নভেরা হোসেনের গল্প ‘১১ সি টালি অফিস রোড‘
প্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০২০
রায়েরবাজার টালি অফিস রোডের চিপা গলিগুলো সরু হতে হতে মাঝে মাঝে এমন সর্পিলাকার হয়ে যায় যে সূতানলি সাপও গলির ভেতর ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না। টালি অফিস রোডের এই গলিগুলোর একটিতে কান্তাদের বাগান বাড়ি। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। লোহার গরাদআলা গেটের ভেতরের দিকে তারের জালি লাগানো। জালিটাকে ঢেকে রেখেছে আইভি লতা। আইভি লতার প্যাঁচানো ভঙ্গি বাইরে থেকে গেটটিকে দেখতে সবুজ গালিচার কথা মনে করিয়ে দেয়।
সবুজের প্রাচীর ভেদ করে উঁকি দিলেই ত্রিকোণাকৃতির পাথর বসানো পায়ে চলা পথ। বেশ কয়েক গজ আগানোর পর লাল ইটের দোতালা বাড়ি। পাথর বসানো পথের দুপাশে নানা জাতের সুগন্ধি ফুলের গাছ। জারম্নল, মাধবীলতা, কৃষ্ণচূড়া, গন্ধরাজ সব ঘন ঝোপ তৈরি করেছে। গাছের জন্য বাড়িটা অন্ধকার হয়ে থাকে। লাল ইটের বুক চিরে অজগরের মতো মানিপ্ল্যান্ট ঊর্ধ্বমুখী। এখানে এলেই কান্তার ঘন কোকড়া চুলগুলো চোখে ভেসে ওঠে শাশ্বতীর। দিন দিন মেয়েটি কেমন নিষ্প্রভ হয়ে উঠেছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখের নিচে কালি, দীর্ঘ রাত জাগার চিহ্ন।
কান্তার সাথে শাশ্বতীর পরিচয়টা ঘটেছে নাটকীয়ভাবে। প্রখর রোদে শাশ্বতী হেঁটে যাচ্ছিল ঝিকাতলা বাস স্ট্যান্ডের দিকে চাঁনখার পুলের বাস ধরে কলেজে যাওয়ার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শাশ্বতীর চোখ আটকে যায় ফুটপাতে। ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসে আছে একটা কোকড়া চুলের মেয়ে, চোখে-মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, চোখ বন্ধ করে বসে আছে। দু-চারজন পথচারি মেয়েটার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। শাশ্বতী ভিড় সরিয়ে মেয়েটির কাছে যায়। মনে হচ্ছে মেয়েটি অসুস্থ, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। শাশ্বতী দ্রুত একটা রিকশা ডাকে, রিকশাওয়ালাসহ কষ্ট করে মেয়েটিকে রিকশায় তোলে।
মেয়েটি যন্ত্রণায় কুকড়ে যাচ্ছিল, মুখ দিয়ে ফ্যানার মতো বের হচ্ছিল। শাশ্বতী খুব যত্ন করে মেয়েটিকে ধরে রাখে, জানতে চায় তোমার বাসা কোথায়, মেয়েটি কিছুই বলতে পারে না এবং ব্যথায় গোঙাতে থাকে। শাশ্বতী কি করবে না বুঝে সামনের ঝিকাতলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখানে ইমার্জেন্সি বলে মেয়েটির কোনো মানসিক রোগ আছে তাকে ভর্তি করে নেয়। মেয়েটির ব্যাগে থাকা পকেট ডায়েরিতে বাসা নামে একটা ফোন নাম্বার পেয়ে সেখানে ফোন করতেই বেশ সম্ভ্রান্ত এক মহিলা ফোন ধরেন, হ্যালো স্লামালাইকুম, কাকে চাচ্ছেন?
সরি আমাকে চিনবেন না। ঝিকাতলায় রাস্তায় কোকড়া চুলের এক মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে নিয়ে আমি হাসপাতালে এসেছি, এটা কি ওদের বাসা?
হ্যাঁ হ্যাঁ। কান্তা। আমার মেয়ে। ও আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে? এখন কি অবস্থা?
