না, খেয়ে খুশি হচ্ছে না, গুড়ের সুখ্যাতি করছে না তার। অত নিন্দামন্দ শুনতে হচ্ছে কেন, কিসের জন্যে?

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রস জ্বাল দেওয়ার কৌশলটা আরো বারকয়েক মোতালেফ বলল ফুলবানুকে, ‘হাতায় কইরা কইরা ফোঁটা দেইখো নামাবার সময় হইল কি না, ডালবার সময় হইল কি না রস।’
ফুলবানু বিরক্ত বিরস মুখে বলে, ‘হ হ, চিনছি। আর বক বক কইরো না, ঘুমাইতে দেও মাইনষেরে।’
হঠাৎ মোতালেফের মনে পড়ে গেল মাজু খাতুনের কথা। রাত্রে শুয়ে শুয়ে রস আর গুড়ের কত আলোচনা করেছে তার সঙ্গে মোতালেফ। মাজু খাতুন এমন করে মুখ ঝামটা দেয়নি, অস্বস্তি জানায়নি ঘুমের ব্যাঘাতের জন্যে, সাগ্রহে শুনেছে, সানন্দে কথা বলেছে।

পরদিন বেলা প্রায় দুপুর নাগাদ কোত্থেকে একবোঝা জ্বালানি মাথায় করে নিয়ে এলো মোতালেফ, এনে রাখল সেই পাঁকাটির চালার দোরের কাছে, ‘কী রকম গুড় হইতেছে আইজ ফুলজান?’

কিন্তু চালার ভেতর থেকে কোনো জবাব এলো না ফুলবানুর। আরো একবার ডেকে সাড়া না পেয়ে বিস্মিত হয়ে চালার ভেতর মুখ বাড়াল মোতালেফ, কিন্তু ফুলবানুকে সেখানে দেখা গেল না। কী রকম গন্ধ আসছে যেন ভেতর থেকে, জালার মধ্যে ধরে গেল নাকি গুড়? সারে সারে গোটা পাঁচেক জালায় রস জ্বাল হচ্ছে, টগবগ করছে রস জালার মধ্যে। মুখ বাড়িয়ে দেখতে এগিয়ে গেল মোতালেফ। যা ভেবেছে ঠিক তা-ই। সবচেয়ে দক্ষিণ কোণের জালাটার রস বেশি জ্বাল পেয়ে কী করে যেন ধরে গেছে একটু। পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে ভেতর থেকে। বুকের মধ্যে জালাপোড়া করে উঠল মোতালেফের, গলা চিরে চিৎকার বেরুল—’কই, কোথায় গেলি হারামজাদি?’

ব্যস্ত হয়ে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ফুলবানু। বেলা বেশি হয়ে যাওয়ায় দুই দিন ধরে স্নান করতে পারেনি। শীতের দিন না নাইলে গা কেমন চড়চড় করে, ভালো লাগে না। তাই আজ একটু সোডা-সাবান মেখে ঘাট থেকে সকাল সকাল স্নান করে এসেছে। নেয়ে এসে পরেছে নীল রঙের শাড়ি। গামছায় চুল নিংড়ে তাতে তাড়াতাড়ি একটু চিরুনি বুলিয়ে নিচ্ছিল ফুলবানু, মোতালেফের চিৎকার শুনে ত্রস্তে চিরুনি হাতেই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ভিজে চুল লুটিয়ে রইল পিঠের ওপর। এক মুহূর্ত জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল মোতালেফ, তারপর ছুটে গিয়ে মুঠি করে ধরল সেই ভিজে চুলের রাশ, ‘হারামজাদি, গুড় পুইড়া গেল সেদিকে খেয়াল নাই তোমার, তুমি আছ সাজগোজ লইয়া, পটের ভিতর গুনা বাইরাইয়া আইলা তুমি বিদ্যাধরী, এই জৈন্যই গুড় খারাপ হয় আমার, অপমান হয়, বদনামে দেশ ছাইয়া গেল তোমার জৈন্যে!’

