নভেরা হোসেনের গদ্য ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদের জন্মদিনে স্মরণ’

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২২

স্কুলে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো তোমার নাম কি? উত্তরে নভেরা শুনে বলত, এটা কেমন নাম? আগে শুনি নাই। আবার অনেকেই ভুল উচ্চারণ করতো। পারিবারিক বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও নাম নিয়ে নানা কথা হতো। নামের অর্থ জানতে চাইত, কে নাম রেখেছে ইত্যাদি। আমার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন দার্শনিক ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনিই আমার নাম রেখেছিলেন। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, নভেরা নামের অর্থ কি? কেন রেখেছ এই নাম? সবাই জানতে চায় নভেরা কি? জানতে পারলাম নভেরা নামের অর্থ নতুন সময়, নো ভেরা ল্যাটিন শব্দ এবং এই নামে একজন আর্টিস্ট আছেন। অল্প বয়সে এইটুকুই জানতাম। আব্বা বলল, এই আর্টিস্টের একটা এগজিবিশন হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি সিঙ্গেল ছিলেন কিন্তু নভেরার কাজ দেখে এবং নামটি শুনে মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, যদি কখনো বিয়ে করেন এবং মেয়ে হয় তার নাম রাখবেন নভেরা। অল্প বয়সে ভাস্কর বা স্কাপট্রেস শব্দটা ততটা শুনিনি। যাই হোক, ধীরে ধীরে শিল্পীকে জানার জন্য মনের ভেতর অনুসন্ধিৎসা দেখা দিল। আব্বার কাছ থেকে যতটুকু জানলাম তাতে মন ভরল না। নভেরা আহমেদ দেশে থাকেন না, থাকেন ফ্রান্সে। কেন তিনি নিজের দেশে থাকেন না, তরুণ মনে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগত। দেখতে ইচ্ছে করত, তিনি কি বানিয়েছেন, এঁকেছেন। আমাদের অল্প বয়সে ঢাকায় কম্পিউটারের ব্যবহার খুব কম ছিল। এটা পঁচাশি থেকে নব্বই সালের ঘটনা। তখন বাসায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা রাখা হতো। বিচিত্রার একটা সংখ্যায় নভেরা আহমেদকে নিয়ে ফিচার ছাপা হলো, আমি হামলে পড়লাম। প্রচ্ছদে ছেনি, বাটাল নিয়ে কাজ করছে অদ্ভুত তীক্ষ্ণ, মেধাবী এক তরুণী। একটা ফটোগ্রাফ যে কত কথা বলতে পারে, তা এই ছবিটা না দেখলে বোঝা যাবে না। ওই বয়সে যা বোঝার বুঝে গেলাম। নিশ্চয়ই এ লেখক, কবি তথা সৃষ্টিশীল যে কোনো মানুষের জন্যই স্ট্রাগলের বিষয় যে, তাকে নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয় এবং তা ফর এভার। হ্যাঁ, এমন নয় যে শিল্পী বা কবিরা প্রবাসী হন না বা হলেই তার পেছনে কোনো রক্তাক্ত স্মৃতি থাকতে হবে। এমনকী সৃষ্টিশীল মানুষেরা টেস্ট বদলের জন্যও নানা দেশ, স্থান ভ্রমণ করে থাকেন। অনেকে প্রবাসে স্থায়ীভাবেও থাকেন, এটা অনেক সময় তাদের কাজ, চিন্তা, দর্শনের জন্য স্বাস্ব্যকর। বিচিত্রায় নভেরাকে পেলাম প্রথম লিখিত ডকুমেন্টে। আধুনিক ভাস্কর্য সম্পর্কে তার জানাশোনা এবং কাজেও নিজস্ব মেধাকে ব্যবহার করে সৃজনশীল ভাস্কর্য নির্মাণ তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরকম একটা বিষয় সবাই মিলে কেমন করে ভুলে গেল বা তাকে অনেককাল বিস্মৃত হতে দিল, তা একটা গবেষণার বিষয়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে একটি স্মৃতি স্তম্ভের মাধ্যমে জাগ্রত রাখার চিন্তা থেকেই শহীদ মিনারের সৃষ্টি। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ যেমন শুধু একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নয় বরং সেই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কুতিক বিকাশের জন্য এই যুদ্ধ। তারই একটি প্রারম্ভিক বিষয় হিসেবে বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। যখন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের নেতা কায়েদে আজম জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ঘোষণা করলেন বাংলা নয় উর্দুই হবে তৎকালিন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কখন পৃর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণ নিজেদের মুখের ভাষা অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবে আন্দোলন শুরু করে এবং তারই প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। এই যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, জনগণের সেক্রিফাইস তাকে একটা সৌধ বা মিনারের মাধ্যমে শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য শ্লোগান সৃষ্টি হয়েছিল, শহীদ স্মৃতি অমর হোক। কিন্তু শহীদ স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য প্রতীক চাই। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বায়ান্নর তেইশে ফেব্রুয়ারি, এক রাতের মধ্যে তৈরি করে শহীদ মিনার। ছাত্ররা ইট, বালু এনে শহীদ মিনার তৈরি করে আর প্রথম শহীদ মিনারের নকশা তৈরি করেছিলেন সাঈদ হায়দার আর রেখায় বদরুল আলম। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দুপুরে পাকিস্তানের নাজিমুদ্দিন, নূরুল আমীনের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালির প্রথম শহীদ মিনারটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। এরপরে ৫৩ থেকে ৬২, দশ বছরের মধ্যে প্রথম তিন বছর নিশ্চিহ্ন মিনারের কাপড় ঘেরা স্থানটি আর বাকি বছরগুলো শহীদ মিনারের জন্য স্থাপিত ভিত্তিটাই এদেশের মানুষের শহীদ মিনার ছিল। ৫৪ এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সরোওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক একুশ দফায় শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ঘোষণা এবং নূরুল আমিনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমী করার শপথ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। বর্তমান শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে ছাপান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য আবু হোসেন সরকার জুতা পায়ে আসলে জনতার মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয় এবং আবু হোসের জুতা খুলতে বাধ্য হন।

৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক পার্টির মন্ত্রী-সভার পতন ঘটে এবং পূর্ব-বাংলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। লীগের আমলে শহীদ মিনারের কাজ কিছুটা আগায়। সাতান্ন সালের তেসরা এপ্রিল আইন-সভায় বাংলা-একাডেমি অ্যাক্ট ১৯৫৭ পাস হয়। আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে শহীদ মিনারের পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয় চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ হামিদুর রহমান জব্বারকে। ৫৬ সালে হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদ দেশে ফিরে এলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীন শিল্পী হামিদুর রহমানকে অনুরোধ জানান শহীদ মিনারের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের। শহীদ মিনারের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে এত কথা বলার কারণ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের পাশে যে শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয়েছে তার রূপকার নভেরা আহমেদ এবং হামিদুর রহমান। এই সত্য তথ্যটি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ডেইলি অবজারভারে প্রকাশিত হলেও সরকারি কাগজপত্রে কোনো অজানা কারণে নভেরা আহমেদের নামটি ছিল না। এ বিষয়ে The Pakistan Observer এর বাক্যটি ছিল …The memorial has been designed by Mr. Hamidur Rahman in collaboration with Miss Novera Ahmed…এবং নভেরা আহমেদ এবং হামিদুর রহমান যৌথভাবে শহীদ মিনারের ডিজাইন, পরিকল্পনা সব করা সত্ত্বেও শিল্পী হামিদুর রহমান কোনো অদ্ভুত কারণে কখনো এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি শহীদ মিনার সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার দিলেও সেখানে নভেরা আহমেদের নাম উল্লেখ পর্যন্ত করেন নাই। এবং বহু বছর প্রায় আশির দশক পর্যন্ত নভেরা আহমেদ যে শহীদ মিনারের একজন রূপকার এবং তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি ভাস্কর্য শিল্পের একজন পথিকৃৎ, তা বাংলাদেশে খুব কমই আলোচনা হয়েছে এবং তার প্রবাস জীবন এবং নীরবতার অর্থ কেউ জানতে চাইনি, অনুভব করতে পারেনি বা করলেও তার কোনো আভাস সমাজে দেখতে পাওয়া যায়নি বিশেষত শিল্পী সমাজে।

শহীদ মিনারের মূল যে স্তম্ভটি, যাকে মাতৃমূর্তির রূপক মনে করা হয় তার আনতভঙ্গি তবে প্রথমে যে শহীদ মিনার তৈরি করা হয় তা কৌণিক ছিল না এবং তা নভেরার পক্ষেই করা সম্ভব বলে শিল্পী সমাজের অনেকে মনে করেন। বর্তমানে আমরা যে শহীদ মিনার দেখি তার ডিজাইন ভিন্ন রকম ছিল। তিনটি মিনারের নিচে স্টেইন গ্লাসের কাচ ছিল এবং হামিদুর রহমান এবং নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য ছিল মূল ডিজাইনে যা পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। ভাস্কর্য একটি অতি প্রাচীন শিল্প-মাধ্যম। মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষার আগে সাইন ল্যাঙুয়েজ এর সূচনা ঘটে এবং মাটিতে গাছের ডাল দিয়ে বা পাথরে পাথর দিয়ে খোদাই করে মানুষ অনেক মনের ভাব প্রকাশ করত। এটা গুহা সমাজের সময়কার কথা এবং ঠিক সে সময়েই মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যে সাইনের ব্যবহার হয় তা অনেকটা বাস্তব জীবন বা বস্তুর প্রতিচ্ছবি এবং মানুষ তার সাথে মনের কল্পনা মিশিয়ে আঁকতে শুরু করে, পাথর কাটতে শুরু করে; তৈরি করে নানা রকম টোটেম, বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি, সে অর্থে ভাস্কর্য শিল্পে প্রথমত দেব-দেবতার অবয়ব এবং বাস্তবের কপি তৈরির সূত্রে বিকশিত হয়। পরে আধুনিক ভাস্কর্য চর্চা শুরু হয় যা অনেকটা মূর্ত এবং বিমূর্তের মিশেল। বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো মূলত পোড়ামাটির, দেয়ালে ফ্রেসকো, রিলিফের আকাওর কোনো ধর্মীয় কাহিনী বিশেষ করে হিন্দু-বৌদ্ধ মিথলজিকে প্রকাশ করেছে । বাংলা অঞ্চলে যেহেতু ১২ শ শতকের পরে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে সে কারণে তার আগের সময়ের ভাস্কর্যগুলোতে হিন্দু দেব-দেবতার প্রাধান্য , কিছু ক্ষেত্রে বৃক্ষ, লতা, প্রাণীর অবয়বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলে মূলত দুধরনের ভাস্কর্য চর্চা প্রচলিত ছিল। একটি ছিল মন্দির, বিদ্যাপীঠকে ঘিরে, অন্যটি ব্রাত্যজন, সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজের অনুসঙ্গ হিসেবে, খেলার অনুসঙ্গ হিসাবে মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া, পাখি, দেব-দেবতার অবয়ব তৈরি করত। এসব কাজ মূলত নক্সাধর্মী এবং বাস্তবের ট্রু কপি কিন্তু যখন থেকে আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা ঘটল এবং বলা যায় ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পূর্ব এবং পরবর্তী সময়কালের মধ্যেই ঘটেছে। আধুনিক ভাস্কর্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট হচ্ছে তা ঘরের ভেতর, কোনো উপসনালয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে না তাকে এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে আধুনিক শহরগুলো সাজানো হবে ভাস্কর্য দিয়ে। এটা ইউরোপে শুরু হয়েছে। রোম, ভেনিসসহ ইউরোপের দেশগুলোতে ভাস্কর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ শহরকে সাজানোর জন্য। নভেরা আহমেদও সেই চিন্তার ধারক-বাহক। তার কাজ, চিন্তা, জীবন-যাপন সবকিছুই সেই ঋজু, স্বয়ম্ভূতার প্রতীক। তা নিয়ে আলোচনার আগে ব্যক্তি নভেরা সম্পর্কে কিছু জানা যাক।

