ধর্ম: একটি প্রতিযোগিতা
ইল্লিনা হকপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০১৯
লেখার প্রথমেই বলে নিই, আমি কোনো পণ্ডিত বা শিক্ষিত ব্যক্তি নই যার চিন্তা বা বক্তব্যকে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। হিউমান রাইটসের একটি বিশেষ আলোচনার বিষয় হলো, ফ্রিডম আফ স্পিচ। ধরুন, সে আলোকেই আমার আজকের লেখার বিষয় আগাবে।
ধর্মের ভিন্নতা আছে আর তার সাথে আছে নানা ধর্মাবলম্বীদের মতভেদ। এমনকি একটি ধর্মের মধ্যে আছে বিভিন্ন ভাগ। ইসলাম ধর্মের মধ্যে যেমন আছে সুন্নী, শিয়া, হানাফি, ওহাবি কত ভাগ। একেক গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব মতবাদে বিশ্বাসী, নিজস্ব গবেষণা আর আলোচনা সাপেক্ষে তারা কোরআনকে পর্যালোচনা করেছে এবং সে অনুযায়ী তারা চলার চেষ্টা করছে। আমি অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ ও মুসলিম, যার মনের কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
আরবি একটি ভাষা। নবি করিমের (স.) মুখের ভাষা বলে সেটি আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের। তবে আমি মনে করি, আরবি পড়ার সাথে সাথে এর অর্থ খুব ভালো করে পড়া উচিত। আমি সময় পেলেই কোরআন শরিফের অর্থ পড়ি। অর্থ পড়তে গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এসেছে আমার মনে। সুরা মায়িদাহর অর্থ পড়ছিলাম। এখানে লেখা আছে, ইহুদি আর নাসারাদের থেকে দূর থাকতে হবে। সেটার কারণ আছে। তা হলো, প্রভাবান্বিত হয়ে মুসলিম যেন কাফেরদের পথ অবলম্বন না করে।
কথাটা বাস্তব গ্লোবালাইজেশনের যুগে আমরা ক্যারিয়ার, উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ, আমেরিকা আসছি। নিজেরা মন থেকে না চাইলেও আমরা অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে মিশছি। নাসারাদের দেশের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আবার তাদেরকেই বিধর্মী বলে গালি দিচ্ছি। এখানেই আমরা নিজেদের সাথে নিজে প্রতারণা করছি, নিজেদের সুখ ত্যাগ করার মতো সাহস আমাদের নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি জিহাদিরা ত্যাগ করছে না? অবশ্যি করছে কিন্তু তারা হলো রাজনীতির বলি। এই যে শ্রীলংকায় হামলা হলো সেটি এমনি এক রহস্যময় ষড়যন্ত্র কিন্তু তাতে কাবা ঘরের দেশ সৌদি আরবের কিছুই যায় আসে না। খুব কম ধনী মুসলিম দেশের জিহাদি পাওয়া যায়। বেশির ভাগ গরিব মুসলিম দেশ থেকে না হয় পাশ্চাত্য থেকে জিহাদি হয়।
এত গভীর আলোচনায় নাই বা যাই। সুরা মায়িদাহতে আরো পড়লাম যে, ইহুদি আর নাসারাদের বন্ধুত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক আর মুসলমানদের সাথে তাদের বিরোধটাও সেখানে সুস্পষ্ট। আল্লাহ চাইলে পারেন বিরোধ ঠেকাতে তবে উনি ঈমান পরীক্ষার জন্য করেন না। আত্মরক্ষার জন্য, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বদলা নেয়া প্রয়োজনে এছাড়া মানুষ হত্যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না। শ্রীলংকার এই হামলা, ক্রাইস্টচার্চের হামলা কোনো কিছুই আত্মরক্ষার জন্য হচ্ছে না। সেখানে কাজ করে অন্য বিষয়। সেটি হলো জিদ, ধর্মীয় নির্দিষ্ট চেতনা স্থাপনের অপচেষ্টা। সার্বভৌমত্ব, অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা জায়েয। সেক্ষেত্রে ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ যুক্তিসংগত।