ধর্ষণ বন্ধ করার টেকসই দাওয়াই

মুজিব মেহদী

প্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০১৯

সম্প্রতি দেশে ধর্ষণ মহামারির রূপ পরিগ্রহ করায় কী করে এটি বন্ধ করা যায় তা নিয়ে নানাজন নানারকম দাওয়াই দিচ্ছেন। সবার তৎপরতা দেখে মনে হলো, আমিই বা পিছিয়ে থাকি কেন, সেজন্য এই প্রেসক্রিপশন হাজির করলাম।

মেয়েদের জন্য:
মানুষ হিসেবে জগতের সবকিছুতে আপনার ও একটি ছেলের অধিকার সমান— মানবাধিকারের এই ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে চলনে বলনে আপনার দৃঢ়তা ধরে রাখুন এবং নিজস্ব যাপনশৈলী ও দায়িত্ব অনুযায়ী আপনার যা কাজ তা নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায় করে যান।

দোহাই, ধর্ষণের শিকার হতে পারেন ভয়ে কিছুতেই আপনার ব্রত থেকে চ্যুত হবেন না। আপনার বিরুদ্ধে যাবতীয় সহিংসতা আপনাকে চার দেয়ালের ভেতরে বন্দি করে ফেলবার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। কাজেই আপনি ব্রতচ্যুত হলেন মানে পুরুষতন্ত্রের মন্দ ভূতটাই জিতে গেল।

দৈবাৎ কখনো আক্রান্ত হলে খুব নীরিহ ভঙ্গিতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সমঝোতায় আসুন এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র অণ্ডকোষ বরাবর জোরসে লাথি বা নাক বরাবর সজোরে ঘুষি কষে সটকে পড়ুন ও ঘটনাটা পরিবারকে জানান। এজন্য মার্শাল আর্টের কিছু মুদ্রা জানা থাকলে ভালো। অবশ্য না জানলেও তেমন ক্ষতি নেই।

এর বাইরে আপনাকে রক্ষার জন্য আপনার নিজের আর কিছুই করবার প্রয়োজন নেই। কারণ আপনার ধর্ষণের শিকার হবার কারণ মোটেই আপনার কোনো দোষগুণ বা আপনি নন। এর শতভাগ দায় ধর্ষক ও ধর্ষণসহায়ক সমাজের।

ছেলেদের জন্য:
নারী, কিশোরী ও মেয়েশিশুদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করুন এবং আপনার সমান মর্যাদার মানুষ হিসেবে তাদের ভাবতে শিখুন—

- সন্তান হিসেবে মাকে, ভাই হিসেবে বোনকে, স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে, বাবা হিসেবে মেয়েকে।

- গৃহশিক্ষক হিসেবে মেয়ে শিক্ষার্থীকে, গৃহকর্তা হিসেবে কাজের মেয়েকে, বাড়ির মালিক হিসেবে ভাড়াটের স্ত্রী, কন্যা ও মেয়ে আত্মীয়কে, প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবেশীর স্ত্রী, বোন ও কন্যাকে।

- শিক্ষার্থী হিসেবে মেয়ে সহপাঠী ও নারী শিক্ষককে, স্কুল-মাদ্রাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নারী সহকর্মী ও মেয়ে শিক্ষার্থীকে।

- নেতা হিসেবে সহনেত্রী ও নারী কর্মী-সমর্থককে, কর্মী হিসেবে নারী সহকর্মী-সমর্থককে।

- সমাজকর্মী হিসেবে দলসদস্য নারীকে, সহকর্মী হিসেবে নারী সহকর্মী ও বসকে, বস হিসেবে অধীনস্থ নারী সহকর্মীকে।

- কারখানার মালিক হিসেবে নারী কর্মী ও শ্রমিককে, সুপারভাইজার হিসেবে অধীনস্থ নারী শ্রমিককে, কৃষক হিসেবে কৃষিশ্রমিক নারীকে।

- পুলিশ সদস্য হিসেবে নারী ভিকটিম, নারী আসামি ও নারী নাগরিককে, চিকিৎসক হিসেবে নারী রোগী ও তার নারী আত্মীয়কে, বাস চালক ও কন্ডাক্টর হিসেবে নারী যাত্রীকে।

- সম্পাদক হিসেবে লেখক নারীকে, লেখক হিসেবে সহলেখক নারীকে, নাট্যকর্মী হিসেবে সহনাট্যকর্মী নারীকে, শিল্পী হিসেবে সহশিল্পী নারীকে, নেটিজেন হিসেবে নেটিজেন নারীকে।

- মুসলিম হিসেবে অমুসলিম নারীকে, সংখ্যাগুরু হিসেবে সংখ্যালঘু নারীকে, বাঙালি হিসেবে অবাঙালি নারীকে, সেটেলার হিসেবে আদিবাসী নারীকে।

- ধনী হিসেবে দরিদ্র নারীকে, শিক্ষিত হিসেবে শিক্ষাবঞ্চিত নারীকে, বয়সে প্রবীণ হিসেবে বয়সে নবীন নারীকে, বয়স্ক হিসেবে মেয়ে ও ছেলেশিশুকে।

- সক্ষম হিসেবে বিশেষভাবে সক্ষম প্রতিবন্ধী নারীকে, সবল হিসেবে দুর্বল নারীকে, চালাক হিসেবে সরল নারীকে, দেশি হিসেবে বিদেশি নারীকে।

- জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভোটার নারীকে, সেবাদাতা হিসেবে সেবাগ্রহীতা নারীকে, মাতব্বর হিসেবে সাহায্যপ্রার্থী নারীকে।

- শাসক হিসেবে শাসিত নারীকে, ক্ষমতাসীন হিসেবে ক্ষমতার বাইরের নারীকে, বিচারক হিসেবে বিচারপ্রার্থী নারীকে, আমলা হিসেবে কামলা নারীকে, ধর্মগুরু হিসেবে ধর্মানুসারী নারীকে।

মাত্র এই একটি দাওয়াইই যথেষ্ট। আমরা পুরুষরা যদি নারীকে সমান মর্যাদার মানুষ ভাবতে ও সে অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করি, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রাতারাতি কমতে শুরু করবে। যত দিন যাবে, এর সুফল ততই সুবিস্তৃত হবে। এমনকি যারা এখনো জন্মগ্রহণ করেনি, জন্মাবার পর তারাও আর কোথাও ধর্ষক হবার প্রেরণা খুঁজে পাবে না।

লেখক: কবি