নভেরা হোসেনের স্বাধীনতা দিবসের গল্প ‘পরিমল চক্কোত্তি’
প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২০
লাল টকটকে সূর্য উঠছে রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারকে ছিন্ন করে। পরিমল চক্কোত্তির বাড়ির উঠানেও সকালের সোনালি আলো এসে প্রবেশ করেছে। সেগুন কাঠের কারুকাজ করা জানালার ফোঁকর দিয়ে ঝিরঝিরে আলোর কণাগুলো ঢুকে পড়েছে রানু, পূরবী, শর্মিলাদের চোখে-মুখে। কারো ঘুম তখনও ভাঙেনি, রাতে যশোর থেকে বিপিন মামা আসাতে রাতের খাবার খেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বিপিন মামা যা বলল তাতে রানুদের সকলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। ঢাকাতে নাকি রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে! ২৫ মার্চের রাতে কত বাঙালিকে পাকবাহিনী হত্যা করেছে, তার হিসাব নাই।
বিপিন তুমি ঠিক ঠিক বলছ তো?
জামাইবাবু কী বলব, ঢাকা থেকে যখন জান নিয়ে পালিয়ে এলাম নৌকাতে মানুষের সাথে কত লাশ যে আসল তার ইয়ত্তা নাই। পঙ্গপালের মতো মানুষ গ্রামমুখে ছুটতাছে। নারী, শিশু, সোমত্থ যোয়ান পোলা, বুড়ো মানুষ কেউ বাদ নাই। ঢাকা শহরটারে ওরা গোরস্তান বানাইছে। লাশের সারি, কাঁচা কবর, চিল-শকুনের মচ্ছব বইছে। আর এত কাক কোথা থেকে যে ঢাকা শহরে আসল! সারা আকাশ ছাইয়া গেছিল কাকে, তাদের কা কা রবে লাশের শরীর পর্যন্ত ঝাঁকি খাইয়া উঠছে!
বিপিন তুমি কও তো বাঙালিরা কি কোনোকালে অস্ত্র ধরছিল? তারা কেমনে এই হায়েনাগো সাথে লড়ব? সবাইরে মাইরা বাঙাল মুল্লুকরে প্রাণশূন্য করব হেরা, ঘুঘু চড়াইবো।
জামাইবাবু, দেয়ালে যখন মানুষের পিঠ ঠেকে তখন সে লোহার দেয়াল ভাইঙা বাইর হইয়া যায়, তার কান হইয়া যায় কুলার মতো, সে আর মানুষ থাকে না, দাও-দানবে পরিণত হয়, তার শরীরে অসুরের শক্তি আইসা ভর করে।
হ বিপিন তুমি ঠিকই কইছ। তেভাগার কথা মনে নাই? মহাজন জমির মালিকরা যখন ক্ষেতের চাষিগো ন্যায্য হিস্যা গোলার ধান কাইরা নিয়া যাইত তখনতো গ্রামের কিষানী, কৃষক, বাড়ির বউ-ঝি সকলেই খুন্তি, ছুরি, দা, লাঠি, বাঁশ দিয়া মহাজনগোরে বুঝাই দিছিল কত ধানে কত চাল! সারাজীবন যারা খালি মাইর খাইব তারাই হারব এমন নাও হইতে পারে। কী কও বিপিন?
জামাইবাবু, আমিও তো সেই কথাই কই!
তয় বিপিন এই পাঞ্জাবিরা কিন্তু মানুষ না, তাগো দিলে দয়া-মায়া কিচ্ছু নাই! ঢাকার যে বর্ণনা কইলা তারা আমাগো ছাড়ব না, শেষ রক্তবিন্দু বাইর কইরা ছাড়ব! চুইষ্যা খাইব! বাঙালিগো তারা সম্মান করে না। স্বার্থ ছাইড়া পাকিস্তানিরা কোনোদিন বাঙালিগো ন্যায্য হিস্যা দিব না, অগো শরীরে বেদুঈন রক্ত! খুনের বদলে খুন, ভাইয়ের রক্ত দিয়া অরা স্নান করব।
পরিমল চক্কোত্তি আর বিপিন চক্কোত্তি হারিকেনের হলুদ আলোতে কথা বলতে থাকে। তাদের চোখেমুখে অবিমিশ্র ভয় আর চাপা উত্তেজনা। সামনের দিনগুলোর জন্য অজানা আশঙ্কায় পরিমল চক্কোত্তির ভেতরটা হু হু করতে থাকে। জিজ্ঞেস করে, বিপিন, ঢাকায় রানুর যে মনোরমা মাসি ছিল তার কথাতো কিছু কইলা না। তারা সব কই আছে?
