নভেরা হোসেনের গল্প ‘মিথিলা ও শহরের গল্প’
প্রকাশিত : জুন ১৩, ২০২০
আর এভাবেই দিন চলে যায়
যেতে থাকে
রাত্রির নিকষতা আঙুরলতার মতো
মনকে পেঁচিয়ে ধরে,
বাঁধন খুলে সে ভারমুক্ত হতে চায়
কিন্তু রাশি রাশি মৃত্যুর ছায়া
পেছনে তাড়া করে ফেরে
সহস্র রাত্রির নীরবতা প্রচণ্ড ঝড় হয়ে ভেঙে ফেলে
সকল অর্থহীনতাকে।
বাইরে তীব্র রোদ ঝলসাচ্ছে। সকাল আটটা বাজার আগেই চারদিক তপ্ত হয়ে উঠেছে। এরকম সকাল দেখে আজি এ প্রভাতে রবির কর মনে জাগে না বরং ঝিরঝির বৃষ্টির জন্য ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। হয়তো সে বৃষ্টি কখনো দেখা দেয়, কখনো দেয় না। মিথিলাও ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আলোর উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে। সকালে গোসলের জন্য কল ছাড়ার পর টুপ করে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে মিথিলার হাতে, তারপর কলের পানি বন্ধ হয়ে যায়। ঘামে ভেজা শরীরে তাকে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয়।
মনের তপ্ত অনুভূতি নিয়ে দরজা খুলতে গেলে মা পেছন থেকে বলে রোজ দেরি করে বাসায় আসবে না, আমাকে দশজন লোক নিয়ে চলতে হয়। দেশটা মগের মুল্লুক হয় নাই, যা খুশি করলাম! ইচ্ছা হইলো রাইত বারোটায় আইলাম।
মিথিলা বিক্ষিপ্তভাবে মার দিকে তাকায়। মগের মুল্লুক মানে, দেরি মানে, আমি কি রমনায় হাওয়া খেতে যাই? ছাত্রী পড়ায়ে ঘরে ফিরতে আরও দেরি হবে।
যাই করো তাড়াতাড়ি আসবা, আজকে বাসায় মেহমান আসবে, আসার সময় লাচ্ছা সেমাই আর নুডুলস নিয়ে এসো।
কেন? কে আসবে, ঐ স্টুপিডটা আবার আসবে নাকি?
ঠিক মতো কথা বলো। কী ভাবো নিজেকে?
ঠিক মতো কী কথা বলব?
তাড়াতাড়ি আসবা, ব্যস। যা বলছি শুনবা, তোমারে আমি আর পাহারা দিতে পারব না।
মা আমি পারব না, আমার কাজ আছে।
বাড়াবাড়ি করবা না। ভালো হবে না বলে দিলাম।
মার কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে মিথিলা। রাস্তায় কোনো রিকশা দেখা যায় না, রোদে গা পুড়তে থাকে। গার্মেন্টসগামী ছেলেমেয়েরা পিলপিল করে হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে; ওদের চোখেমুখে একটা ব্যস্ততা, যেন কে কার আগে ট্রেন ধরবে তার জন্য হুলুস্থূল। বহুক্ষণ রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসে মিথিলা। বাসের জন্য লম্বা কিউ দেখে হতাশ হয়। এই জনসমুদ্র ঠেলে তাকে অফিসে পৌঁছাতে হবে, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটাতে থাকে। গাড়ির হর্ন আর চাকার ঘড়ঘড় শব্দে মাথা ধরে যায়। একটার পর একটা বাস চলে যায়, মিথিলা উঠতে পারে না, লাইনটা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে পড়ে। সারি সারি পিঁপড়ার মতো লাইন করে চলছে সবাই; তরুণ-তরুণী, স্কুলছাত্র, অফিসগামী নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ। কারো হাতে ব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার, কারো হাতে ব্রিফকেস। একদল মেয়ে কলহাস্য করছে। দীর্ঘক্ষণ সিটিং বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে লম্বা কিউ ছেড়ে লোকাল বাসে ওঠার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে মিথিলা। এক একটা বাস আসছে অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে। বাস এসে দাঁড়ানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাসের ওপর। অনেকে বাসে উঠে যায় ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে, মিথিলা পারে না। কেউ কেউ বাসের পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতে চলে যায়।