নভেরার জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ আছে । কোথাও উল্লেখ ১৯৩০ অথবা ১৯৩৫। ১৯৩৯ এর কথাও বলা হয়েছে অনেক লেখায়। নভেরার বাবা সৈয়দ আহমেদ কোলকাতায় চাকরি করতেন। কোলকাতার লরেটো থেকে নভেরা মেট্রিকুলেশন করেছেন। ওখানে থাকতেই সাধনা বোসের কাছে নাচ শিখেছেন, গানও গাইতেন। দেশভাগের পর নভেরার বাবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায় বদলি হন ১৯৪৭ সালে। আর নভেরার বিয়ে হয় ১৯৪৫ সালে ১৪ বছর বয়সে এক পুলিশ অফিসারের সাথে কোলকাতায়। বিয়েতে নভেরা সম্মত ছিলেন না এবং এ বিষয়ে নানা মত রয়েছে তবে নভেরার বড় বোন কুমুম হকের মতে, নভেরার বিয়ের পরই ডিভোর্স হয়ে যায়। দেশ বিভাগের পর নভেরার বাবা বদলি হয়ে কুমিল্লায় এলে নভেরা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। পরে বাবার অবসরের পর তাদের আদি নিবাস চট্রগ্রামে চলে যান। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের সেচ বিভাগের বাড়ি গডস গিফটে এসে ওঠেন স্বপরিবার, এটা বড় বোন কুমুম হকের হাসবেন্ডের বাড়ি ছিল। পওর ১৯৪৮ সালে আশকার দীঘির পাড়ে নভেরার বাবা বাড়ি তৈরি করেন তবে সে বাড়িতে তারা থাকেন নি, ভাড়া দেয়া ছিল। এর অনেক পরে নভেরার বাবা ঐ বাড়ির পাশে আরেকটি বাড়ি করেন, সেখানে একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁকে ভাড়া দেয়া ছিল। নভেরা আহমেদরা চার বোন । বড় বোন কুমুম হক, মেজো বোন পিয়ারী, সেজো নভেরা, ছোট তাজিয়া। বাড়িতে নভেরাদের পরিবেশ শিল্প-সাহিত্য চর্চার উপযোগী ছিল। নভেরার মা নিজেও মাটি দিয়ে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল বানাতেন, টিন কেটে পুতুল বানিয়ে রঙ করতেন। মায়ের শিল্পী চরিত্রের প্রভাব হয়তো নভেরার মধ্যে পড়ে ছিল। ছোট বয়সে তিনি খুব দুরন্ত ছিলেন, ডানপিটে। নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করে ছাড়তেন। চট্রগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল। নজরুল জয়ন্তীতে চট্রগ্রামের জুবিলী হলে নেচেছিলেন এবং নাচ নিজে কম্পোজিশন করেছিলেন। এ সময়ে নভেরার বাবা-মা অস্থির হয়ে ওঠেন বিয়ের জন্য কিন্তু শিল্পী সিদ্ধান্ত নেন লন্ডনে গিয়ে ভাষ্কর্য নিয়ে পড়বেন, বোন শরীফাকে চিঠি দিয়েও জানিয়ে ছিলেন। তবে তার বাবার ইচ্ছে ছিল ব্যারিস্টারি পড়ার বিষয়ে।

নভেরা লন্ডনে যান ১৯৫০ সালে। সেখানে তার মেজো বোন শরীফা আলম বিবিসির একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। তখন বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন নাজির আহমেদ। নাজির আহমেদের ছোট ভাই হামিদুর রহমান তখন ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন, তার সহযোগী ছিলেন আমিনুল ইসলাম। নভেরা যখন লন্ডনে আসেন হামিদুর রহমান তখন লন্ডনে ছিলেন নাজির আহমেদের ফ্ল্যাটে, সেখানেই তার সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ব। পরে নাজির আহমেদ হামিদুর রহমানকে প্যারিসের রোজ আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেন। তবে হামিদ প্যারিস থেকে লন্ডনে চলে আসেন, সেখানে সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টে ভর্তি হন। নভেরা ১৯৫১ সালে ক্যাম্বার ওয়েল স্কুল অফ ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের মডেলিং ও স্বাপচার কোর্সে ভর্তি হন। ওই সময়ে ওই স্কুলের ভাষ্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ডক্টর ক্যারেল ফোগেল Karel Vogel। ফোগেল বিশ্বাস করতেন পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে মানবদেহের সৌন্দর্যের মধ্যে চিরন্তনতা রয়েছে এবং একে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে শিল্পের নতুন দিক উন্মোচন সম্ভব। ছাত্রদের মধ্যে তিনি মডেলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈচিত্র্যের প্রতি অনুভব জাগিয়ে তুলেছেন। ১৯৫৫ সালে নভেরার প্রত্যয়নপত্রে অধ্যাপক লিখেছেন, Her studies from life shows strong sense of observation, and certainly there is originality and depth of thought in her compositions. Her portraits head her full of life.Though in general working in the European way Miss. Ahmed’s sculptures shows how indelible is the unconsciousness influence of Eastern monumentality and traditions…The personality developed here well, I am convinced, become a first artist and inspiring teacher, given the necessary help and opportunity.

ইংল্যান্ড ছাড়াও নভেরা ভেনিস, প্যারিস এবং ইউরোপের আরও কয়েক জায়গায় গিয়েছিলেন সেই সময়ে এবং সেসব জায়গার ভাস্কর্য দেখেছেন। ইংল্যান্ডে এপস্টাইন, গদিয়ের, ব্রেসকা, ম্যাকগিল এঁদের হাতেই বিশ শতকের শুরুতে আধুনিক ভাস্কর্যের বিকাশ ঘটেছে। হেনরি মুর, বারবারা হেপওয়ার্থ আধুনিক ভাস্কর্যের বিকাশ ঘটান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ভাস্কররা নির্দিষ্ট কোনো শিল্প ভাবনায় স্থিত না থেকে নানা স্টাইলের মধ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, বিভিন্ন ধাতু দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করতে শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমান একসাথে ফ্লোরেন্সে যান। সেখানে শিল্পী আমিনুল ইসলামের হোস্টেলে ওঠেন দুজনে পরে একটা স্টুডিওতে ওঠেন। ইতালিতে তিনি ভেন্তুরিনা ভেন্তুরির কাছে কাজ শেখেন। ইতালিতে শিল্পী দোনাতেলাসহ অনেক শিল্পীর কাজ দেখেন। ফ্লোরেন্স থেকে নভেরা এবং হামিদুর রহমান প্যারিসে রঁদার মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে হামিদুর প্রথমে দেশে আসেন পরে নভেরা আসেন। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের উদ্যোগে পাবলিক লাইব্রেরিতে হামিদুর ও নভেরার একত্রে কাজ পান। সেখানে হামিদুর ফ্রেসকো করেন, নভেরা দেয়ালের অর্ধেকটা জুড়ে লো রিলিফ করেন। সম্পূর্ণ কালো রঙে কাজটি করা হয়েছে এবং ত্রিমাত্রিক। হাতি-ঘোড়াসহ পুরো কাজটি বাংলার মাটির টেপা পুতুলের ফর্মে করা হয়েছে। দেয়ালচিত্র সাধারণত দ্বিমাত্রিক হয় কিন্তু এ কাজটি ত্রিমাত্রিক করা হয়েছে, এটাই তার কাজের ব্যতিক্রমী দিক। মাটির পুতুল এ অঞ্চলে কালো রঙে এবং পটটিকে কয়েকটি আয়তাকার ও বর্গাকারে বিভাজন করেছেন। এ কাজের সাথে লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যের কাজ শুরু করেন তবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে কাজটি থেমে যায় এরপরে তিনি এয়ারপোর্ট রোডে একজন ব্যবসায়ীর বাড়ির প্রাঙ্গণে কাজ করেন। সেখানে গরু ও মানুষের অবয়বকে সিমেন্টের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