সঠিক কইতে পারি না জামাইবাবু। মনোরমা শুনছি কুমিল্লার দিকে চইলা গেছে, তাগো বাড়িতেও গুলি চলছিল। শাখারিপট্টির দোকানপাট, বাড়িঘর সব জ্বলতেছিল, সেইখানে আর কেউ নাই, যারা বাঁইচা গেছে নদী পার হইয়া নওয়াবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, কালিগঞ্জের দিকে গেছে। মনোরমার ছেলে দুটি ওই রাতেই মইরা গেছে। তাদের লাশের উপর দিয়া মনোরমা আর অসীম কেমনে কেমনে কুমিল্লার দিকে চইলা গেছে শুনছি, একবার আঁগরতলায় পৌঁছাইতে পারলে আর চিন্তা নাই।
বিপিনের কাছে ঢাকায় পাকসেনাদের নারকীয় তাণ্ডবের কথা শুনতে শুনতে পরিমল চক্কোত্তি দরদর করে ঘামতে থাকে। এমনিতেই কয়েকদিন ধরে কোনো বাতাস নাই। একখণ্ড বাঁকা চাঁদ পরিমল চক্কোত্তির দোচালা টিনের চালের উপর লটকে আছে। পরিমল চক্কোত্তির বড় মেয়ে রানু মনোরমা মাসির কথা শুনে আৎকে ওঠে। মাসি কত সুন্দর, ছিমছাম, গানের গলাটাও মিষ্টি। মায়ের মাসতুত বোন। মাতো সেই কবেই মরে স্বর্গবাসী। মনোরমা মাসির চেহারার মধ্যে মার একটা ছাট আছে। মার নাকে সবুজ পাথর বসানো একটা সোনার নাকছাবি ছিল, ঠিক একইরকম একটা নাকছাবি মাসির টিকালো নাকেও জ্বলজ্বল করত, যেন নদীর জলে একটা ছোট আলোর বাতি, ঘাড় ঘুরালেই সবুজ পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ত।
সারা রাত এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোর হয়ে যায়। বিছানার সাথের জানালাটা ঠেলে দিতেই একঝলক রোদ এসে আছড়ে পড়ে রানুর চোখেমুখে। পূরবী, শর্মিলা জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে। ওদের কিশোরী অবয়ব থেকে দূর্বাঘাসের ঘ্রাণ পায় রানু। এই পূরবী, শর্মিলা ওঠ, ওঠ। কখন সূয্যি উঠছে। তোরা চান করবি না? স্কুলে যাবি না? রানু বোনদের ধাক্কা দেয় কিন্তু ছোট বোনদুটি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, কলপারে বিপিন মামা চান করছে, রানু দ্রুত হাতে বিছানাটা তুলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ভোরে মামার চা না হলে চলে না, ঘরে দুধও নাই, মামাকে লাল চা করে দেয় রানু।
হ্যারে রানু, তর কলেজ চলছে কেমন?