ফুলবানু বলতে লাগল, ‘খবরদার, চুল ধইরো না তাই বইলা, গায়ে হাত দিও না।’
‘ও, হাতে মারলে মনে যায় বুঝি তোমার?’ পায়ের কাছ থেকে একটা ছিটা কঞ্চি তুলে নিয়ে তাই দিয়ে হাতে বুকে পিঠে মোতালেফ সপাসপ চালাতে লাগল ফুলবানুর সর্বাঙ্গে, বলল, ‘কঞ্চিতে মারলে তো আর মান যাবে না সেখের ঝির। হাতেই দোষ, কঞ্চিতে তো আর দোষ নাই।’
ভারি বদরাগী মানুষ মোতালেফ। যেমন বেসবুর বেবুঝ তার অনুরাগ, রাগও তেমনি প্রচণ্ড।

খবর পেয়ে এলেম সেখ এলো চরকান্দা থেকে। জামাইকে শাসালো, বকলো, ধমকালো, মেয়েকেও নিন্দামন্দ কম করল না।
ফুলবানু বলল, ‘আমারে লইয়া যাও বাজান তোমার সাথে—এমন গোঁয়ার মাইনষের ঘর করব না আমি।’

কিন্তু বুঝিয়ে-শুঝিয়ে এলেম রেখে গেল মেয়েকে। একটু আস্কারা দিলেই ফুলবানু পেয়ে বসবে, আবার তালাক নিতে চাইবে। কিন্তু গৃহস্থঘরে অমন বারবার অদলবদল আর ঘর-বদলানো কি চলে! তাতে কি মান-সম্মান থাকে সমাজের কাছে? একটু সবুর করলেই আবার মন নরম হয়ে আসবে মোতালেফের। দু দণ্ড পরেই আবার মিলমিশ হয়ে যাবে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটি। দিনে হয়, রাত্রে মেটে। তা নিয়ে আবার একটা ভাবনা।

মিটে গেল, খানিক বাদেই আবার যেচে আপস করল মোতালেফ। সেধেভেজে মান ভাঙাল ফুলবানুর। পরদিন ফের আবার উনানের পিঠে রস জ্বাল দিতে গিয়ে বসল ফুলবানু। দুপুরের পর ধামায় বয়ে গুড় নিয়ে চলল মোতালেফ হাটে। যাবার সময় বলল, ‘এই দুইটা মাস কাইটা গেলে কোনো রকমে তোমার কষ্ট সারে ফুলজান।’

ফুলবানু বলল, ‘কষ্ট আবার কী।’
কিন্তু কেবল মুখের কথা, কেবল যেন ভদ্রতার কথা। মনের কথা যেন ফুটে বেরোয় না দুজনের কারোরই মুখ দিয়ে। সে কথার ধরন আলাদা, ধ্বনি আলাদা; তা তো আর চিনতে বাকি নেই কারো। বলেও জানে, শোনেও জানে।

হাটের পর হাট যায়, রসের বতর প্রায় শেষ হয়ে আসে; গুড়ের খ্যাতি বাড়ে না মোতালেফের, দর চড়ে না; কিন্তু তা নিয়ে ফুলবানুর সঙ্গে বাড়ি এসে আর তর্ক-বিতর্ক করে না মোতালেফ, চুপ করে বসে হুঁকোয় তামাক টানে। খেজুর গাছ থেকে নল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ে হাঁড়ির মধ্যে। ভোরে গাছে উঠে রসভরা বড় বড় হাঁড়ি নামিয়ে আনে মোতালেফ, কিন্তু গত বছরের মতো যেন সুখ নেই মনে, ফুর্তি নেই। ঘামে এবারও সর্বাঙ্গ ভিজে যায়, কিন্তু শুকনো পাঁকাটির মতো খট খট করে মন, দুপুরের রোদের মতো খাঁ খাঁ করে। কোথাও ছিটাফোঁটা নেই রসের। রসের হাঁড়িতে ভরে যায় উঠান, রসবতী নারী ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তবু যেন মন ভরে না, কেমন যেন খালি খালি মনে হয় দুনিয়া।

একদিন হাটের মধ্যে দেখা হয়ে গেল নদীর পারের নাদির শেখের সঙ্গে।
‘সেলাম  মেঞাসাব।’
‘আলেকম আসলাম।’
মোতালেফ বলল, ‘ভালো তো সব, ছাওয়ালপান ভালো তো—?’