আরও বাস আসে, যাত্রী নিয়ে চলে যায়, মিথিলা উঠতে পারে না, কাছাকাছি যেতেই লোকের চাপে দমবন্ধ অবস্থা হয়। অনেকক্ষণ পর একটা মিনিবাসে কোনোমতে ঢুকে পড়ে, তারপর অপেক্ষা। চারপাশের শব্দে সাত সকালেই ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, ঘামে জবজবে দশা, মাথায় এলোমেলো চিন্তা এসে ভর করে, বাসের ভেতরে পা ফেলার জায়গা নেই, তার মধ্যে প্রত্যেক স্টপেজ থেকে লোক উঠছে, নামছে খুব কম। বেশির ভাগ মতিঝিল, দিলকুশার ডেইলি প্যাসেঞ্জার। একজন মাঝ-বয়সি লোক মিথিলার গায়ের সাথে চেপে দাঁড়ায়, মিথিলা পাশের ছিটের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিন্তু লোকটি ধীরে ধীরে তাকে চাপাতে থাকে, নড়বার উপায় থাকে না। নরক বোধহয় একেই বলে! মিথিলা এক ঝটকায় লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সামনা সামনি ঘুরে দাঁড়ায়। চোখাচোখি হলে লোকটি চোখ নামিয়ে নেয়, মিথিলা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা লেটে অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে অ্যাটেন্ডেন্স শিটে স্বাক্ষর করতে গেলে ম্যানেজার কলম পেষা বন্ধ করে একটু তিক্ত হাসি দিয়ে বলে, আজকেও লেট! মিথিলা কোনো জবাব দেয় না, চোখ নামিয়ে স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
কী মিস মিথিলা, এভাবে আর কত দিন? আমাদেরকে তো একটা নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটাতো বাড়িঘর না, অফিস। অফিসের ডেকোরাম আছে। প্রতিদিন দেরি করার কোনো কারণ থাকতে পারে না, চেয়ারম্যান স্যার আপনার আরো কিছু আচরণে বিরক্ত।
মিথিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ম্যানেজার বলতে থাকেন, আপনি কাজের ফাঁকে নিজের কাজ করেন, আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে। অফিসে আপনার অনেক বেশি ফোন কল আসে, কাজে মনোযোগ নাই। এমন করে অফিস করা যাবে না।
মিথিলা বলে, স্যার আর কিছু বলবেন...
হ্যাঁ আপনি ডকুমেন্টেশন অফিসার হাবিবকে কী বলেছেন?
মিথিলা ক্ষিপ্ত চিতার মতো ঘাড় উঁচু করে বলে, তিনিতো আপনাদের সেসব বলেছেন, তাই না? এ বিষয়ে আমার কোনো কথা আপনারা শুনতে চাননি।
হ্যাঁ মিথিলা, আমাদেরকে তো হাবিব সাহেবের কথা শুনতে হবে।
তাহলে ঠিক আছে স্যার, আমার কথা বলার কোনো প্রয়োজন দেখি না।
না আপনি বলেন।
জি না স্যার, সেটার কোনো অর্থ হবে বলে মনে হয় না।
কেন, আপনি কি হাবিব সাহেবকে বলেন নাই, স্যারের রিলেটিভ বলে অফিসে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছে।
হ্যাঁ বলেছি, এবং কেন বলেছি আপনি তা জানেন।
না মিথিলা, এভাবে বললে হবে না। হাবিব সাহেবকে কটাক্ষ করে কথা বলার কোনো রাইটস আপনার নাই।
জি স্যার, আমি সেজন্য কিছুই বলি নাই আপনাদের, যা বলার চেয়ারম্যান স্যারকে বলব।
কিন্তু তাতে আপনার খুব একটা লাভ হবে না।
মিথিলা আর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে অ্যাকাউন্টটেন্ট বিপুলের গলা শোনা যায়, দেখা যাবে কতদিন টিকে, হাবিব ভাইয়ের সাথে টক্কর দিয়া এই অফিসে থাকা লাগবে না, এরকম কত দেখলাম!
মিথিলার মাথার ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যায়, অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়, অজানা সব টেনশন হতে থাকে। দ্রুত হাতে টেবিলের ফাইলগুলো তৈরি করতে করতে তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে। এপ্রিলের ভ্যাপসা গরমে পানির কোনো স্বাদ পায় না মিথিলা। পাশের টেবিলের তামান্না এসে জানতে চায়, কী অবস্থা মিথিলা? ম্যানেজার স্যার খুব বকাঝকা করছেন শুনলাম।
মিথিলা দ্রুত কম্পিউটারের কী বোর্ডে আঙুল চালাতে থাকে।
রাকিব বলে ওঠে, ওই বিষয়টা নিয়ে তো!