এই চলছে মামা, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা এখন সবাই আসে না, অনেকে কোলকাতা চইলা যাইতেছে, অনেকে ভয়ে আসে না।
বিপিন যতদিন রানুদের বাড়িতে থাকে সারাক্ষণ পরিমল চকোত্তিকে বোঝায় তার সাথে কোলকাতা যাবার জন্য। পরিমল কিছুতেই বিপিনের কথার সাথে একমত হতে পারে না। পরিমল চক্কোত্তির এক কথা, আমি কেন দেশ ছাড়মু? চোরের মতো পলাইয়া যামু? মরতে হলে বাপ-ঠাকুর্দার পিতৃ ভূমিতে মরব।
প্রতিদিন ভোরে পরিমল চক্কোত্তি স্কুলের ঘর-দরজা খুলে ছাত্রদের জন্য বসে থাকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিকেও অনেক ছাত্র আসত। পশ্চিমে নমঃশূদ্রদের পাড়া। সেসব ঘরের ছেলেমেয়েরাই পরিমল চক্কোত্তির স্কুলের ছাত্রছাত্রী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই অনেকে যশোর হয়ে বর্ডারের ওপারে আশ্রয় নেয়। পরিমল চক্কোত্তির মন সবসময় খারাপ থাকে, ফরিদপুরের এই ছোট্ট এলাকায় মন খুলে কথা বলার লোকের বড় অভাব! পরিমল চক্কোত্তি চৌধুরীদের বড় পুকুরঘাটের পারে রোজ সন্ধ্যায় একটু হাওয়া খাওয়ার জন্য যায়, ওখানে গেলে দু-চারজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, দেশের হাওয়া-বাতাসের খবর পাওয়া যায়। ভূগোলের শিক্ষক নন্দলালবাবু, তার সাথে কথা বলা যেত, প্রায়ই আসত রানুদের বাড়ি। সেও যশোরে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে আছে।
পরিবেশ এমন থমথমে হয়েছে যে, নিজের সন্তানকেও মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না। যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে! রানু বাবাকে অনেক বলে এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিমল চক্কোত্তির এক কথা না রে মা আমি কোথাও যামু না। খান সেনারা আমাগো মারব না। আমার স্কুল ফালাইয়া আমি কোথায় যামু? কার কাছে গচ্ছিত রাইখা যামু সম্পদটারে!
বাবা, কেউ কি বলতে পারে এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? বিপিন মামাতো বলছে আমরা যাইতে চাইলে লোক মারফত খবর দিতে নিয়া যাবে।
না রে রানু, আমি পারমু না। কিন্তু তোদের একটা বন্দোবস্ত করা দরকার।
রানু জানালার শিক ধরে বাড়ির পেছন দিকে তাকিয়ে থাকে। পিছনটায় এখন আর যাওয়া হয় না। ঝোপঝাড়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। রাতে ভয়ে পা ছমছম করে। দেওয়ান বাড়ির তিন ছেলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের অনেক গল্প শোনে রানুরা। ওদের সাথে ছোটবেলায় অনেক খেলাধুলা করেছে। ছোট দেওয়ানের ছেলে মকবুল সবসময় রানুর সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইত, রানুরও যে মকবুলকে ভাল লাগত না তা নয়, কিন্তু বাবার কথা ভেবে রানু মনের সুপ্ত ইচ্ছাকে দমবন্ধ করে মেরেছে। অনেক রাত জেগে থেকেছে মকবুলের পায়ের শব্দ শোনার জন্য। রানু জানে ভোরের শিউলি যখন ঝরে পড়ে বৈঠকখানার সিঁড়িতে তার সাথে রানুর বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসও ঝরে পড়ে।
এই সেদিন বিপিন মামা চলে যাওয়ার পর মকবুল একদিন সকালে রানুদের বাসায় আসে পঞ্জিকা নেয়ার জন্য। রানু জানে সব ছুতো, আসলে রানুকে এক ঝলক দেখার জন্যই মকবুল এসব করে। কিন্তু ঐ দিন মকবুলকে দেখে রানুর ভাল লাগে নি। দিন সত্যি বদলে গেছে, মকবুলকে এখন খুব অচেনা লাগে, কেমন হিংস্র একটা ভাব চেহারায়। মকবুল তেরছাভাবে জানতে চায়, রানুবিবি তোমার মামা আসছে শুনলাম, কি কাজে আসছিল?