১৯৬০ সালে পাবলিক লাইব্রেরিতে নভেরার প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়, নাম ইনার গেজ। এই প্রদর্শনীটিতে নভেরা এ অঞ্চলে প্রথম আধুনিক ভাস্কর্যের উপস্থাপন করেন। পূর্বের পুতুল, দেব-দেবতার মূর্তি এসবের বদলে তার কাজের মধ্যে সাধারণ ব্রাত্যজনের ঘর-গৃহস্থালী, জীব-জন্তু, হাতি-ঘোড়া, শিশুকে অন্য ফর্মে উপস্থাপন করেন। পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ১৯৬০ সালের ৭ অগাস্ট রোববার বিকালে অন্তর্দৃষ্টি Inner Gaze শীর্ষক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান। ঐ অনুষ্ঠানে নভেরাকে ১০ হাজার টাকা দেয়া হয় সম্মাননা স্বরূপ। দশ দিন ব্যাপী চলা এই প্রদর্শনীটিতে ভাস্কর্যগুলো লাইব্রেরির প্রাঙ্গনেও প্রদর্শন করা হয়। মোট পঁচাত্তরটি কাজ এ প্রদর্শনীতে স্থান পায়। অন্তর্দৃষ্টি শীর্ষক প্রদর্শনীর পর আরও কিছুদিন তিনি ঢাকায় থাকেন পরে লাহোরে চলে যান। সেখানে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সাংবাদিক এস এম আলী তার দ্বিতীয় প্রদর্শনীর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি পাকিস্তানের দুই অংশের শিল্প-সমালোচক, শিল্পী সমাজ ও দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এটিই ছিল পাকিস্তানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো স্বীকৃত একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আর নভেরার ভিন্নধর্মী কাজের উপস্থাপনা এক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রদর্শনীতে গভর্নর-পত্নী মিসেস আজম খান, পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির পূর্বাঞ্চল শাখার সদস্যা ড. ফাতিমা সাদেক, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, কবি ফয়েজ আহমেদ, লাহোর আর্ট কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল শিল্পী শাকির আলী, শিল্পী জয়নুল আবেদীনসহ অনেকে। লাহোরে আয়োজিত জাতীয় চিত্রশালা, ভাস্কর্য ও ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে নভেরা ভাস্কর্য মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার (রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার) লাভ করেন। তার পুরস্কারপ্রাপ্ত কাজটি ছিল একটি বালকের মুখাবয়ব (প্লাস্টার বা সিমেন্টের তৈরি), নাম Child Philosopher. Contemporary Arts in Pakistan পত্রিকায় প্রকাশিত ডি এস ওয়াটসনের লেখা থেকে জানা যায় ঐ প্রদর্শনীটিতে নভেরার অন্যান্য কাজ ছিল সেগুলো হচ্ছে, কোয়ার্টার রিলিফে অ্যাবস্ট্রাক্ট প্যানেল, অন্যটি exterminating angel, ছয় ফুট উচ্চতার এই কাজটিতে স্টাইলাইজড ভাস্কর্যটিতে শকুনের শ্বাসরোধকারী একজন নারীর অবয়ব। নভেরার এই কাজটিতে নারীর হাতে নৃশংসতার প্রতি প্রতিবাদের সিম্বল হিসাবে কাজটি উল্লেখযোগ্য।

Child Philosopher তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়া মমতাজ দৌলতানার ব্যক্তিগত সংগ্রহে স্থান পেয়েছে। exterminating angel আর Female Form প্রয়াত ড. রিয়াজ আলীর সংগ্রহে রয়েছে। ঢাকায় ১৯৬০ সালে পাবলিক লাইব্রেরিতে যে কাজগুলো প্রদর্শিত হয় তার সাথে পাকিস্তানের প্রদর্শনীর কাজের ভেতর ব্যাপক পার্থক্য। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে নভেরা নৃত্যে প্রশিক্ষণের জন্য বোম্বে যান, সেখানে কবি ইশমত চুগতাইয়ের বাসায় অবস্থান করেন এবং অভিনেত্রী বৈজয়ন্তিমালার কাছে কিছুদিন ভারত নাট্যম শেখেন। সেখানে একটি দুর্ঘটনায় নভেরা পায়ে আঘাত পান এবং লাহোরে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে তিনি আরেকটি কাজের কমিশন পান কিন্তু কাজটি কোথায় সংরক্ষিত আছে তা জানা যায় না। তৎকালীন পাকিস্তানে নভেরার কাজ একটি নতুন ধরনের চিন্তা-ভাবনার সূচনা তৈরি করে দেয় যা পরের প্রজন্মের ভাস্করদের কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। Contemporary Arts in Pakistan পত্রিকায় ডি এস ওয়াটসন নভেরা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ” No discussion of Pakistan art would be complete without reference to her[Novera ahmed. নভেরা আহমেদের কাজে বারবারা হেপওয়ার্থ ও হেনরী মুরের ভাস্কর্যরীতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাশ্চাত্যেও শিল্প রীতির সাথে দেশীয় বিষয়বস্তু ও উপকরণের সমন্বয় ঘটানো। লাহোর থেকে নভেরা প্যারিসে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থাতেই ব্যাংককে ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার একক প্রদর্শনী হয়। ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এস এম আরীই এ প্রদর্শনীর মূল উদ্যোক্তা ছিলের। প্রপাপ্ত ক্যাটালগের ভিত্তিতে বলা যায় ব্যাংকক আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের আয়োজনে নভেরার প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১৪-২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আয়োজকদের ভবনে (২৯, থানন সার্থন তাই)।

