নভেরা হোসেনের গদ্য ‘সবুজফুল এক কবি রফিক আজাদ’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০

আশির দশকে ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন ক্লাস থ্রি কী ফোর, ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। শিক্ষক নাম কল করছেন। নভেরা নামটি ডাকতেই দাঁড়িয়ে বললাম, প্রেজেন্ট প্লিজ। আমার পেছনে বেশ গোলগাল ফর্সা একটি মেয়ে, সেও বলল, প্রেজেন্ট। এই নামের গণ্ডগোল থেকে জানতে পারলাম, ওই মেয়েটির নামও নভেরা আর তার বাবা একজন কবি। তখনও কবি শব্দের তেমন কোনো অর্থ আমার মাথায় ঢোকেনি। এরপর আমার ক্লাসে পেয়ে গেলাম নভেরার ভাই ইয়াসির আরাফাত রাহুলকে। রাহুলের সাথে সুন্দর বন্ধুত্ব হলো। এরা দুজনেই কবি রফিক আজাদের ছেলেমেয়ে। পরে জানতে পারলাম, উঁচু ক্লাসের লোপা আপাও কবির মেয়ে। নাইন টেনে উঠে যখন বইমেলায় যেতাম, টিএসসির দুইপাশে উঁচু ভলিউমে কবিতার ক্যাসেট বাজতে শুনতাম। সেখানেই শুনি, ভাত দে হারামজাদা, নাহলে মানচিত্র খাব...ভালবাসা পেলে... আরও কিছু অসাধারণ কবিতা।

ক্যাসেট কিনে এনে দিনরাত শুনতে লাগলাম রফিক আজাদসহ আরও কয়েক জনের কবিতা। সেই থেকে এই প্রতিভাবান কবির সাথে পরিচয়, তারপর ধীরে ধীরে কবিতা প্রেমের সাথে সাথে সমসাময়িক শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরীসহ রফিক আজাদের কবিতার সাথেও সখ্য গড়ে উঠল। খুব বেশি কমিউনিকেটিভ বলেই হয়তো তিনি আলাদা ভাবে মনে দাগ কেটেছেন। টাঙ্গাইলের জাহিদগঞ্জে এই গুণী কবির জন্ম হয় ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। টাঙ্গাইল ও নেত্রকোণা থেকে স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে কবি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেন। তারপর কবির দীর্ঘ কর্মময় জীবন সেই সাথে কবিতার পৃথিবীতে সন্তরণ। কাগমারী এম এম আলী কলেজের শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করে শেষ করলেন নেত্রকোণার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমিতে পরিচালকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। মাঝে ১৯৭২-১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকার নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর রোববার পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের পদে কিছুদিন ছিলেন।

এছাড়া বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের সাথেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। এ তো গেল কবির পেশাগত জীবন কিন্তু কবিতার শুরু শৈশবে এবং দিনে দিনে তাঁর কবিতা পৌঁছে গেছে সত্যিকারের কবিতার পৃথিবীতে। রফিক আজাদ এমন এক কবি, যিনি একই সাথে দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। জীবনকে তিনি দেখেছেন নিজস্ব এক ভঙ্গিমায়, ভালবেসেছেন গভীর অনুপম এক আনন্দ ও বেদনাবোধ থেকে। ভালবেসেছেন প্রকৃতিকে, মিশে গেছেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। উন্নয়নের প্রয়োজনে না বুঝেই মানুষ সাড়াশি দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে এ বসুন্ধরাকে। কবিতাতে আহত হন, ব্যথিত হন। কবির মনে প্রশ্ন জাগায় সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া, যাকে ঘিরে সময় বয়ে চলেছে। মানুষের লোভ আর বাসনার বলি হয় প্রকৃতি আর সেখানে সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সভ্যতার উল্টো পিঠে। কবির চুনিয়া এক ছোটগ্রাম, যে এই প্রাণঘাতি মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে একখণ্ড জ্বজ্বলে তারা হয়ে জ্বলছে।

তথাকথিত সভ্যতার হিংস্রতা ছোঁয়নি চুনিয়াকে, সেখানকার মানুষদের। এখান থেকেই হতে পারে নতুন যাত্রা, এই হচ্ছে কবির অভিপ্রায়। অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার, আগাছার কাহিনি, নবীন কাঠুরের উক্তি— এইসব সম্ভাষণের আড়ালে কবি জেগে ওঠেন কুয়াশার ধুম্রজাল ভেদ করে। তিনি এমন এক শক্তিমান কবি যিনি ভালোবাসার বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী, তিনি জানেন সব ফুরিয়ে গেলেও জানালায় জেগে থাকবে একটি তাজা ভোর, একটি কাকাতুয়া। মাধবীর গোপন ভালোবাসায় তিনি আয়ু পুঁতে রাখেন আর এক পলকের অবহেলায় তিনি হয়ে ওঠেন বাকসোময়। নীরবতা, হ্যাঁ একমাত্র নীরবতার মাঝে তিনি খুঁজে পেতেন প্রচণ্ড মুখরতা।