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধটিও ধর্মীয় দিক থেকেও বাধ্যতামূলক ছিল। তাওরাত, ইনজিল, কোরআন সব আল্লাহর বাণী। সময়ের ধাপে ধাপে একেক সময় একেক নবি আমাদের কাছে আল্লাহর বাণী এনে দিয়েছেন। যদিও সব আল্লাহর বাণী, এরপরও আমাদের মধ্যে মতবিরোধ চরম। আর তা নিয়ে দাংগা ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। আল্লাহ চাইলে বিরোধ মিটাতে পারেন, এরপরও মেটে না কেন? আমরা মানুষরাই চাই না। কারণ ধর্মকেন্দ্রিক এই দুর্বলতা না থাকলে বিশ্বের অর্থনৈতিক অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আসল ঈমান আর জিহাদ হলো নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করা। আল্লাহ সব মানুষের রক্ত লাল করেছেন, আমাদের মাথার উপরে একটা আকাশ দিয়েছেন একটাই সূর্য দিয়েছেন যা আল্লাহর ইশারায় নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে (আয়াত ৩৮, (সুরা ইয়াসিন)। আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই, ফাবিআইয়্যি আলাইহি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান (সুতরাং আল্লাহর কোন অনুগ্রহকে অস্বীকরা করবে?) (সুরা আর রহমান)। আল্লাহ আসল ইনসাফকারী।
তবে আমরাই আলোচনা সমালোচনায় ধর্মকে জর্জরিত করে ফেলেছি, জিহাদের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা করে আমরা গুণাহ কামাচ্ছি। আমার তো মনে হয় না নিরীহ মানুষ হত্যার ফলস্বরূপ আল্লাহ কাউকে জান্নাত নসিব করবেন। কোনো মা-বাবা চায় না তার সন্তানরা পরস্পর খুনাখুনি করুক। সৃষ্টিকর্তাও কখনো চাইবেন না তার সৃষ্টিরা একে অপরকে মেরে ফেলুক। অথচ সেই সৃষ্টিকর্তাকে পুঁজি করেই এত হানহানি।
কেন জানি না সবকিছুর জন্য সভ্যতা আর প্রযুক্তিকে দায়ী মনে হয়। ত্রিশ বছর আগে শবে বরাতে হালুয়া, শবে কদরের ইফতার প্রতিবেশী হিন্দু, খ্রিস্টান বাড়িতে যেত। ধর্মীয় ভাবাবেগের পাশাপাশি তা ছিল সামজিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির রীতি। আজ আলেমদের মতে, শবে বরাত পালন করার নিয়ম নাই। নিয়মের বাইরে অনেক কিছু করতে হয় এখন যা যুগের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। পবিত্র ধর্মগন্থগুলো যখন নাযিল হয়েছিলো তখন সবকিছু এত জটিল ছিল না। পথভ্রষ্ট, অত্যাচারী, উচ্ছৃংখল জনগোষ্ঠীকে দমন করার জন্য নবিদের আগমন ছিল অন্ধকারে আলোর মতো।
আফসোস, রাসূল (স.) যদি এখন আসতেন তবে কোনোদিন তার উম্মাতদের এমন করে মানুষ হত্যা করতে দিতেন না। এই যুগে মানুষ সভ্যতার নামে বড় বেশি অসহনশীল হয়ে গিয়েছে। অবিশ্বাস্য আশা ছেড়ে আমার মতে চলুন না ফিরে যাই নিকটবর্তী অতীতে, অন্তত বিশ বছর আগে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ মন দিয়ে পালন করি, মানুষকে সম্মান করি, ভালোবাসি। আশরাফুল মাকলুকাতদের আল্লাহ যে সুন্দর অনুভূতি দিয়েছেন সেসবের সদ্ব্যবহার করি। হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করে মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিতৃপ্ত করে তুলি। আমি বিশ্বাস করি, এতেই জান্নাত পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, ধর্মের জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্য ধর্ম।