থাইল্যান্ডের তৎকালীন ভাস্কর্য চর্চার প্রেক্ষিতে নভেরার কাজ ছিল বিপ্লবী কাজ। তিনি মূলত ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ সরঞ্জামকে ব্যবহার করে ভাস্কর্য তৈরি করেন। মেটাল, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি মাধ্যমে কাজগুলো করা হয়। ব্যাংককে একটি স্টুডিওতে তিনি কাজগুলো করেন। মূলত যুদ্ধের ভয়াবহতাকে তুলে ধরার জন্য তিনি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ব্যাংককে তার সাথে ফটোগ্রাফার বন্ধু গ্রেগোয়া রু ন ব্রুনস (গ্রিশা) এসেছিলেন। গ্রেগোয়া জন্মগতভাবে রুশ কিন্তু আজন্ম ফ্রান্সে ছিলেন।১৯৫৬ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত নভেরা দেশে ছিলেন এবং তার প্রারম্ভিক কাজগুলো করেন। পাশ্চাত্যের টেকনিক, চিন্তাধারা ইত্যাদির সাথে দেশীয় উপাদান, সাবজেক্টকে সমন্বয় করে নভেরা কাজ করেন, যা একজন প্রকৃত শিল্পীর এটিটিউড। একজন শিল্পী তার সংস্কৃতি, ভাষা হতে দূরে চলে গেলেও তার মন এবং কাজে তার প্রভাব রয়ে যায় খুব সূক্ষভাবে হলেও। ইউরোপে ব্রোঞ্জ ও অন্যান্য ধাতু দিয়ে কাজ হতো যা এখানে করা কঠিন ছিল, নভেরা লোহার রড়ের খাঁচা তৈরি করে তার উপর সিমেন্ট আর সুরকি দিয়ে কাজ করতেন আর কাঠের কাজ করতেন।

১৯৭০ এর পর নভেরা স্থায়ীভাবে প্যারিসে থাকতে শুরু করেন। এবং তখন থেকেই দেশের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় এবং যোগাযোগ একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধু ব্যাংকক পোস্টের সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে নভেরার একবার দেখা হয়েছিল। এ সময়টাতে নভেরা এতটাই আত্মগোপন করেছিলেন যে, এস এম আলী শুনেছিলেন নভেরা আর নেই। এটা ১৯৮৯ সালের কথা। ১৯৯৪ সালে নভেম্বরে সংবাদের সাহিত্য পাতায় নভেরার বিষয়ে লেখেন মেহবুব আহমেদ। আর ১৯৯৭ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই একুশে পদকের জন্য তার নাম ঘোষিত হয়। তবে তিনি পদক নিতে এদেশে আসেননি। ১৯৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষে নভেরা আহমেদের একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় শাহবাগের জাদুঘরে। জাদুঘরের একটি হলের নামকরণও করা হয় শিল্পীর নামে। ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জানান নভেরা বেঁচে আছেন এবং দূতাবাসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। প্যারিসে বসবাস করেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন এবং তার স্ত্রী আনা ইসলাম। আনা ইসলাম নভেরার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে তার সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে সক্ষম হন।প্যারিসে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে নভেরা নতুন একটি পাসপোর্টের জন্য প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকতিয়ার চৌধুরীর সঙ্গে বলেন। নভেরা তার সাথে একবারও বাংলায় কথা বলেননি এবং বাংলা লিখতেও অপরগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়টি থেকে মনে হয় শিল্পী কোনো প্রচণ্ড আঘাত বা আত্মমর্যাদা লঙ্ঘিত হওয়ার কারণে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ প্রচণ্ড স্পর্শকাতর হতে পারেন, শহীদ মিনারে তার অবদানকে অস্বীকার করা এবং তৎকালীন সময়ে তার কাজের প্রতি, তার ব্যক্তিত্বের প্রতি যে মনোভাব দেখানো হয়েছে তাতে তিনি ভীষণভাবে অপমানিত এবং মানসিকভাবে আহত হন।

৬০ এর সমসাময়িককালে নভেরা আহমেদ যে ধরনের ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ঢাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে চলাচল করতেন, কাজ করতেন তাকে বুঝতে পারা বা গ্রহণ করার মতো মন-মানসিকতা, ম্যাচুউরিটি তখনকার বাঙালি সমাজে দুর্লভ ছিল এবং এখনও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি সে চিন্তা-চেতনার। এখন সমাজে অনেক ধরনের কাজ-কর্ম চললেও সামাজিক মোবিলিটি তৈরি হলেও ভেতরে ভেতরে রক্ষণশীল মন-মানসিকতা, পুরানো আইডিয়া, দর্শনকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা রয়ে গেছে। এটা মজ্জাগত। পহেলা বৈশাখের মতো সামাজিক উৎসবে দলবদ্ধভাবে নারী তথা মানুষকে হয়রানি করা হয়, সাইবারযুগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন হয়রানি এবং মানসিক ও সামাজিকভাবে হয়রানি করা হয়। তখনকার সমাজের চাইতে এখন এর মাত্রায় ডায়মেনশন তৈরি হয়েছে। একজন কবি, দোকানদার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রকাশ্যে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নানারকম হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড করে থাকেন। এ অবস্থার বিবেচনায় মনে হয় নভেরা আহমেদ যে ধরনের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়ে চলতে চেয়েছেন, কাজ করেছেন, করতে চেয়েছেন তা তখনকার বাঙালি সমাজের জন্য বোধগম্য পর্যন্ত ছিল না। একজন শিল্পী সে নারী বা পুরুষ যে জেন্ডারেরই হন না কেন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তার শিল্পী সত্তা। সেই শিল্পী সত্তা যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন স্বভাবতই সে অনেক সময় নীরবে তার প্রতিবাদ জানায় বা সে স্থান ত্যাগ করে। শিল্পী, কবি বা লেখকরা তার কাজের মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তিত্বের মধ্যে দিয়ে এই প্রতিবাদটা করেন। সবসময় সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ন হন না হয়তো। এটা একেকটা ধরন মানুষের। নভেরাও তার সময়কালে যে ধরনের উপেক্ষার সম্মুখীন হন, সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তা তাকে এ দেশ-স্থান ছাড়তে বাধ্য করে। তিনি একজন প্রকৃত শিল্পী, যে তার কাজটাকে বড় করে দেখেছেন ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে। তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে এ দেশে বা অঞ্চলে তিনি যে মাধ্যমে কাজ করেন তা নিয়ে সে সময়ে খুব বেশিদূর আগানো কঠিন হবে এবং লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণেও বাধাটা অনেক প্রকট ছিল। তিনি চেয়েছেন নিজের কাজটা করতে, তাকে শিল্পোত্তীর্ণ করতে এবং এজন্য তার এ স্থান ছেড়ে বসবাসের জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নেয়ার প্রয়োজন যেখানে সমাজ শিল্পীকে সহজভাবে গ্রহণ করে। সব শিল্পী-সাহিত্যিকদের মানসিক গঠন একরকম থাকে না। নিজের দেশে থেকে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা বা কাজ বন্ধ করে দেয়া নভেরা হয়তো ঠিক এমনটা চাননি। তিনি চেয়েছেন যে কোনো জায়গায় থেকেই তার যে কাজের ইচ্ছা তাকে বাস্তব রূপ দেয়া।