কবি রফিক আজাদের অসংখ্য কবিতার মধ্যে ‘ভাত দে হারামজাদা’ বাংলা অঞ্চলের এক অনন্য দলিল। এ সম্পর্কে কিছু আলাপচারিতা করাই যায়। কবি রফিক আজাদ এ কবিতায় সমকালীন এবং আবহমানকালের মানুষের মৌলিক চাওয়াকে একটি মাত্র বাক্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন যা অত্যন্ত, দূরহ এবং বিশিষ্ট একটি কাজ। কবিতা, কবি সবসময় নির্মোহ দ্রষ্টার ভূমিকায় থাকেন না তার অংশগ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। একজন দর্শক হয়ে কবি যেমন বিষয় এবং কালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন তেমনি শ্লোগান হয়ে সে উপস্থিত হন জনতার মঞ্চে, মাঠে-ঘাটে, মানুষের মনে। জনতা যা চায় তার আকুতি, চাহিদা, বাঁচার ন্যূনতম অবলম্বন একজন কবির মনস্তত্ত্বে গভীর প্রভাব ফেলে। কবিতায় সে হয়ে ওঠে আগ্রাসী, ক্ষুধার জ্বালায় সে সব করতে পারে, পেটের চাহিদা মিটলে সে ছেড়ে দিতে পারে বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, খ্যাতি। লাল রেশনের চালের ভাত, দু’বেলা পেলে অন্যসব দাবি সে ছেড়ে দিতে পারে।

এই বর্ণনাগুলোতে শাশ্বত সর্বহারা শ্রেণির ভেতরকার হাহাকার প্রকাশিত হয়েছে। হাজার বছর ধরে মানুষ অন্নের জন্য, বাঁচার জন্য লড়াই করে চলেছে প্রকৃতির সাথে, জমির সাথে, হায়েনারূপী মানুষের সাথে। যখন সমাজ ছিল গোত্রভিত্তিক তখনও গোত্রে গোত্রে পানি, জমি, পশু এই নিয়ে ক্রোন্দল ছিল। এখনও তেমনি আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জ্বালানি, ভূমি, পানি, কর্তৃত্ব, নের্তৃত্ব এসব নিয়ে ক্ষমতালোভি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের উপর অত্যাচার চালায়, নিপীড়ন চালায়, কর্তৃত্ব করতে চেষ্টা করে। আর তারই বলি হয় শত-সহস্রভুখা-নাঙ্গা মানুষ। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, গায়ের ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত ঝরিয়ে টিকে থাকাকে জানান দিতে হয়— তারাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

কবি রফিক আজাদ তার ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে, বাক্যে বাক্যে অভুক্তের, ক্ষুধার্তের আর্তনাদকে তুলে ধরেছেন। তার পেটের ক্ষুধা না মিটলে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন অন্যসব ক্ষুধাকে। যৌন ক্ষুধা, আরাম-আয়েশ এমনকী ক্ষুধার্তের চাহিদা না মিটলে দেশে, রাষ্ট্রে দজ্ঞযজ্ঞ কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছেন কবি। তখন থাকবে না তার কোনো দায়-দায়িত্ব, নিয়মের বালাই। সামনে যা কিছু পাবেন তার সবই গলাধকরণ করবে সে ক্ষুধার্ত। গাছপালা, নদীনালা, গ্রামগঞ্জ, পথচারী, খাদ্যমন্ত্রী এবং তার গাড়ি সবই চলে যাবে ক্ষুধার্তের পেটে। সর্বোপরি সে তার নিজের অস্তিত্বকেই খেয়ে ফেলবে অর্থাৎ মানচিত্রকেও খেয়ে ফেলবে, মুছে দেবে নাম-পরিচয়।

কবি এখানে অত্যন্ত দক্ষতা এবং নির্লিপ্ততার সাথে প্রকৃত ক্ষুধার্তের মনের ইচ্ছাকে কবিতায় প্রকাশ করেছেন। আপাতভাবে এজেন্ডাধর্মী মনে হলেও এ কবিতায় কবি সে ধরনের বৈশিষ্ট্যের বাইরে এসে ভাষার, দৃশ্যকল্পের আর অনুভূতির এক অসাধারণ মাত্রা তৈরি করেছেন। যেখানে বিশ্বের সর্বহারা, ক্ষুধার্ত, লাঞ্চিত-বঞ্চিত  মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা যায়। যেখানে কবি একটি কবিতার মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লবকে সমাপ্ত করেছেন। সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ কবিতায় তিনি অত্যন্ত সৎ ও নির্ভিকতার সাথে একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের নানা ভান-ভণিতা, নিয়ম-সংস্কার এসবকেও তিনি এ কবিতায় অগাহ্য করেছেন। একজন সত্যিকারের ক্ষুধার্তের প্রকৃত চিত্রকল্পই তিনি এঁকেছেন। আর এখানেই কবির ব্যতিক্রমশীলতা। কবিতার মতো এমন একটি সংযমী মাধ্যমে তিনি বিশিষ্ট একটি ফর্মকে নিয়ে কাজ করেছেন, বদলে দিয়েছেন তার ভাষা, বিষয় এবং অন্তস্থ অর্থময়তাকে।

এই কবিতাটিকে যদি রূপকধর্মী হিসাবে দেখা হয় তাহলেও যেকোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি ক্ষুধার্তের যেমন অনুভূতি হতে পারে তা এখানে মূর্ত। একজন শিল্পী, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী মানুষের মনের ভেতর যেসব ক্ষুধা, চাহিদা রয়েছে তা পাওয়ার জন্য যে আকুতির জন্ম হতে পারে তাকেও এ কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সেজন্য বলা যায়, ‘ভাত দে হারামজাদা’ প্রকৃত ক্ষুধার্তের একটি অনন্য দলিল।