মিথিলা বলে, রাকিব, একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছেন, সবাই সারাক্ষণ মি. হাবিবের নামে বলছে পেছনে, কিন্তু যেই আমি সামনা-সামনি তার বিষয়গুলো নিয়ে আসলাম, সিনারিও দ্রুত বদলে গেল।
হ্যাঁ, এমনই তো হওয়ার কথা। মেরুদণ্ড ভাইঙা সব চাকরি করতে আসছি, এখন নতুন কইর্যা বিপ্লবের ডাক কেউ দিবে না। ওই সব ভুইল্যা যান, ইউনিভার্সিটিতে কবর দিয়া রাখেন। চাকরি কইর্যা জান বাঁচান ফরজ, হা... হা... হা...।
মিথিলা বলে, আমি বিপ্লবের ডাক দিতে বলি নাই, খালি বলছি একটা লোক তার সব সুবিধা নিয়া লাঠি ঘোরাবে আর সব চুপ করে জি হুজুর করব, তা কেন? অন্তত আমি করতে পারব না।
মিথিলা মাথা ঠাণ্ডা করেন। হাবিব কিন্তু খুব বদ লোক, ওকে ঘাটাতে গেলে সমস্যা হবে। মাঝখান থেকে আপনি একা হয়ে পড়বেন, কেউ টুঁ শব্দ করবে না।
আপনি শব্দ করবেন, না মৌন থাকবেন?
আমি! আমি তো তেলাপোকা, আমার শব্দে কিছু আসবে যাবে না।
ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার ঘরে যেতেই মিথিলা অফিস থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকে উদ্ভ্রান্তের মতো। রাস্তার গাড়ি, মানুষ, রিকশা কিছুই তার চোখে পড়ে না, চোখে শুধু ডিজিট দেখে, লক্ষ লক্ষ ডিজিট। আঁকিবুঁকি সব চিহ্ন মাথায় ঘুরছে। একটা সার্কেলের মধ্যে বসে আছে সবাই, চারদিকে ধূপ-ধুনা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, আতিকের একটা ঝাপসা অবয়ব মনে আসে, কী স্বাপ্নিক ওর চোখজোড়া কিন্তু খুব নির্লিপ্ত। মিথিলার হাত ধরে বসে আছে ছেলেটা কিন্তু এ-কি এত ঠাণ্ডা কেন আতিকের হাত? কোনো প্রাণ নেই। ভেতরটা হু হু করে ওঠে কিন্তু মিথিলা জানে আর কখনো আতিকের কাছে ফিরে যাওয়া যাবে না। সেই আতিকও নেই, সেই মিথিলাও নেই। সব বদলে গেছে, গলার কাছে একটা মোলায়েম অনুভূতি জেগে ওঠে আতিকের জন্য। বাসে বসে বই খুলে বসলে টপ টপ করে পানি পড়ে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যায়। নাহ্। আতিককে সে খুব ভালোবাসে কিন্তু আতিক এমন কিছু করল যাতে সব শুকনো পাতার মতো মচমচ শব্দে ভেঙে গেল। যুক্তি দিয়ে সব বুঝেও নিজের যন্ত্রণা একটুও কমাতে পারে নি মিথিলা।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল আতিকের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, কিন্তু কীসের কী? মনের মধ্যে আতিকের জন্য একটা বন্ধনহীন অনুভূতি, তার অবয়বও নাই কোনো। সারাক্ষণ বোবা শব্দের মতো অস্থির করে মিথিলাকে। মিথিলা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষের কোলাহল আরো বেড়ে চলে, গ্রীষ্মের দাবদাহ কমে আসে, বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে সমস্ত শহর। গলির মোড়ের কদম গাছটায় ফুল আসে, সে ফুল ঝরেও যায়। বাসের নতুন কাউন্টার বসে, এসি বাস আসে, নতুন নতুন মানুষ আসে, মানুষে সয়লাব হয়ে যায় শহরটা। থিক থিক কাদার মতো, পা ফেলার জায়গা থাকে না। মিথিলার দিনগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে, কোনো বদল সেখানে ঘটে না। বাসের কিউ আরও দীর্ঘ হতে হতে গলির ভেতর পর্যন্ত চলে যায়। পিঁপড়ার মতো সারিবদ্ধ হয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে। মিথিলাও রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ভিড় ঠেলে প্রত্যেকদিন বাসে ওঠে। চাকরি বাঁচানোর জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় তবু রেড বুকে লেটমার্ক চলতে থাকে। মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে তার সাথে কথা বন্ধ করে দেয় মিথিলা।
মাঝে মাঝে মায়ের জন্য ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে মিথিলার, বাবার চেহারাটা অস্পষ্ট। দীর্ঘ চুলের এক নারী কাঁদছে, অনেক মানুষ, একজন খুব ফর্সা দেখতে লোক মার হাত ধরে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে যাচ্ছে, তার পাশেই ঝাঁকড়া চুলের মেয়ে। এরপরের দৃশ্য ঝাপসা... ট্রেন লাইন, ঝিক ঝিক. ট্রেনের সিøপারের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ, কোলাহল। গরমে মিথিলার কান দিয়ে ভাপ বের হতে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে মিথিলা বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। অগাস্টের শেষের দিকেও গরমে রাস্তার পিচ গলছে, আজকের কিউটা আরও দীর্ঘ। আজ তার লাইনে দাঁড়াবার ধৈর্য্য হয় না, লোকাল বাসের দিকে ছুটতে থাকে। বাসগুলো একটার পর একটা চলে যায়, কিছু লোক হুড়মুড় করে বাসের উপর হামলে পড়ে বাকিরা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ মিথিলাকে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হবে, সারারাত ঘুম হয় নি। চেয়ারম্যান থাইল্যান্ডে যাবে সেজন্য কিছু চিঠি রেডি করে দিতে হবে, খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিথিলা টেনশনে ঘামতে থাকে। কপাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরতে থাকে।
হঠাৎ পেছন থেকে এক ছেলে পিঠ স্পর্শ করে চলে যায়। মিথিলার সমস্ত শরীরে ইলেকট্রিক শক খেলে যায়, দ্রুত পেছনে ফিরে ভিড়ের মধ্যে বুঝতে পারে না, কে হতে পারে? ক্রমাগত বাসস্ট্যান্ডে ভিড় বাড়তে থাকে। বাসগুলো চলে যায় একটার পর একটা। মিথিলা মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় রাস্তার মোড়ে জ্যাম লেগে যায়, গাড়ি সব দাঁড়িয়ে। মিথিলা আরও অনেকের সাথে বাসের জন্য অপেক্ষায়, অনেকক্ষণ কোনো বাস আসে না। লোকজন বলাবলি করে, প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছে সেজন্য রাস্তা বন্ধ। কে একজন বলে, মিরপুরে তিনদিন বিদ্যুৎ নাই হের লেইগ্যা লোকজন রাস্তায় নামছে। মিনিটের কাঁটা ঘুরে ঘণ্টা পার হয়ে যায়, সব স্থিরচিত্র। অপেক্ষা, অপেক্ষা। হঠাৎ মিছিলের শব্দ শোনা যায়। একটা লম্বা মিছিল বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে আসে; মিছিলের অনেকের হাতে বড় বড় লাঠি, বাঁশ, পাইপ।
আমাদের দাবি মানতে হবে। বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
জ্বালো, জ্বালো, আগুন জ্বালো।
শ্লোগানের শব্দে মিথিলার মাথা ব্যথা শুরু হয়, বমি পায়।
জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও। মানি না। মানি না।
মিথিলার অস্থির লাগতে থাকে, গরমে উনুনের আঁচে পুড়তে পুড়তে হঠাৎ মায়ের যন্ত্রণাদগ্ধ মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেক লোক, ভিড়, ঝাঁকড়া চুলের মেয়ে, রেল লাইন... মিথিলা হঠাৎ দিশেহারা হয়ে যায়, দৌড়ে গিয়ে মিছিলের একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়, তার গায়ে যেন অসুরের শক্তি এসে ভর করে, লাঠি হাতে জ্যামে আটকে পড়া গাড়ির দিকে ছুটতে থাকে সে। পেছনে লাঠি হাতে কয়েকজন ছুটে আসে। মিথিলার মনে হয়, অসংখ্য লাঠি হাতে মানুষ তাকে তাড়া করছে। এলোপাথারিভাবে লাঠি দিয়ে বাসে আঘাত করতে শুরু করে সে। ঝুর ঝুর করে জানালার কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, একটা উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা। লোকগুলো দ্রুত পেছন থেকে মিথিলাকে পেঁচিয়ে ধরে ফেলে, হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। ধস্তাধস্তিতে মিথিলা রাস্তায় পড়ে যায়, হাত কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। লোকজন গোল হয়ে মিথিলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়, সকলের চোখে বিস্ময়, মিছিলের সামনে থেকে পুলিশের গাড়ি হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে আসে।
অনেকে বলতে থাকে মেয়েটার মাথায় গণ্ডগোল আছে । কী সব পাগল-ছাগল বাইর হইছে আজকাল। তুই লাঠি দিয়া গাড়ি ভাঙলি কেন, দেখলে তো শিক্ষিত মনে হয়।
মিথিলা ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়, মনে করতে পারে না এখন কোনদিকে যাবে? পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ঈশান, নৈর্ঋত কোনো দিকেই তার গন্তব্য খুঁজে পায় না, সব পথ যেন বন্ধ হয়ে গেছে, কোনো যানই আর কোথাও নিয়ে পৌঁছাবে না তাকে। অফিস; হ্যাঁ আজতো খুব সকালে অফিসে যাওয়ার কথা!