শিল্পী বা কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে স্থানটা অনেক সময় গৌণ হয়ে পড়ে। আবার এমনটা হতে পারে এবং সে সম্ভাবনাই বেশি তিনি আর এখানে কাজ করতে পারছিলেন না, তাকে কোনো কাজে যুক্ত হতে দেয়া হচ্ছিল না। একজন শিল্পী হিসাবে সেটা খুবই যন্ত্রণার। বিশেষত তিনি যে মাধ্যমে কাজ করেছেন তার জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন হয়, তার ব্যবস্থাপনা করতে হয়। এ নিয়ে অনেকের লেখা থেকে জানা যায় নভেরা ঢাকায় এক্সিবিশন করেছিলেন তাছাড়া আরও দুটো কাজ করেছিলেন। একটা এয়ারপোর্ট রোডে যা ফ্যামিলি নামে পরিচিত অন্যটি চট্রগ্রামের রেকিট অ্যান্ড কোলম্যানের জন্য। এছাড়া ঐ সময়ে তার তেমন কোনো প্রফেশনাল কাজের খোঁজ পাওয়া যায় না যা তাকে অর্থনৈতিকভাবে সার্ভাইভ করতে হয়েছে সাহায্য করেছিল। তিনি বন্ধু শিল্পী হামিদুর রহমানের বাবার বাড়ি পুরান ঢাকায় কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন, পরে এয়ারপোর্ট রোডে কাজ করার সময় তেজগাঁতে বাসা ভাড়া নেন। ব্যাংককে কাজ করার পর তিনি প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। ব্যাংককের কাজগুলো আগের কাজ থেকে কিছুটা ভিন্ন ধারার এবং মাধ্যমের ছিল। বেশিরভাগই ঝালাই এবং ধাতু জোড়া দিয়ে করা হয়েছে। রড, ধাতব পাত, উড়োজাহাজের টুকরো জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়া স্টেনইলেস স্টিল, তামা এবং ব্রোঞ্জের ব্যবহারও করেছিলেন। ব্রোঞ্জের একটি সাত ফুট উঁচু নারী মূর্তিও করেছিলেন। পিকাসোর কিউবিস্ট ধারার প্রভাব এ কাজগুলোতে স্পষ্ট। নভেরার কাজের একটা গুরুত্বপূণ দিক হচ্ছে, ঋজুতা ও বিচ্ছিন্নতা। কাজটি নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে তার পরিচয়কে স্পষ্ট করে। ১৯৬৮ সালে zebra crossing নামে একটি কাজ করেন স্টিলে ঝালাই করে। মায়ানমার ভ্রমণের পর তিনি বৌদ্ধের মুখাবয়ব নিয়ে কাজ করেন যা উল্লেখযোগ্য। ভাষ্কর নভেরা আহমেদের কাজ নিয়ে কথা বলাটা সহজ নয় বিশেষত একজন সাধারণ দর্শকের পক্ষে তবে আমি এক্ষেত্রে সে কাজটিই করতে চাচ্ছি কেননা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিল্পকর্ম, মিউজিক এসব শুধুমাত্র সমালোচক বা বিশেষজ্ঞের ক্রিটিকের বিষয় নয়। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে এ কাজের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে মানুষের মনে সেটা একটা গুরম্নত্বপূর্ণ ডিসিপ্লিন। ভাস্কর্যও তেমনি সকল মানুষের জন্য তার আনন্দ, বেদনা, সৌন্দর্য জীবনের একটি স্বাভাবিক অনুসঙ্গ, বিশেষত নভেরা যে ধরনের কাজ করতে চেয়েছেন, করেছেন তা উন্মুক্ত স্থানে, নগরের, গ্রামের আর দশটা বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্নভাবে মিশে থাকবে, একটি রিদমিক আবহ তৈরি করবে এটাই নভেরার চাওয়া ছিল হয়তো।

বাংলা অঞ্চলের মৃৎশিল্প, টেরাকোটা, টেপাপুতুলের সাথে যোগ হয়েছিল হেনরি মুর, পিকাসোদের চিন্তা-ধারা। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে নভেরার ৩৩টি কাজ সংরক্ষিত আছে। তার মধ্যে ১৫টি কাজ দেখতে পেলাম। বাকি ভাস্কর্যগুলো স্টোর রুমে। কখনো অনুমতি সাপেক্ষে দেখা যাবে। তবে ১৯৯৮ সালে জাদুঘর আয়োজিত প্রদর্শনীতে নভেরার কাজ দেখেছিলাম প্রথম এবং আশ্চর্য হয়েছিলাম তার কাজের উচ্চতা দেখে, হ্যাঁ এটা সকল অর্থেই। চিন্তা, কাজের ফর্ম, উপস্থাপনা সবকিছুতে তার স্বাতন্ত্র্যতার ছাপ। দেশীয় উপকরণ, বিষয়বস্তুকে আধার করে পশ্চিমা আধুনিকতার কিছুটা প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি প্রত্যেকটি কাজকে করে তুলেছিলেন অনন্য। তার নিজস্ব স্টাইলকে তৈরি করতে পেরেছিলেন, অন্তত খালি চোখে দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। ২০১৫ সালের ৬ মে নভেরা শারীরিকভাবে প্রস্থান করলে তার কাজগুলোকে আরেকবার দেখার ইচ্ছা হয়। জাদুঘরে গিয়ে দেখতে পাই প্রাঙ্গনে ১০টি ভাষ্কর্য। মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই ডানে বাঁধানো জলের মাঝে পরিবার কাজটি, সিমেন্টে তৈরি, সাদা রঙ। একটি গরুর শরীরের সাথে দুজন মানুষের শরীর মিলেমিশে আছে, মিথষ্ক্রিয়া। এ কাজটিতে বাংলা অঞ্চলের কৃষি প্রধান পরিচয়টি মূলত প্রকাশিত হয়েছে গৃহপালিত গরু এবং মানুষ পরস্পরকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে, একজনের শরীর, জীবন নির্ভরশীল অন্যজনের উপর। এই যে চিন্তার তীক্ষ্ণতা তা অত্যন্ত সূক্ষ আবার সহজ সাবলীল। যে কোনো দর্শকই একে অনুভব করতে পারবেন এর চিন্তার দিকটিও স্পষ্ট। শিল্পী মানুষ এবং গরুর শরীরে তিনটি বড় বৃত্ত তৈরি করে আলো ও বাতাস চলাচলের পথ তৈরি করে দিয়েছেন যা একই সাথে হেনরি মুরের কাজের স্টাইলকে মনে করিয়ে দেয় আবার বাংলা অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি যে একই সুতায় বাঁধা সে বিষয়টিও এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। এয়ার পোর্ট রোডে করা পরিবার কাজটি জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য উপহার দেয়া হয়েছে
। জাদুঘর প্রাঙ্গণে আরেকটি কাজ দেখে দীর্ঘক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটা নিস্তব্ধতা লম্বা উঠে যাওয়া সৌধের চারপাশে। স্মৃতিস্তম্ভের আদলে তৈরি শান্তি নামের কাজটি সিমেন্টে তৈরি, কালো রঙের। আসনের ভঙ্গি যা উপমহাদেশের পরিচিত স্টাইল এবং আসনটি উর্ধ্বে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গছে। এই ধরনের ভঙ্গি কোনো প্রার্থনা বা একান্ত ধ্যানের কথা মনে করিয়ে দেয়। শান্তি নামটি হয়তো শান্তির জন্য ধ্যানকে বোঝাতেই রাখা হয়েছিল।