মকবুলের প্রশ্নে রানু থতমত খায়।
নাহ্ কি কাজে আসব? বেড়াতে আসছিল, বাবার বুকের বেদনাটা বাড়ছে সেজন্য দাওয়াই নিয়া আসছিল।
ওহ্! কিন্তু আমি শুনলাম তোমরা ভারত যাইতাছ?
নাহ্, আমরা কেন ভারত যাব? ঐটা কি আমাদের দেশ?
তাইলে কোনটা তোমাগো দেশ?
রানু আঁঙুল দিয়ে মাটির দিকে ইঙ্গিত করে রান্নাঘরে চলে যায়। মকবুল আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে চলে যায়।
মকবুল বাড়িতে আসার পর থেকে রানুর মনে ভয় দেখা দিয়েছে, ছোট বোনদের নিয়ে রাতে ঘরে থাকতে ভয় পায়। রানু পরিমল চক্কোত্তিকে অনুরোধ করে বিপিন মামাকে খবর দিতে।
বর্ষার শেষের দিকে অনেক লোক এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। পরিমল চক্কোত্তির বাড়িটা একটা জঙ্গলমতো জায়গায়। স্কুলের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা আগালে একটা বড় পুকুর, ওই এলাকায় পুকুরটি পদ্ম-পুকুর নামে পরিচিত। পদ্ম-পুকুরের উত্তর পারে পরিমল চক্কোত্তির বাড়ি। বাড়ির পেছনে ঝোপ-জঙ্গল ভর্তি। বর্ষায় সাপ উঠে আসে বাড়ির চৌকাঠে। রানুরা তখন ঘরের জানালায় কার্বলিক এসিডের শিশি ঝুলিয়ে রাখে। এক সকালে কার্বলিক এসিডের শিশি গায়েব হয়ে যায় পরিমল চক্কোত্তির বাড়ির জানালা থেকে। দুপুরের দিকে সালাম ব্যাপারির মেজো মেয়ে ছন্দার লাশ পাওয়া যায় পরিমল চক্কোত্তির বাড়ির পেছনে। দেওয়ান বাড়ির ছেলেরা দুদিন আগের রাতে ছন্দাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
সালাম ব্যাপারি মেয়ের শোকে প্রায় পাথর হয়ে যায়। ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর রানু পেছনের জানালা দিয়ে ঝোপের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরানো অশ্বত্থ গাছটার নীচে একটা নীল কাপড় উড়তে দেখে। প্রথমে রানু ভাবে কোনো পুরানো কাপড়ের টুকরা। কী মনে করে রানু শর্মিলাকে নিয়ে বাড়ির পিছনে যায়। বটগাছের পিছন দিকে কালো কোকড়া চুল আর ফর্সা দুটো হাত। রানু, শর্মিলা ছন্দাকে দেখার পর চিৎকার দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে, বাবা, বাবা! দুবোন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। ছন্দার স্বরস্বতীর মতো কারুকাজ করা মুখে লাল পিঁপড়া সারি বেঁধে চলছিল। রানুর মনে পড়ে ছোটবেলায় খেলার সময় ছন্দা বলত, ঐ রানু দেখ্ দেখ্ লাল পিঁপড়াগুলা তোর দিকে যাইতেছে, ওরা হিন্দুতো তাই, আর কালো পিঁপড়া মোসলমান।
ছন্দার লাশ পাওয়ার দু-সপ্তাহের মাথায় দেওয়ান বাড়ির ছেলেদের সাথে আরও দশ-বারোজন যোয়ান ছেলে অস্ত্র হাতে রাত বারোটার দিকে পরিমল চক্কোত্তির বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়। ওরা চিৎকার করে ডাকতে থাকে, পরিমল চক্কোত্তি, ঐ চক্রবর্তীর পোলা বাহির হ! আর কত কাল শ্বশুরের ভিটায় থাকবি? সুন্দরী মেয়েগো দিয়া মুক্তিবাহিনীর সেবা করবি? অগো আর কত ঠাকুরের সেবায় পাঠাবি? বাইর হ কুত্তার বাচ্চা!