মাজু খাতুনের কথাটা মুখে এনেও আনতে পারল না মোতালেফ। নাদির একটু হেসে বলল, ‘হ মেঞা, ভালোই আছে সব। খোদার দয়ায় চইলা যাইতেছে কোনো রকম সকমে।’
মোতালেফ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ছাওলপানের জৈন্যে সের দুই-তিন গুড় লইয়া যান না মেঞা। ভালো গুড়।’
নাদির হেসে বলল, ‘ভালোই তো। আপনার গুড় তো কোনোকালে খারাপ হয় না।’
হঠাৎ ফস করে কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় মোতালেফের, ‘না মেঞা, সে দিনকাল আর নাই।’
অবাক হয়ে নাদির এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে মোতালেফের দিকে। এ কেমনতরো ব্যাপারী! গুড় বেচতে এসে নিজের গুড়ের নিন্দা কি কেউ নিজে করে?’

নাদির জিজ্ঞাসা করে, ‘কত কইরা দিতেছেন?’
‘দামের জৈন্যে কী? দুই সের গুড় দিলাম আপনার পোলাপানরে খাইতে। কয়ন জানি, চাচায় দিছে।’
নাদির ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘না না না, সে কি মেঞা, আপনার বেচবার জিনিস, দাম না দিয়া নেব ক্যান আমি।’
মোতালেফ বলে, ‘আইচ্ছা, নিয়া তো যায়ন আইজ, খাইয়া দ্যাখেন, দাম না হয় সামনের হাটে দিবেন।’

বলতে বলতে কথাগুলো যেন মুখে আটকে যায় মোতালেফের। এবারেও জিনিস কাটাবার জন্যে বলতে হয় এসব কথা, গুড়ের গুণপনার কথা ঘোষণা করতে হয় খদ্দেরের কাছে, কিন্তু মনে মনে জানে কথাগুলো কত মিথ্যা, পরের হাটে এসব খদ্দের আর পারতপক্ষে গুড় কিনবে না তার কাছ থেকে, ভিড় করবে না তার গুড়ের ধামার সামনে।

অনেক বলা-কওয়ায় এক সের গুড় কেবল বিনা দামে নিতে রাজি হয় নাদির, আর বাকি দুই সেরের পয়সা গুনে দেয় জোর করে মোতালেফের হাতের মধ্যে।
মাজু খাতুন সব শুনে আগুন হয়ে ওঠে রেগে, ‘ও গুড় ছাওয়ালপানরে খাওয়াইতে চাও খাওয়াও, কিন্তু আমি ও গুড় ছোঁব না হাত দিয়া, তেমন বাপের বিটি না আমি।’

এক হাট যায়, নাদির আর ঘেঁষে না মোতালেফের গুড়ের কাছে। মাজু খাতুন নিষেধ করে দিয়েছে নাদিরকে, ‘খবরদার, ওই মাইনষের সাথে যদি ফের খাতির নাতির করো, আমি চইলা যাব ঘরগুনা। রাইত পোহাইলে আমারে আর দেখতে পাবা না।’
মনে মনে মাজু খাতুনকে ভারি ভয় করে নাদির। কাজে-কর্মে সরেস, কথায়-বার্তায় বেশ, কিন্তু রাগলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না বিবির।

দিন কয়েক পরে একদিন ভোরবেলায় দুটি সেরা গাছের সবচেয়ে ভালো দুই হাঁড়ি রস নিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে খেয়া নৌকায় উঠে বসল মোতালেফ। ঝাপটানো কুলগাছটার পাশ দিয়ে ঢুকল গিয়ে নাদিরের উঠানে; ‘বাড়ি আছেন নাকি মেঞা?’

হুঁকো হাতে নাদির বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, ‘কেডা? ও আপনে? আসেন, আসেন। আবার রস নিয়া আইছেন ক্যান মেঞাসাব?’
মোতালেফকে আমন্ত্রণ জানাল বটে নাদির, কিন্তু মনে মনে ভারি শঙ্কিত হয়ে উঠল মাজু খাতুনের জন্য। যে মানুষের নাম-গন্ধ শুনতে পারে না বিবি, সেই মানুষ নিজে এসে সশরীরে হাজির হয়েছে। না জানি, কী কেলেঙ্কারিটাই ঘটায়।

যা ভেবেছে নাদির, তাই। বাখারির বেড়ার ফাঁক দিয়ে মোতালেফকে দেখতে পেয়েই স্বামীকে ঘরের ভেতর ডেকে নিল মাজু খাতুন, তারপর মোতালেফকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘যাইতে কও এ বাড়িগুনা, এখনই নাইমা যাইতে কও। একটুও কি সরম ভরম নাই মনের মইধ্যে? কোন মুখে উঠল আইসা এখানে?’

নাদির ফিসফিস করে বলে, ‘আস্তে, আস্তে—একটু গলা নামাইয়া কথা কও বিবি। শুনতে পাবে। মাইনষের বাড়ি মানুষ আইছে, অমন কইরা কথা কয় নাকি। কুকুর-বিড়ালডারেও তো অমন কইরা খেদায় না মাইনষে।’

মাজু খাতুন বলল, ‘তুমি বোঝবা না মিঞা, কুকুর-বিড়াল থিকাও অধম থাকে মানুষ, শয়তান থিকাও সাংঘাতিক হয়। পুছ করো, রস খাওয়াইয়াতে যে আইল আমারে, একটুও ভয়ডর নাই মনে, একটুও কি নাজসরম নাই?’

একটা কথাও মৃদুস্বরে বলছিল না মাজু খাতুন, তার সব কথাই কানে যাচ্ছিল মোতালেফের। কিন্তু আশ্চর্য, এত কঠিন, এত রূঢ় ভাষাও যেন তাকে ঠিক আঘাত করছিল না, বরং মনে হচ্ছিল এত নিন্দা-মন্দ, এত গালাগাল, তিরস্কারের মধ্যেও কোথায় যেন একটু মাধুর্য মিশে আছে; মাজু খাতুনের তীব্র কর্কশ গলার ভেতর থেকে আহত-বঞ্চিত নারীর অভিমানরুদ্ধ কণ্ঠের আমেজ আসছে যেন একটু একটু। ছ্যানের খোঁচায় নলের ভেতর দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রস।

দাওয়ায় উঠে রসের হাঁড়ি দুটি হাত থেকে মাটিতে নামিয়ে রেখে মোতালেফ নাদিরকে ডেকে বলল, ‘মেঞাসাব, শোনবেননি একটু?’
নাদির লজ্জিত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘বসেন মেঞা বসেন। ধরেন, তামাক খান।’

নাদিরের হাত থেকে হুঁকোটা হাত বাড়িয়ে নিল মোতালেফ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মুখ লাগিয়ে টানতে শুরু করল না, হুঁকোটা হাতেই ধরে রেখে নাদিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার হইয়া একটা কথা কন বিবিরে।’

নাদির বলল, ‘আপনেই কন না, দোষ কী তাতে।’
মোতালেফ বলল, ‘না, আপনেই কন, কথা কবার মুখ আমার নাই। কন যে মোতালেফ মেঞা খাওয়াবার জৈন্যে আনে নাই রস, সেইটুকু বুদ্ধি তার আছে।’
নাদির কিছু বলবার আগেই মাজু খাতুন ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠল, ‘তয় কিসের জৈন্যে আনছে?’

নাদিরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই জবাব দিল মোতালেফ, বলল, ‘কয়ন যে আনছে জ্বাল দিয়া দুই সের গুড় বানাইয়া দেওয়ার জৈন্যে। সেই গুড় ধামায় কইরা হাটে নিয়া যাবে মোতালেফ মিঞা। নিয়া বেচবে অচেনা খইদ্দারের কাছে। এ বছর এক ছটাক পছন্দসই গুড়ও তো সে হাটে-বাজারে বেচতে পারে নাই। কেবল গাছ বাওয়াই সার হইছে তার।’ গলাটা যেন ধরে এলো মোতালেফের। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিল, বাখারির বেড়ার ফাঁকে চোখে পড়ল কালো বড় বড় আর-দুটি চোখ ছলছল করে উঠেছে। চুপ করে তাকিয়ে রইল মোতালেফ। আর কিছু বলা হলো না।

হঠাৎ যেন হুঁশ হলো নাদির শেখের, বলল, ‘ও কী মেঞা, হুঁকাই যে কেবল ধইরা রইলেন হাতে, তামাক খাইলেন না? আগুননি নিবা গেল কইলকার?’
হুঁকোতে মুখ দিতে দিতে মোতালেফ বলল, ‘না মেঞাভাই, নেবে নাই।’