শান্তির পাশে নারী-পুরুষ যুগল। এখানে তাদের শরীর একটি। নারী-পুরুষ শরীরের মধ্য স্থানটি কিছুটা খাঁজকাটা যাতে দুজনের মেটাবলজিমকে একরূপে দেখানোর প্রয়াস রয়েছে আবার পরস্পরের সম্পর্কের ভেতর স্পেসকে বোঝানো হতে পারে। দুজনের একই শরীর থেকে দুপাশে দুটো হাত এবং তিনটি পায়ের আদল দেখা যায়। খুব সিম্পল কাজ দেখে তাই মনে হয় , মাটির টেপা পুতুলের আদলে মুখের গড়ন। তবে এই যে স্টাইলটি এটি অত্যন্ত আধুনিক এবং ব্যতিক্রমী বলা যায়, বিশেষ করে ৬০ এর দশকে এ অঞ্চলে এরকম কাজের খোঁজ পাওয়া যায় না। পরিবার নামে আরেকটি কাজ দেখলাম। এটাও সিমেন্টের তৈরি, সাদা রঙ। একটি নারী শরীরের আদল, কিছুটা নৌকার ভঙ্গিতে বাঁকানো, মধ্যখানে স্পেস, সেখানে তিনটি মানব শরীর; মা ও সন্তানের আদিরূপ কিন্তু উপস্থাপনা আধুনিক এবং স্বতন্ত্র। নারী শরীরের মধ্যখানে একটু স্পেস, হাতটা স্পষ্ট নয়। মা যেন তার সন্তানদের নিজের শরীরে, পৃথিবীতে বাড়তে দিয়েছেন, উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সন্তানদের, এখানে ফ্রিডমের একটা রূপ দেখতে পাওয়া যায়, আরেকটি নারী-পুরুষ যুগল। তবে এখানে তারা স্বতন্ত্র শরীর নিয়ে উপস্থিত, মাঝখানে বন্ধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে। যুগলের তিনটি পা, পায়ের হাঁটুতে তিনজন মানব-মানবী। এটা সন্তানের প্রতীক হতে পারে আবার মানুষের যূথবদ্ধ সমাজকেও প্রকাশ করেছে। নিচের তিনটি ফিগার লম্বা হাত ধরে নাচের মুদ্রায়। এই কাজটি দেখে নভেরার নাচের প্রসঙ্গটি মনে পড়ল। ভাস্কর্যটির রঙ মেটে, নারী শরীরের উর্ধ্বাঙ্গের কিছু অংশ সাদা, তাতে বোঝা যায় রঙ উঠে গেছে।

প্রাঙ্গণের আরেকটি কাজ কিছুটা ছাইরঙের সিমেন্টের তৈরি, বেশ উঁচু, কয়েক ফুট হবে, উপবিষ্ট নারী। একটি নারী শরীরের আদল, আসনের ভঙ্গিতে বসা, মাঝখানে বৃত্ত দিয়ে বাইরের প্রকৃতিকে দেখা যাচ্ছে। নভেরার কাজে এই যে বৃত্ত তৈরির ব্যাপারটি অনেকবার এসেছে। মনে হয় একটি ফিগার বা ভাস্কর্যের দমবদ্ধ অবস্থাকে ভেঙে দিতেই তিনি এ সার্কেলগুলো করেছেন। ফিগারের বসার ভঙিটি গ্রামীণ নারীর ঘোমটা পরিহিত আদলকে চিহ্নিত করে তবে সে নারী ঋজু এবং স্বয়ম্ভূ। একক নারী ভাস্কর্যটির পাশে পাশাপাশি দুটো ফিগার। দুটোই পুরুষ শরীরের এবং কাজদুটোতে যথেষ্ট মিল রয়েছে। একটির রঙ গেরুয়া অন্যটি সাদা, সিমেন্টের তৈরি। একটি একক লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছে ফিগার দুটি। বাম পাটি বাঁকিয়ে ডান পায়ের উপর রাখা আর বাম হাতটি হতে একটি অংশ মাথার অংশের সাথে যুক্ত। এখানে একটি মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে যা মনের ভিন্নতাকে ইঙ্গিত করে,
জাদুঘর প্রাঙ্গণের আরেকটি ভাস্কর্য সাদা রঙের, সিমেন্টে তৈরি। মূলত একটি ফিগার মধ্যে লম্বাকৃতি স্পেস। এবং বাম হাত এবং ডান পা হতে আরও দুটো মানব শরীরকে উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে নভেরার এ ধরনের কাজ থেকে মানুষের যূথবদ্ধতা এবং পরস্পরর নির্ভরশীলতার দিকটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে আবার তাদেরকে স্বতন্ত্রও মনে হয়।