পরিমল চক্কোত্তি চকির সাথে টানটান হয়ে শুয়ে থাকে, নিঃশ্বাস পড়ে না। বিপিনের কথাই তাহলে ফলল! বিপিন বলছিল জামাইবাবু আপনার হাত জোড় করছি। তিনটা সোমত্থ মেয়ে নিয়া আপনি এমন খোলা ভিটায় থাইকেন না। ওদেরকে আমার সাথে দিয়া দেন। আমি পুলিনকে দিয়া ওদেরকে একবারে কোলকাতায় পিসির বাড়ি পাঠাই দেব। মেয়েদের কোনো সমস্যা হবে না। পিসা খবরের কাগজে চাকরি করে, সব সময় যোগাযোগ করন যাইব। ভগবান এমন সোনার টুকরা মেয়েগুলাকে আগলাইয়া রাখব, আপনি আর না কইরেন না!
পরিমল চক্কোত্তি র সারা শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে। পানি পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যায়। রানু ছোট দুইবোনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। মকবুলের বাহিনী দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। সবার মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। অন্ধকারেও রানু মকবুলকে ঠিকই চিনতে পারে। পরিমল চকোত্তি দৌড়ে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তোমরা আমারে মাইরা ফালাও কিন্তু আমার মেয়েদের গায়ে হাত দিও না। ওরা এক এক জন স্বর্গেরদেবী, ওদের কোনো দোষ নাই। পরিমল চক্কোত্তি অন্ধকারে একজনের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।
কুপির আলোয় সবার চোখ ভাটার মতো জ্বলতে থাকে। রানু আলো-আঁধারিতে দেখতে পায় গামছা দিয়ে মুখ বাঁধা এক একজন লোলুপ হায়েনাকে।
পরের দিন সকালে পদ্ম-পুকুরে ভেসে ওঠে পরিমল চক্কোত্তি র লাশ। সারা শরীর বেয়নেটের খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত, বাম দিকের চোখ ওপড়ানো। সাদা জুঁই ফুলের মতো চামড়ায় লালচে ভাব ধরেছে। রানুদের তেমন কোনো খবর আর পাওয়া যায় না। অনেকে বলে ঐ রাতে গণ-অত্যাচারের পর রানুদের তিনবোনকে ট্রাকে করে ফরিদপুরে মিলিটারি ক্যাম্পে চালান করে দেয়া হয়। কেউ বলে রানুদের ঢাকায় নিয়ে যাওযা হয়েছিল। ফরিদপুরে স্কুলের মাঠে পাক আর্মিদের যে ক্যাম্প ছিল সেখানে একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আটক ছিল, শোনা যায় সে নাকি তিনজন অপরূপ সুদর্শন মেয়েকে দেখেছিল সে ক্যাম্পে। তাদেরকে ফরিদপুরের ভেতরের এলাকা থেকে শহরে আনা হয়েছিল, ঐ তরুণের বাড়িও ছিল রানুদের কাছাকাছি এলাকায়।
যুদ্ধের শেষে ক্যাম্পের মেয়েরা কে কোথায় চলে যায় খুব কমই জানা যায়, আর মেয়েদের পরিবারের লোকজনও জানতে চাইত না তাদের সম্পর্কে। তারা খুব কমই জানতে দিয়েছে নিজেদের কথা। তাদের শরীর বেয়ে চলা লাল পিঁপড়ার সারিও কেউ কোনোদিন দেখতে পায় না আর। যুদ্ধের পর এলাকার লোকজন পরিমল চক্কোত্তি র বাড়ির নাম নিশানা মুছে দেয়, জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলে। শুধু কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুকুর পারের বট গাছটি। বটের ঝুরি বাড়তে বাড়তে পুকুরের জলকে স্পর্শ করে, আর লাল পিঁপড়া, কালো পিঁপড়ারা বটে লাল ফল এলে ভিড় জমায় পরিমল চক্কোত্তির বাড়ির ত্রিসীমানায়।