না-না, আপনি চিন্তা করেন না। কান্তা ভালো আছে, আপনি দ্রুত চলে আসেন।
এরপর থেকে কান্তা আর ওর মা দুজনেই শাশ্বতীর অতি আপনজন হয়ে গেল। কান্তার মা শাশ্বতীকে মেয়ের মতোই আদর করতেন। কান্তার বাবা নেই, জন্মের তিন বছরের মাথায় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। কান্তার মা একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে মেয়েকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। পৈত্রিক সূত্রে কান্তারা বাবার বিশাল বাগান বাড়ির মালিকানা পায়। কিন্তু এত বড় বাড়িতে মা-মেয়ে দুজনের যেন দমবন্ধ হয়ে যেত। শৈশব হতেই কান্তার একটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যখন কান্তার সাত বছর বয়স তখন একবার ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে যায় চট্টগ্রামে। ফুপুর বাসায় দুপুরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ফুপা তাকে শারীরিকভাবে এবিউজ করার চেষ্টা করে, ফুপু টের পেয়ে কান্তাকে দ্রুত ঢাকায় পাঠিয়ে দেন।
কান্তার মা ছাড়া এ কথা আর কেউ জানতে পারে না। ওখান থেকে আসার পর কান্তার মধ্যে নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। কান্তা দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন শরীরে কোনো সাড়া নেই, ডাকলে বা ঝাঁকালেও শব্দ করত না। কয়েক ঘণ্টা এভাবে কাটার পর আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে কান্তার আর তখনকার কথা মনেও থাকে না তার। কান্তার মা একজন বাঁধা বুয়ার কাছে মেয়েকে রেখে চাকরিতে যেতেন। কান্তা স্কুলে, কলেজে পড়লেও ক্লাস খুব কম করেছে। বাসায় কোনো পুরুষ অতিথি বা আত্মীয় এলেও অসুস্থ হয়ে পড়ত সে, হঠাৎ বিছানায় শুয়ে গোঙাতে থাকত। শাশ্বতী এসবই জানতে পারে কান্তার মায়ের কাছে। বেশিরভাগ সময় কান্তা চুপ করে থাকে কিন্তু যখন কথা বলতে শুরু করে তার ভেতর অফুরাণ প্রাণ-সম্ভার। একটা সতেজ রক্ত গোলাপ।
সে তার একটা কল্পিত পৃথিবীর কথা বলে যেখানে সবাই আনন্দ করছে, কারো কোনো যন্ত্রণা নেই, বেদনা নেই, হতাশা নেই, চারদিকে রাশি রাশি আলোর ফোয়ারা, চোখ ঝলসে যায়। একটা ঘোর-এই ঘোর তাকে বাঁচিয়ে রাখে। কান্তা মনে করে একদিন সে তার স্বপ্নের পৃথিবীতে যেতে পারবে, এখানে অনেক যন্ত্রণা, মাথায় তীব্র ব্যথা হতে থাকে, সে সহ্য করতে পারে না, প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়, অসাড়ের মতো পড়ে থাকে বিছানায় বা কলেজের বেঞ্চে। তখন মেয়েরা কান্তার মাকে খবর দেয়। কান্তার মা মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এজন্য তাকে খুব বেশি বাইরে যেতে দেয়া হয় না। কিন্তু সে সুযোগ পেলেই বাইরে যেতে চায়। এভাবে বেশ কিছুদিন বাসায় থাকার পর আবার বেরোতে শুরু করে কান্তা।
কান্তাদের পাশের বাসার এক ছেলের সাথে প্রায়ই কান্তা দেখা করতে যায় তাদের ছাদে এবং যখন ছেলেটির বাসায় কেউ থাকে না তখন সে ছেলেটির সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হয়। শাশ্বতীকে এ কথা বলেছে কান্তা। শাশ্বতী জানতে চেয়েছে, তুমি কি ছেলেটিকে ভালবাসো?
না তো।
ছেলেটি তোমাকে?
জানি না।
তাহলে তোমরা যে এত কাছে চলে এসেছো?
আমি জানি না শাশ্বতী। আমার হঠাৎ করে কি হয়, অলক আমাকে ডাকলেই আমি ওর বাসায় চলে যাই, ওর সাথে সময় কাটাতে আমার ভাল লাগে। ও আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে আনন্দে থাকা যায়। কিন্তু আমি চাইলে ও তখন আমাকে চিনতে পারে না, খুব এড়িয়ে চলে, ওর মা-বাবা, ভাইবোনদের সামনে আমাকে না চেনার ভান করে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়, অপমান লাগে, মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়।
তাহলে তুমি অলকের সাথে সম্পর্ক রেখেছ কেন?
আমি জানি না। আমি তাকে হেট করি কিন্তু যখন সে আমাকে কাছে পেতে চায় এড়াতে পারি না। ওর স্পর্শে আমার সমস্ত শরীর জেগে ওঠে। শরীরের প্রতিটি রোমকূপ জেগে ওঠে, অসম্ভব আনন্দে ভেসে যেতে থাকি। অলক যখন আমার সত্মন পান করতে থাকে অসম্ভব ভাল লাগায় ছেয়ে যায় শরীর, মন। ও যখন একটু একটু করে আমার মধ্যে প্রবেশ করে তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই।
চুপ করো। কিন্তু সে তো তোমাকে ভালবাসে না।
শাশ্বতী, এটা ভালবাসার বিষয় না। এটা একটা খেলার মতো, এই খেলাটায় একটা আনন্দ আছে। তুমি জানো অলক ছাড়াও আরও তিনজন ছেলের সাথে আমার এ সম্পর্ক আছে। শাশ্বতী চমকে ওঠে। কান্তার ভেতরকার অদম্য চরিত্রটিকে শাশ্বতী ভয় পেতে থাকে।
কিন্তু এই সম্পর্কগুলোর পরিণতি কি তুমি জানো?
কি পরিণতি? আমারতো কোনো পরিণতির দরকার নেই। পরিণতি দিয়ে আমি কি করব? আমার যন্ত্রণা ওরা কমিয়ে দেয় এটাই কি যথেষ্ট নয়?
তুমি এখনও বুঝতে পারছো না কিন্তু যখন সমস্যায় পড়বে ওরা কেউ তোমার পাশে থাকবে।
এসব ভাবার মতো অবস্থা আমার নেই শাশ্বতী। তুমি আমার খুব ভাল বন্ধু কিন্তু কেন জানি তুমি আমাকে বুঝতে পারো না। কেন বোঝো না অলক, সাদ, হিমেলরা আমাকে আনন্দ দেয়, ওরাও আনন্দ পায়। এতে অসুবিধা কি? আমরাতো কেউ কারো ক্ষতি করছি না। শাশ্বতী গভীর মনোবেদনা নিয়ে বাসায় ফিরে আসে, বন্ধুর জন্য চিন্তা হতে থাকে, আবার ভাবে ও যাতে ভাল থাকে তাতে বাঁধা দেব কেন? কি অধিকার আছে আমাদের? নানা চিন্তা ঘুরতে থাকে শাশ্বতীর মাথায়, পারলে রোজ একবার কান্তার খোঁজ নিতে ওর বাসায় যায়।
কান্তার মাকে শাশ্বতী কান্তার গোপন জীবনের বিষয়ে কিছু বলতে পারে না। রোজ ভাবে বলবে কিন্তু কি এক অস্বস্তি এসে শাশ্বতীকে নির্বাক করে দেয়, কোনো কথাই যেন মুখ দিয়ে বের হতে চায় না। একদিন কান্তার মাকে বাসায় একা পেয়ে শাশ্বতী বলে, খালা, কান্তার ট্রিটমেন্ট দরকার। ওর এই অবস্থা চলতে দেয়া ঠিক না।
কোন অবস্থা? এই অসুখতো ছোটবেলা থেকেই আছে। ডাক্তার দেখিয়েছি অনেকবার, তেমন উন্নতি হয় না।
না, একজন মনোরোগের ডাক্তার দেখানো দরকার।
কেন তোমার কি মনে হয় ও মানসিক রোগী?
না তা না। আমি বলতে চাইছি, এই সমস্যাটা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা আরও ভালভাবে ট্রিটমেন্ট করতে পারবে। তাছাড়া ওর আরও কিছু সমস্যা আছে...
আর কি সমস্যা?
না, আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি না। ডাক্তারকে বলা দরকার।
তবু তুমি বলো আমাকে, আমি ওর মা। তুমি ওর বন্ধু হিসাবে ওর ভালোর জন্য বলো।
খালা আমি বলতে পারছি না। মানে ওর কিছু ছেলে বন্ধু আছে।
বলো... কারা?
না, আমি চিনি না। কিন্তু তাদের সাথে ও অনেক ঘনিষ্ঠ। প্লিজ আমাকে আর জিজ্ঞেস করবেন না খালা। ওকে একজন মানসিক রোগের ডাক্তার দেখান।
কিন্তু আমার ভয় লাগে মা, তুমি ওকে একটু নিয়ে যাবে। আমি পারবো না ওকে নিয়ে যেতে। আমার খারাপ লাগবে।
শাশ্বতী ভাবতে থাকে কান্তার অসুস্থতা, বেপরোয়া জীবন-যাপন, বিপদের দিকে ছুটে চলা এসব থেকে কেমন করে ওকে সরিয়ে আনা যায়। শেষে কান্তার মার সহযোগিতায় শাশ্বতী একজন মনোচিকিৎসকের সাথে এপয়ন্টেমেন্ট করে কান্তাকে নিয়ে যায় তার কাছে। প্রথমে কান্তা কিছুতেই যেতে চায়নি, পরে মায়ের কান্নাকাটিতে যেতে বাধ্য হয়।
মনোচিকিৎসক শাশ্বতী ও কান্তার কাছে সব শুনে বলেন, কান্তার মধ্যে ছোটবেলার শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাটি ব্যাপক শকের তৈরি করেছে এবং সেটা শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যথা, যন্ত্রণা, শরীরে জ্বর আসা, ঝিম মেরে বসে থাকা এসব সিমটম আকারে দেখা দেয়। আর ও যে বহু শারীরিক সম্পর্কে যায় এর কারণ হয়তো ওর ভেতরে একটা প্রতিশোধমূলক বিষয় তৈরি হয়েছে হিডেনভাবে, যা সে নিজেও জানে না, যার ফলে সে এত অল্প বয়সে একই সাথে বহু সম্পর্কে জড়াতে পারছে। ওর ভেতর সামাজিক নৈতিকতার বোধ বা ভয় কাজ করছে না। এটা তখনই হতে পারে যখন ভিকটিম মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় থাকে না।
ডাক্তার বলেন, তোমরাতো দেখছি দুজনেই অল্পবয়স্ক। কান্তার বাড়িতে আর কেউ নেই আসার মতো?
শাশ্বতী বলল, ওর মা আছে। কিন্তু তিনি আসতে চান না।
কেন?
খালার ভাল লাগে না আসতে।
না তাকে আসতে বলো, আমি তার কাছ থেকে আরও কিছু শুনতে চাই। অনেক কিছু জানার আছে তার মেয়ে সম্পর্কে। তুমি তো বন্ধু সব জানবে না।
জ্বি। আবার আমি যা জানব তিনি তা জানবেন না হয়তো।
তা ঠিক, কিন্তু তাকে আমার দরকার আছে।
এরপর ডাক্তার অনেক কড়া ডোজের ওষুধ দিলেন। কান্তা দিনরাত পড়ে পড়ে ঘুমায় আর মোটা হতে থাকে। মাসে একবার ডাক্তারের কাছে শাশ্বতীই নিয়ে যেতে থাকে। ডাক্তার বলেন ওষুধ দিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে ওর ভেতরকার ক্ষতটাকে সারাতে চেষ্টা করছি, ওষুধে যতটুকু রিকভারি হয় বাকিটা ওর মনকে আনন্দে রাখা আর জীবন সম্পর্কে একটা অর্থপূর্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার মধ্যে দিয়ে করতে হবে। পরিবার ও ওর আশেপাশের মানুষজনকে সাহায্য করতে হবে।
এর মধ্যে অনেক দিন কেটে যেতে লাগল। কান্তা অনেকটা ঘুমের ঘোরের মধ্যে চলতে লাগল। উপসর্গ কিছু কিছু কমতে শুরু করেছে। কলেজে নিয়মিত যেতে শুরু করল কান্তা। পড়ার প্রতি মনোযোগ আসল কিছুটা আর ডাক্তার ওকে বলেছে যোগ ব্যায়াম করতে, কান্তা তা করতে লাগল নিয়মিত।
শাশ্বতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। কান্তার কাছে যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে পড়ল। ক্লাস আর ক্যাম্পাসের আড্ডায় সময় কেটে যেতে লাগল। প্রায় কয়েক মাস হলো কান্তার বাসায় যাওয়া হয় না। কান্তার মা কয়েকবার খবর পাঠিয়েছেন তবু যাওয়া হয়ে ওঠে না। এর মধ্যে একদিন রাত এগারোটার দিকে কান্তার মা শাশ্বতীর বাসায় এসে হাজির। বিকালে কান্তা বাসা থেকে বের হয়েছে কিন্তু এত রাত হয়ে গেছে বাসায় ফিরছে না। শাশ্বতী কিছু জানে কিনা?
শাশ্বতী বলল, আমার সাথে ওর গত কয়েক মাস ধরে তেমন যোগাযোগ হয়নি। রাস্তায় দুদিন দেখা হয়েছিল, দেখে মনে হলো আগের চেয়ে অনেক ভাল।
হ্যাঁ ও তো অনেক সুস্থ হয়ে গেছে ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে। আর কলেজেও নিয়মিত যেতে পারছে।
কিন্তু আজ কি হলো? আবার কি অসুস্থ হয়ে পড়ল। সারা রাত শাশ্বতী ঘুমাতে পারল না। কান্তার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে রইল। নিজের প্রতি খুব রাগ হতে লাগল। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্যইতো সে এতদিন কান্তার কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিল। নতুন বন্ধুরা কান্তাকে দ্রত পুরানো করে তুলছিল। শাশ্বতী ভাবল জীবন তাহলে এমনই বহমান? একটা স্রোত এসে তাকে অন্য স্রোতে নিয়ে যায়। তখনকার মানুষরা সব পর্দার মতো চেখের সামনে থেকে সরে যেতে থাকে।
সারা রাত না ঘুমিয়ে একটা অপরাধবোধ নিয়ে সাত সকালে কান্তার বাসায় গিয়ে হাজির হয় সে। কান্তার মাকে নিয়ে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করা হয়, কেউ কান্তার খোঁজ দিতে পারে না। কান্তাতো কখনো রাতে বাড়ির বাইরে থাকেনি। তাহলে ওর কি কোনো বিপদ হয়েছে? শাশ্বতী আর ভাবতে পারে না। সারাদিন খোঁজাখুজির পর রাতে ঘরে ফিরে এলো কিন্তু মনে দারুণ অশান্তি। কান্তার মা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল, শ্বাশতী কি করবে ভেবে পায় না, শেষে অলোকের কাছে গিয়ে জানতে পারে কান্তা রাকিব নামে একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু রাকিব রাজি হচ্ছে না।
এর বেশি আর কিছু সে জানে না। দুদিন পার হয়ে গেল কান্তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। কান্তার মা থানায় ডায়েরি করল, হাসপাতালগুলোতে খুঁজল, কোথাও মেয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
প্রায় ছয় দিন পর কান্তাদের বাসায় রাতে পুলিশ এসে জানালো, কান্তা নামে এক মেয়ে তাদের কাস্টোডিতে আছে। মেয়েটি গণ ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে। পুলিশ তাকে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি হতে উদ্ধার করেছে, এখন মেয়েটি হাসপাতালে পুলিশ হেফাযতে আছে। মেয়েটি মানসিকভাবে দারুন শকের মধ্যে আছে শুধু নিজের নাম আর ১১/সি টালি অফিস রোড এই ঠিকানাটা বলতে পেরেছে। এখানে এসে পুলিশ ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। কান্তার মা সব শুনে নির্বাক হয়ে রইল আর শাশ্বতী ভাবতে লাগল জীবনকে কি কোনোভাবেই তার নিয়তি থেকে ফেরানো যায় না? সমাজ কি তাকে বারবার পরীক্ষা করে নিজেকে ভোলাবার জন্য?
শাশ্বতী ধীরে ধীরে কান্তাদের টালি অফিস রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে, শাশ্বতীর যেন কোনো হুশ নেই। রিকশা, গাড়ি, হোন্ডা সব পেছনে ফেলে সামনের দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ চোখে পড়ে ঝিকাতলার সেই মোড়টি যেখানে কান্তাকে প্রথম দেখতে পেয়েছিল। হঠাৎ করে শাশ্বতীর সামনে একটা দরজা খুলে যায়, সেখান দিয়ে রাশি রাশি আলো এসে চোখে পড়ে, চারদিকে ফুলের তীব্র গন্ধ, চমৎকার সব ভাস্কর্য, যেন একটা স্বর্গোদ্যান। লোকজন আতশবাজি পোড়াচ্ছে, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের হাতে বেলুন, চোখে-মুখে আনন্দ। কান্তা যেখানে পৌঁছাতে পারেনি শাশ্বতীকে যেন সেখানে পৌঁছাতেই হবে তার আর কোনো উপায় নেই সেখানে না গিয়ে, একটা পঙ্খীরাজের পিঠে চড়ে সে পৌঁছে যাবে সে আনন্দনগরীতে।