শাহবাগের জাদুঘরের গ্যালারিতে নভেরার পাঁচটি ভাস্কর্য দেখলাম কাচ দিয়ে ঘেরা সবই মানব ফিগার। একটিতে তিনটি ফিগার। বাবা-মা, সন্তান, দ্বিতীয়টিতে নারী-পুরুষ খুব স্পষ্ট ভঙ্গিতে, দুজনের মাঝখানে সন্তান, সিমেন্টের তৈরি, মেটে রঙ। আরেকটি কাজ গরু-নারী-পুরুষ, তবে ফ্যামিলি কাজটি থেকে এটি আলাদা গঠনগত ও শৈলীর দিক থেকে। নারীর ভঙ্গিটিও শায়িত। পঞ্চমটি একটি নারীর ফিগার। ফিগারটি উন্মুক্ত, নারীর স্তন স্পষ্ট এবং হাত জোড়া করে পেটের উপর রাখা, একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীকে প্রেজেন্ট করা হয়েছে এখানে, মুখভঙ্গি গম্ভীর, অসাধারণ একটু উজ্জ্বল বাদামী রঙের। নভেরার কাজগুলো দেখতে দেখতে মনে হলো, এই অল্প কটি কাজ দেখে শিল্পীর ট্যালেন্টের যে পরিচয় পেলাম তার অন্য সব কাজ দেখতে পেলে আরও অনেক অনেক অনুভূতি আর চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পারতাম। তবে ফটোগ্রাফ দেখে কিছু কাজ কাজ নিয়ে মনব্য করলাম, যদিও তা একপেশে হতে পারে। তিনমাত্রার কাজকে এক মাত্রার দেখতে গেলে অস্পষ্ট একটা ধারণা সামনে আসে। নভেরার ব্যাংকক প্রদর্শনীর ব্রশিয়ারে একটি উঁচু স্থানে পেঁচার ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। পেঁচাটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন এক দর্শক পৃথিবী ও সৃষ্টি জগতের ।
১৯৭৩ সালে প্যারিসে যে প্রদর্শনী হয় সে ব্রশিয়ারে একটি সাপের অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়, A serpent desire serpent snake, সাপের অবয়ব এবং ভঙ্গি দুই-ই অভিনব। সাপের ফণাকে খুব বড় করে দেখানো হয়েছে, এবং সাপটি উর্ধ্বমুখী যেন একজন মানুষ, মানুষের ভেতরে যে সর্প-প্রবৃত্তি তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল কাজটিতে। পাকিস্তানে ১৯৬০ সালের এক্সিবিশনে পুরস্কারপ্রাপ্ত Child Philosopher কাজটি একজন বালকের মুখাবয়ব, ব্রোঞ্জের তৈরি। আক্ষরিক অর্থেই চিন্তাশীল সে শিশু যেন একটুকরো ভাস্কর্য হয়ে জানিয়ে দিচ্ছে শিশুর সরল-স্বাভাবিক দার্শনিক সত্তাকে। কাজটি মূলত মুখাবয়ব তবে তার বুকের অংশটি দৃশ্যমান। বিনাশের দেবতা কাজটির ফটোগ্রাফ দেখে বোঝা যায় বিনাশকারী বহু অস্ত্র নিয়ে অসুরকে নিধন করতে প্রস্তুত, অনেকটা দুর্গার আদল কিন্তু উপস্থাপনা ভিন্নধারার। নভেরার কাজের এই বৈশিষ্ট্যটাই তাকে আলাদা করেছে। খুব চেনা পরিচিত দৃশ্য, চরিত্র, চিন্তা কিন্তু তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে এমন এক ভঙ্গিতে যেখানে তা স্বতন্ত্র, নতুন এবং ঋজু। লাহোরের আল হামরা আর্টস কাউন্সিলে মা ও শিশু নামক কাজের আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে, মা তার সন্তানকে দু-হাত দিয়ে পায়ের উপর বসিয়ে রেখেছে, হাত দুটো দীর্ঘ, মা ও শিশু উভয়ের মাথাই সার্কেলের মতো। এই মাকে চিরন্তন মা যেমন মনে হয় তার সাথে যোগ হয়েছে নতুন সময়ের মায়ের সত্তা, নতুন সময়ের শিশু, স্ফিত স্তন, সবকিছু অনন্য।

নভেরা প্যারিসের স্টুডিওতে ২০১৪ সালে যে প্রদর্শনী হয় সেখানে The Goat of Chantemele /শঁতমলের ছাগলের ছবি ছাপা হয়েছে। এটিও ভিন্নমাত্রার। ছাগলটি তিন পায়ে দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখছে, কিছুটা নতমুখ। একটি প্রাণী যে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে পারে নভেরার কাজে সেই দিকটি উঠে এসেছে। এটা হচ্ছে সবকিছুকে তার প্রেক্ষিত অনুযায়ী দেখতে পারার চোখ। নভেরা প্যারিসে অনেক পেইন্টিংও করেন যাতে তার নিজস্ব স্টাইল বজায় ছিল। ৫ মে ২০১৪, প্যারিসের নিকটস্থ শঁন পামেল গ্রাম-ভাস্কর নভেরার বাড়ি, শুনশান নীরবতা। নভেরা ঘুমিয়ে আছেন বিছানায়। বহু বছর হল দেশ হতে বহু দূরে, নিজের মতো বাঁচতে চাওয়া, বাঁচিয়ে রাখা. শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখা। এসবই হয়তো চেয়েছিল নভেরা। ১১ মে শেষ যাত্রায় সঙ্গী হলেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন, বন্ধু আনা ইসলাম, বাংলাদেশের প্যারিসস্থ রাষ্ট্রদূত, দেশের কয়েকজন মানুষ-তারা দৈহিকভাবে বিদায় জানালেন নভেরাকে। দীর্ঘদিনের সঙ্গী গ্রেগোয়া দ্য ব্রুনস নভেরার কফিনে তার ডান কাধে রাখলেন একটি হলুদ গোলাপ, বাম কাধে নভেরার প্রিয় একটি চড়ুই (সেও সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল চিরনিদ্রায়) আর নভেরার এক্সিবিশনের ব্রশিয়ার। গ্রেগোয়া তাকে বিদায় জানাতে পারলেন না, বললেন আবার দেখা হবে স্বর্গে। নভেরা হয়তো ঘুমিয়ে আছেন প্যারিসের এক গ্রামে কিন্তু তার ভাস্কর্য, কাজ. জীবন-দর্শন সব ছড়িয়ে আছে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের ছয় দিকে, ছয় হাজার দিকে। একটি ছোট চড়ুইয়ের ডানায় চেপে নভেরার স্বয়ম্ভূ অবয়ব ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের মন ও মননে, ঘুন্টি ঘরে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক